লম্বা একটা বেঞ্চ। বসে আছি। আমার পাশে আরেকজন বসা। ঝিমুচ্ছেন উনি। উকিল আর মক্কেলের হাঁটা চলায় গম গম করছে কুমিল্লা জজ কোর্ট। এক বাবার কোলে বাচ্চার কান্না। কান্না থামাতে বাবার হাজারো চেষ্টা। বাচ্চার মা ভিতরে উকিলের সাথে হয়তো কথা বলছে। আমার বাচ্চাও যখন কান্না করতো এভাবেই তাকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতাম। এরপর নীলা আমার থেকে আমাদের বাচ্চা আরাফকে কোলে নিয়ে বলতো – “তোমাকে দিয়ে এসব হবে না”- বলে মুচকি হাসত। সব কিছু কত সুন্দর ছিল তাই না? কত সুন্দর গুছানো সংসার। তাহলে তুমি কোর্টে কি করো? কোর্টে? এখানে আমার বেঁচে থাকার একমাত্র আশা ভরসার সমাপ্তি হচ্ছে। বুঝলাম না ঠিক, বুঝিয়ে বল। বলছি তবে শুনো।
পহেলা এপ্রিল ১৯৯৩। বুধবার। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। চট্টগ্রামের পোস্তার পাড় এলাকার এক চায়ের দোকানে এক কাপ চা নিয়ে বসে আছি। ছোট কাপ। কতটকুই আর চা। এই এক কাপ চায়ের দাম ৫ টাকা। রেডিও তে আজম খানের গান “আলাল ও দুলাল” বাজছে। হিট হয়েছে গানটা। হঠাৎ প্রচন্ড শব্দের এক বজ্রপাতের আবির্ভাব। নীলার কি অবস্থা কে জানে? নীলার প্রেগ্নেন্সির ৮ মাস হতে চলল। ঘরে সে একাই। বজ্রপাত খুব ভয় পায়। আমি বাজারের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলাম কিন্তু এই অসময়ে বৃষ্টির কারণে আটকে গেলাম।
-“আদিব ভাই! ও আদিব ভাই!”
একি! এতো শফিক ভাই। আমাদের পাশের বাসায় থাকে। কি হয়েছে? উনাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?
-“আদিব ভাই! আপনি এখানে? ভাই ভাবির অবস্থা ভালো না”।
চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বললাম –“কি হয়েছে ভাই? নীলার কি হয়েছে?”
-“ভাই, আপনি জলদি চলেন। অবস্থা ভালো না। হাসপাতালে নেওয়া লাগতে পারে”।
-“চলেন”। বলে দোকান থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সা নিলাম।
বাইরে ঝড় বৃষ্টি। আব্বু-আম্মু ও শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই মোনাজাতে আল্লাহকে স্মরণ করছেন। সাহায্য চাচ্ছেন। অপারেশান থিয়েটার। হঠাৎ দরজা খুলে ডাক্তার বেরিয়ে এলেন।
-“কি অবস্থা ডাক্তার সাহেব?”
-“কনগ্রেচুলেশান! আপনার ছেলে হয়েছে”।
এভাবেই আমাদের অভাবি অন্ধকারের সংসারে আলো জ্বেলে প্রবেশ করলো আমাদের আরাফ।
হ্যাঁ, আমাদের সংসারে অভাব ছিল। কিন্তু আমি আমার সর্বচ্চটা উজাড় করে দিয়েছিলাম। দিনে পোস্তার পাড় হাই স্কুলে শিক্ষকতা আর রাতে দৈনিক কর্ণফুলী পত্রিকায় সম্পাদকের দায়িত্ব, সব মিলিয়ে ভালোই চলে যেত আমাদের।
১৯৯৯ সালে ১৬ তম বিসিএস এ পাশ করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে জয়েন করি। নীলাকে কুমিল্লার ধর্মপুরের এক ছোট্ট বাসায় নিয়ে আসি। আরাফ তখন নীলার কোলে। আমাদের তিন জনের এই ছোট্ট রাজ্যে তখন অভাব ধীরে ধীরে যেমন অস্ত যাচ্ছিল তেমনি সচ্ছলতার সূর্য উদিত হচ্ছিল। লেকচারার হিসেবে মাসিক বেতন ২০ হাজার টাকা ধার্য করে সরকার। ১৯৯৯ সালে ২০ হাজার টাকা মানে আকাশ চুম্বি বেতনই বলা যায়। সাথে অন্যান্য সুযোগ শুবিধা তো আছেই। কলেজে সকাল থেকে সারাদিন ক্লাস করিয়ে বিকেলে ক্লান্ত শরীরে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন নীলা স্নিগ্ধ হাসি হেসে বলতো –“তুমি এসেছ? বস, আমি তোমার জন্য লেবুর শরবত করে আনি”। সেই লেবুর শরবতের স্বাদ আজও আমার জিহ্বায় লেগে আছে। বস্তুত, নীলার সেই স্নিগ্ধ হাসিই আমার অর্ধেক ক্লান্তি দূর করে দিত। ফ্রেশ হয়ে যখন খাটে ঠেস দিয়ে বসতাম নীলা আমাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে ভঙ্গিতে তার মাথা আমার বুকে রেখে বলতো –“দেখবে একদিন আমাদের ছেলে অনেক বড় হবে। অনেক বড় হবে”। আমি তখন নীলাকে জড়িয়ে ধরতাম আর বলতাম –“তুমি যখন বলছো, হবেই”।
নীলা তখন মাথা উঠিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলতো -“আমি বললেই হয়ে যাবে?”
-“আমার নীলার কথা কখনো মিথ্যা হতে পারে? যার মন মেঘের মতো শুভ্র আর স্বচ্ছ, তার কথা, তার স্বপ্ন কক্ষনো মিথ্যে হয় না”।
-“এত বিশ্বাস করো আমাকে?”
-“ভালোবাসি, প্রচন্ড ভালোবাসি, কিভাবে অবিশ্বাস করি”।
নীলা কিছুই বলতো না। বুকে মাথা রেখে চোখ বুজে রাখতো।
তখনো ভাবিনি কত কঠিন সময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
সাল ২০০২। এক দিন জরুরী কাজে কলেজ থেকে কান্দিরপাড় গেলাম। কান্দিরপাড় কলেজ রোডে এসে রিক্সা থেকে নামতেই দেখি নীলা ফটোকপি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। ভাড়া দিয়ে যেই না ওর দিকে পা বাড়াবো তখনি দেখলাম এক মধ্যবয়সী লোক নীলার সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটাকে আমি চিনলাম না। এরপর দুজন একসাথে হাঁটা শুরু করল। আমি পিছু নিলাম। কান্দিরপাড় নিউমার্কেটের বিপরীত পাশে এলক্লাসিকো রেস্টুরেন্টে ঢুকল ওরা। আমার মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। লোকটা কে? নীলার কোন বন্ধু? নাকি নীলা কোন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ল? আমি কি একবার রেস্টুরেন্টে যাব? নাহ থাক। নীলাকেই জিজ্ঞেস করবো লোকটা কে?
আমি কলেজ থেকে সন্ধ্যায় ফিরে দেখি নীলা ঘরে নেই। নীলাকে কল দিলাম। কল কেটে দিল। আবার কল দিলাম। কেটে দিল। চিন্তায় পড়ে গেলাম। কোন বিপদ হলো না তো?
অবশেষে ঘরে নীলার আগমন ঘটলো রাত দশটায়।
-“কোথায় ছিলা এতক্ষন?” আমার জিজ্ঞেস।
-“কোথায় ছিলাম মানে বাইরে ছিলাম”। নীলা স্যান্ডেল খুলে ঘরে প্রবেশ করল।
-“সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি, বাইরে কোথায় ছিলে?”
-“তোমাকে কি তার কৈফিয়ত দিতে হবে?”
-“অবশ্যই দিতে হবে। আমি তোমার হাসবেন্ড”।
-“কেন? আমি কি তোমার কাছে বন্দী?
-“আমি কি তা বলেছি?”
-“তুমি সেরকমই ব্যাবহার করছো”।
-“বলতে খুব সমস্যা হচ্ছে তাই না? ওই লোকটা কে?”
-“কোন লোক?”
-“যার সাথে রেস্টুরেন্টে খেলে। এতক্ষন সময় যার সাথে অতিবাহিত করলে? ছিঃ”
-“ওহ! এখন তুমি গোয়েন্দাগিরি শুরু করে দিয়েছ? তোমার মন মানসিকতা এত নিচু?”
-“আমার মন মানসিকতা নিচু? নাকি তোমার চরিত্র নিচু?”
-“কি বললা তুমি? কি বললা? আমি আর তোমার সাথে সংসার করবো না। আমি ডিভোর্স চাই, ডিভোর্স। চিৎকার করতে করতে নীলা ভিতরের রুমে চলে গেল।
ভিতরের রুম থেকে সব কিছু আরাফ শুনেছে। নীলাকে ব্যাগ গুছাতে দেখে আরাফ আমার কাছে ছুটে আসে।
-“বাবা! বাবা! ডিভোর্স মানে কি? মা কোথায় যাচ্ছে? এই বাবা! বলো না?”
বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কি বলবো এই ছোট্ট ছেলেকে। পুরো পৃথিবী হয়তো সেদিন আমার সাথে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল।
লম্বা একটা বেঞ্চ। বসে আছি। আমার পাশে আরেকজন বসা। ঝিমুচ্ছেন উনি। উকিল আর মক্কেলের হাঁটা চলায় গম গম করছে কুমিল্লা জজ কোর্ট।
-“আদিব সাহেব!”
-“জি! উঠে দাঁড়ালাম।
-“দুঃখিত আপনাকে এতক্ষণ বসিয়ে রাখলাম”।
– “না স্যার ঠিক আছে”।
– “ভিতরে আসুন”।
উকিলের কথা মত উনার চেম্বারে প্রবেশ করলাম।
-“বসুন!”
-“জি”।
-“আদিব সাহেব, আপনাদের ডিভোর্স কার্যকর হয়েছে। এই নিন আপনার কপি”।
ডিভোর্সের কপি হাতে নিলাম। সমাপ্তি। আমার আর নীলার গল্পের সমাপ্তি এখানেই।
কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন। সাতটায় ট্রেন। এখন সন্ধ্যা ৬টা বেজে ১০ মিনিট। হঠাৎ একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসলো। রিসিভ করলাম।
-“কোথায় তুমি?”
এতো নীলার কণ্ঠ!
-“কেন?”আমার জিজ্ঞেস।
-“কিছু কথা ছিল তোমার সাথে। খুব জরুরী”।
-“রেলস্টেশনে আছি”।
-“আচ্ছা, আমি আসছি”। বলেই নীলা কল কেটে দেয়।
পাহাড়িকা এক্সপ্রেস দ্রুত বেগে চলে যাচ্ছে। নাহ আমি পাহাড়িকা এক্সপ্রেসের টিকিট কাটাইনি। মহানগর গোধূলির টিকিট কাটিয়েছি।
-“বসবো?”
মেয়েলি কণ্ঠ শুনে ডান পাশে তাকালাম। দেখলাম নীলা দাঁড়ানো।
-“হুম বসো”।
নীলা বসলো।
-“বলো কি জরুরী কথা”।
-“তুমি ওদিন জানতে চেয়েছিলে আমি রাত ১০টা পর্যন্ত কোথায় ছিলাম”। নীলা বলল।
-“এখন জেনে লাভ কি? ডিভোর্স তো হয়েই গিয়েছে”। আমি বললাম।
-“তোমার জানা উচিত”।
নীলার দিকে তাকিয়ে বললাম –“বল শুনি”।
-“তুমি ওদিন যে ছেলের সাথে আমাকে দেখেছিলে সে আমার ছোট বেলার বন্ধু আবরার। অনেক বছর পর ওকে ফেসবুকে খুঁজে পাই। ভাবলাম ওদিন একটু দেখা করি তাই দেখা করা। আমি জানি তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না। পিছে ঘুরে দেখ”।
পিছে ঘুরে দেখলাম সেই লোকটি দাঁড়িয়ে আছে।
-“হ্যালো! আমি আবরার, নীলার ছোটবেলার ফ্রেন্ড”।
-“হ্যালো! আমি আদিব”।
-“নীলার মুখে আপনার অনেক প্রশংসা শুনেছি। আপনি নাকি অনেক ভালো গান গাইতে পারেন”।
-“আবরার! এখন এসব বলার সময়?” নীলা রাগান্বিত কণ্ঠে বলল।
-“আচ্ছা সরি। বাকি কথা আমি বলি?”
-“ওদিন রেস্টুরেন্টে থেকে নীলা এক ঘন্টা পরই বাসায় ফিরেছিল। বাসায় ফিরেই ওর বমি হয়। আপনাকে নীলা কল করে। কিন্তু আপনি কল কেটে দিয়েছিলেন। খুব সম্ভবত আপনি ক্লাসে ছিলেন”।
আমার ওদিনের কথা মনে পড়ে গেল। নীলা কল দিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু পরে আমি কল ব্যাক করতে ভুলে যাই।
-“বাকিটা আমি বলি?”
-“আম্মু তুমি?” আম্মুকে দেখে আমি বিস্মিত। আম্মুর পাশে আব্বুও দাঁড়িয়ে।
-“সেদিন তোকে না পেয়ে নীলা আবরারকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে চলে যায়। ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানতে পারে নীলা প্রেগন্যান্ট। সেই খুশির সংবাদটা প্রথমে ফোনে সে আমাকে জানায়। তোকে আর ফোন দেয়নি কারন ভেবেছিল বাসায় এসে তোকে খুশির সংবাদটা দিবে। কিন্তু…”
-“বাবা! মা! তোমরা সবাই যাও আমি আদিবের সাথে একলা কথা বলতে চাই।
বাবা, মা এবং আবরার দূরে গিয়ে দাঁড়াল।
-“তুমি তো জানো, আমার রাগ একটু বেশি, সেদিন তুমিও না?…” নীলা বলল।
-“তুমিও তো জানো আমার অনেক রাগ, এভাবে ডিভোর্সের কথা না বললেও পারতে?” আমি বললাম।
-“ডিভোর্সের কপিটা দেখি?” নীলা বলল।
ডিভোর্সের কপিটা নীলার হাতে দিতেই আমাকে অবাক করে দিয়ে কপিটা ছিড়ে ফেলল। এরপর নিজেরটা ছিড়ে ফেলল।
-“আদিব আমি তোমার হতে চাই। আমি আবারো তোমার হতে চাই। আমাকে ফিরিয়ে দিবে না তো?
নীলার এই কথার উত্তরের অপেক্ষায় অপেক্ষমান পুরো পৃথিবী।
চোখ থেকে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
-“বাবুর নাম কি রাখবা? ছেলে বাবু না মেয়ে বাবু……”
নীলা হেসে ফেলল। বলল –“মেয়ে বাবু”।
হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল। আমি নীলা কে নিয়ে রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমের ভিতরে চলে গেলাম। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। এটা শুধু বৃষ্টি নয়। এটা হচ্ছে নীলা ও আমার জন্য পৃথিবীর দেওয়া অভ্যর্থনা। হঠাৎ শিল পড়তে শুরু করল। আমার সেদিকে খেয়াল নেই। আমি নীলাকে দেখছি। আমি নীলাকে প্রায়ই দেখি। শুধু চোখে নয়। মনের বারান্দা দিয়েও। আমার মনের বারান্দা সব সময় খোলা থাকে। সেখানে কালো মেঘেরা ভিড় জমায়। বৃষ্টি হয়। পাখিরা খেলা করে। রৌদ্র আসে। আর গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে নীলা নামক এক মায়াবিনীর দেখা মিলে। তাকে দেখি। অপলক চোখে তাকে দেখি। সৃষ্টিকর্তা তার মাঝে বুঝি পৃথিবীর সমস্ত মায়া, রূপ ঢেলে দিয়েছেন। আমার মনের বারান্দা সব সময় খোলা থাকে। সেখান থেকে তার মিষ্টি হাসি আমি দেখতে পাই। দেখতে পাই তার স্নিগ্ধতা, নীরবতা আর মনঃমুগ্ধকর কথা। তার নয়ন ভোলানো দুষ্টমি আমার মনের বারান্দা থেকে দেখা যায়। তার নীল শাড়ি পড়া সাজের সৌন্দর্য বুঝি হুমায়ুন আহমেদের রূপাকেও হার মানায়। ঝুম বৃষ্টিতে যখন সে বাইরে বৃষ্টি উপভোগ করে আমি তখন আমার মনের বারান্দা দিয়ে তাকে দেখি আর দেখি। এই দেখার কখনো শেষ না হোক। আমার মনের বারান্দা সব সময় খোলা থাকে। সেখানে বৃষ্টি হয়। ভালোবাসার এক পশলা বৃষ্টি।
(সমাপ্ত)