সোহেল রানা। প্রান্তিক কৃষক পরিবারের মেঝ সন্তান। নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলাধীন রামনগর জামালপুর গ্রামের বাসিন্দা। বাবা পেশায় ক্ষুদ্র কাপড় ব্যবসায়ি। লিখাপড়ার পাশাপাশি নার্সারি স্থাপন করে হয়েছেন স্বনির্ভর। পেছনের গল্পটি অতি বেদনাদায়ক। সৎ মায়ের সংসার হওয়ায় পড়াশুনা এবং খাবার দাবারে পরিবার তেমন যত্নশীল ছিল না। একান্ত নিজের ইচ্ছাতেই পড়ালিখা করেছেন। সংসারের সকল কাজ সেরে তবেই কলেজে যেতে হয়েছে।বড় ভাই হারুনুর রশিদের সহায়তায় নিরমইল ইউনিয়ন পরিষদে অনুষ্ঠিত ইয়ূথ লিডারশীপ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে ঘটিয়েছেন নিজের চিন্তার বিকাশ। নার্সারীর জন্য নিজেদের জমি এবং লীজ নিয়ে শুরু করেন আমগাছের চারা তৈরি। বছর ঘুরতেই গ্রাফটিং করে চারা বিক্রি করতে শুরু করেন। আসতে থাকে বাড়তি আয়। ২০১১সালে শুরু করে তখনকার বিত্তহীন সোহেল এখন কোটি টাকার মালিক। শুধু নার্সারীই নয়, জমি লীজ নিয়ে গড়ে তুলেছেন আম্রপালি এবং বারি-৪ জাতের আমবাগান।
শুধু সোহেল রানাই নয়। এরকম হাজারও তরুণের কর্ম-সংস্থানের সুযোগ হয়েছে আমবাগান করে। বরেন্দ্র অঞ্চলের আবহাওয়া আমচাষের অনুকুল হওয়ায় এখানে আম বিপ্লবে মেতেছেন সকল কৃষক। ফলে কৃষি এখন আর লাঙ্গল, বলদে সীমাবদ্ধ নেই। আধুনিক কৃষির ছোঁয়ায় পাল্টে গেছে এখানকার জীবনযাত্রা। অর্জুনপুর গ্রামে ২০০৯ সালে ঠিল একটি মাত্র মোটর সাইকেল। খাবার পানির উৎস ছিল পুকুর। এক ফসলি জমিতে কাজ করে বেকার থাকতো এলাকার সকল কৃষক। ২০২০ সালে এখানে আমবাগান ব্যতিত চাষের আর কোন জমি ফাঁকা নেই। প্রত্যেকটি বাড়িতে বিদ্যুৎ এবং খড়ির চুলার বদলে এখন গ্যাসে রান্না হচ্ছে। নারীদের আর ধান শুকাতে দেখা যায় না। গ্রামে ৫০টির অধিক মোটর সাইকেল। মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে এলাকার আমুল পরিবর্তন। আর পরিবর্তনের গল্পের মধ্যমনি উচ্চফলনশলি আম। বারি-৪, আম্রপালি-১০, ল্যাংড়া আমের বিশাল বাগান গড়ে উঠেছে অত্রাঞ্চলে। সাপাহার হয়ে উঠেছে আমের রাজধানী।
রুপগ্রামের তরুন কৃষি উদ্যোক্তা্ সোহেল রানা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্টে অধ্যয়ন করে কর্পোরেট সেক্টরে চাকুরি করেছেন কয়েক বছর। নিজে দেখেছেন এলাকার পরিবর্তন। তাইতো চাকুরী ছেড়ে দিয়ে এলাকায় ফিরে এসে গড়ে তুলেছেন “বরেন্দ্র এগ্রো ফার্ম”। প্রচলিত ফলের চাইতে অপ্রচলিত এবং উচ্চমূল্যের ফল চাষ করে ইতোমধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। বরেন্দ্র এগ্রো ফার্মে দেশি ফলের চাইতে বিদেশী ফল উৎপাদনে অধিক মনোযোগ দেখা গেছে। থাই পেয়ারা, বলসুন্দরী ও কাশ্মিরী আপেল কুল, ড্রাগন, উচ্চমূল্যের আম, লটকন, ত্বীন, ভিয়েতনামী নারিকেল, সৌদি খেজুরসহ বিভিন্ন বিদেশশী ফল চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
কৃষিতে তরুণদের এগিয়ে আসায় কৃষি পেয়েছে নতুন মাত্রা। গাছের উত্তম পরিচর্যা করে অধিক ফল ফলানো এখন কৃষি গবেষণার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বাজার এবং ব্যবস্থাপনায় মানুষের সম্পৃক্ততা সারা বছর। সারা বছরই বাগান কেনাবেচা হয়ে থাকে। বিভিন্ন হাত ঘুরে উৎপাদিত আম ভোক্তার কাছে পৌঁছে যায়। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ ৪ মাস সাপাহারে অবস্থান করে। এখানে প্রায় ৪শতাধিক আমের আড়ৎ।মানুষকে আর কর্মের জন্য বাইরে যেতে হয় না। এখন অন্যান্য এলাকা থেকে মানুষ আসে আম ক্রয় এবং ব্যবস্থাপনার কাজে। তরুণদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে মানসিকতায় আমুল পরিবর্তন। চাকরির জন্য হন্যে হয়ে, ঘুষ-দুর্নীতি না করে উৎপাদনে নিজেকে যুক্ত করেছে। পরিবর্তিত হয়েছে এলাকার সংস্কৃতি।
কর্মসংস্থানের পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষায় এখানকার মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছেন। ১০বছর পূর্বে যেখানে মানুষ পুকুরের পানি পান করতো এখন সেখানে বাড়ি বাড়ি সাপ্লাই। ভূগর্ভস্থ পানির পূনঃসঞ্চালন প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। এখন সুইচ চাপলেই পানি আসে। পরিবেশের ইকো সিষ্টেমেও এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। এখন এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এখানে হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন পশুপাখিরও আনাগোনা লক্ষ্য করা গেছে। শুধুমাত্র মানুষের মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে পত্নীতলা, সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর, তানোর, গোদাগাড়ি, নাচোলসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলা। সরকারের সঠিক প্রণোদনা এবং ব্যবস্থাপনা অব্যাহত থাকলে আগামিতে দেশের স্বর্নোজ্জ্বল ভবিষৎ অপেক্ষা করছে। যারা কৃষিকে অবহেলা করে আমাদের চাষা বানিয়েছে। তাদের একবার হলেও ঘুরে যেতে পারেন বরেন্দ্র অঞ্চল। তরুণরা ১০-১২ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরির পেছনে ছুটে না বেড়িয়ে ৩-৪ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে নিজের এবং ৫-৭জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেন। বছরব্যাপি ফল দেয় এমন চাষাবাদও হতে পারে বেকারত্ব ঘোঁচাবার অনন্য উপায়।