নয় বছরের ছোটো রবি হাতে দেড় হাত মতো বাঁশের একটা কঞ্চি নিয়ে জোরে দৌড়ের ওপরেই একদমে বলে চলেছে বু….বু রে….. কোওওই গেলিইই? কিন্তু ঘরের প্রায় কাছাকাছি আসতেই, অকস্মাৎ কিছু দেখে ব্রেক কষে ড্রাইভার যেমন গাড়ির গতিবেগ ১০০ থেকে ২০ এর নিচে নিয়ে আসে, রবিও এমন করে পা টিপে টিপে পেছন থেকে গিয়ে বারান্দায় বসে থাকা মিনির গায়ে বসিয়ে দিল কঞ্চির এক ঘা। মিনি ম্যাঁও করে উঠে এক লাফে বারান্দা থেকে নেমে উঠানে নেমে রবির দিকে ঘুরে তাকাল।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে এই মিনিটা রাবিনার সাথে কই থেকে পিছু নিয়ে যে এ বাড়ি এসেছিল, সেই থেকে রাবিনার পিছু ছাড়েনি।
একদম কালো বিড়ালটাকে বাড়ির আর কেউই পছন্দ করে না। সবচেয়ে বেশি রবি। বিশেষ করে যখন রাতের বেলা ঘুমের মাঝে পা সড়াতে গিয়ে মিনির গায়ে পা লেগে যায়, ও ভয়ে লাফিয়ে ওঠে। তখনই ওর মনে হয়, বুবুর এই যত্নের কালী মিনির মুখে খানিকটা খড় ঢুকিয়ে দিয়ে আচ্ছামতো মাইর দিলে হয়তোবা গায়ের জ্বালা মিটত।
মিনির গলার আওয়াজ পেয়েই ১৫ বছরের উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের সুঠাম গঠনের তরুণী রাবিনা রাগী রাগী চেহারায় ভ্রু কুঁচকে দৌড়ে বাইরে এসেই রবির পিঠে দিল এক কিল দুম করে। যদিও রবি ব্যথা পায়নি, কারণ বুবুর হাতে এমন দুমদাম কিল প্রায়শই তার পিঠে জোটে। তবুও বলে উঠলো, ” বুবু তুই তোর কালির লাইগা আমারে মারলি দুম কইরা? পিঠটা ফুডা হইয়া গেল।”
রাবিনা নিজের মুখে আর রাগী ভাবটা ধরে রাখতে পারল না। ফিক করে হেসে দিয়ে বলল, “ঠিক হইছে। আমার মিনির মারস, ওর রক্ত মাংসের শরীল না?”
-“হ, তোমার মিনিরই রক্ত মাংসের শরীল, আমারডা তো তামা।”
রাবিনা হয়তো মনে মনে ভাবল, হয়তো জোরে লেগে গিয়েছে, তাই সেইটা ভোলাতে ভাইকে বলল, “ওমা.. আমার রাগ নাই? তুই বাইর থেইক্যা বুবু ডাইকা ভিতরে আইলি, আর আমার কাছে না আইস্যা মিনির পিঠে কঞ্চি মারলি?”, বলতে বলতেই রাবিনা রবির হাত থেকে কঞ্চিটা কেড়ে নিয়ে ফেলতে যাবে ওমনি রবি চোখ কপালে তুলে চেঁচিয়ে বললো, “নিচের দিক ধইরো না বুবু।সাপ মারছি। বড় এক গুক্কু সাপ।”
রাবিনা সাপের কথা শুনেই তাড়াতাড়ি লাঠিটা ফেলে দিয়ে বলল, তুই লাঠিমারা সাপ নিয়ে আইছোস। ওই খাড়া আইজ, এই বলে আরেকটা কিল যেই না দিতে যাবে রাবিনা, অমনি রবি দৌড়ে উঠানে নেমে জোরে হে হে করে হেসে বলল বুবু ওইটা সাপ মারা লাঠি রে, লাঠি মারা সা… আর বলতে পারল না রবি, তার আগেই আবার হো হো করে হেসে উঠল।
রাবিনা রাগী স্বরেই বলল, সে যা হউক। তুই গোসল না দিয়া ঘরে ঢুইক্যা দেখস, বলেই ও ঘরে ঢুকছিল এমন সময় রবি বলল, তোরে তো বলিই নাই বুবু কার ঘরে সাপ ঢুকছিল, জামাল ভাই’র ঘরে।
এইটুকু শুনেই রাবিনার বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করে উঠল। রাবিনা পিছন ঘুরে যেই না জিজ্ঞেস করবে পুরো ঘটনা কি, ওমনি দেখল, ওর ফুফু শাড়ির আঁচলে টাকা বাঁধতে বাঁধতে পান চিবিয়ে উঠানে পিক ফেলছেন আর বাড়ির ভেতরে ঢুকছেন। জামাল ভাই’র চিন্তা মনের মধ্যেই গুটিয়ে নিয়ে রাবিনা বলে উঠলো, ফুফু তুমি?খবর তো দিলা না আইবা?
রবিও পিছন ফিরে ফুফুর দিকে তাকিয়েই চোখ মুখ কিছুটা কুঁচকে নিল।
রাবিনার ফুফু, শাফিয়া হাতের ব্যাগটা রবির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে তো বাজান। রাবু, এক গেলাস ঠান্ডা পানি দে আগে। তারপর বলি। তোর মা কই? রাবিনা রবির থেকে ব্যাগটা নিয়ে রবিকে বলল, মা দ্যাখ পুকুরপাড়ে কাপড় কাঁচে ডাইক্যা নিয়া আয়।
রাবিনার একটাই ফুফু। কিন্তু রবির যেন চোখের বালি! রবির বুদ্ধি হবার পর থেকে বরাবর ও দেখেছে ফুফু হাতে একটা ব্যাগে করে তার নিজের পড়ার জন্য একটা কি দুইটা শাড়ি আর এক পলিথিনে পান, চুন, জর্দা নিয়ে এসেছে। ব্যাগ ভর্তি জিনিস না থাকলেও সাথে করে তিনি যে জিনিসটা নিয়ে এসেছেন সেটা হলো রাবিনার জন্য পাত্রের খোঁজ। এটাই রবির একমাত্র কারণ ফুফুকে ডাইনি, বুড়ি বলার। যদিও রাবিনা ছাড়া কারো সামনে এসব ও বলে না।
ওও চায় বুবুর বিয়ে হোক। দুলাভাই আসুক। কিন্তু সে তো জামাল ভাই হওয়া চাই।
রাবিনা আর রবি প্রতিদিন স্কুলে যাবার পথে আজগর শেখ এর বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় একমনে পড়ে যাওয়া ছেলেকে একনজর দেখার জন্য, রাবিনার টানা চোখটা আড়চোখে একটাবার হলেও পড়ুয়া ছেলেটার দিকে যে চায়, সে খবর ছেলেটা না রাখলেও ছোট্ট রবিটার চোখ এড়ায়না।
রবি ঠিক করে নিয়েছে, বড় হয়ে সে জামাল ভাইদের বাড়ির মতো ছাঁদ দিয়ে ঘর দিবে। তারপর সমানে সমানে বিয়ে দিবে। আর বুবুই বা কম কিসে? দেখতে মাশাআল্লাহ। পড়াশোনায়ও ভালো। এবারো এইটে বৃত্তি পেয়েছে। নিজের বোনের কোনো খুঁত খুঁজে পায়না রবি। ও নিশ্চিত, বড় হয়ে ওর বুবু গ্রামের ডাক্তার কাকার মেয়ের মতো বড় কিছু হবে।
শাফিয়া আর রাবিনার মা, আয়েশা ফ্যানের নিচে খাটে বসে গল্প করছেন আর রাবিনা ফুফুর জন্য আম কাটছে। রবি সেই যে মাকে ডেকে দিয়ে বেরিয়েছে এখনও আসেনি।
– ভাইরে দেইখ্যা আসলাম দোকানে বইস্যা। অহন দুপুর বেলায় আসে না? (রাবিনার বাবা একজন মুদি দোকানদার)
– আসে আপা। আইজ কয় দিন আবার আসে না।
– খাওন দাওনের এসিক সেদিক হইলে শরীল পইরা যাইব। দরকারে খাওন দিয়া দিও ভাবি।
– উনি নেয় না। তাঁর কেমন জানি লাগে বলে ঐখানে খাইতে।
এরই মাঝে রাবিনা আম নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, ফুফু আম খাও। মিষ্টি আম।
শাফিয়া আমের বাটিটা হাতে নিয়ে বলল, রাবিনা তো এইবার নাইনে। আমাগো এলাকায় এক মাইয়ার কি সর্বনাশটাই না হইলো, বাটি থেকে একটা আম মুখে নিয়ে বলল শাফিয়া।
আয়েশা কথাটার গতি আন্দাজ করে রাবিনাকে বলল, যা তো মা রাবিনা, দ্যাখ তোর ভাই গেল কই।
রাবিনা মায়ের কথামতো ভাইকে খুঁজতে বেরিয়ে গেল। একটু হাঁটতেই ও দেখল, রবি পাশের বাড়ির সিহাবের সাথে ঝগড়া লাগিয়েছে। রাবিনা কাছে গিয়ে সব শুনল।
ঘটনার মূলকথা হলো গতকাল সিহাবের ছাগলকে রবি নিজের গাছের পেয়ারা পাতা খাইয়েছে। আজ রবি সিহাবকে খেলতে বলেছে সিহাব খেলবে না। তাই রবি রেগে বলেছে কালকের পেয়ারা পাতা বের করে না দিলে যেতে দিবে না। এই নিয়েই ঝগড়া।
সব শুনে রাবিনা রবিকে কান ধরে নিয়ে এল। রবি আ আ করতে করতে বলল, তুই ছাড় বুবু। দোষ ওরই।
রাবিনা কান ছেড়ে গম্ভীর মুখ আর রাগী চোখে ওর দিকে তাকাতেই রবি বলে উঠলো, তুই আর রাইগ্যা কি করবি বুবু। মুটিটা আইছে না আইজ? দেখস তোর লাইগা একখানা পোলার খোঁজ আনছে।
রাবিনা রাগী কন্ঠেই বলে উঠল, ভালই হয়। অন্তত তোর এইসব মারামারি ঝগড়া তো আর দেহন লাগব না।
এটুকুতেই রবির চোখ ছলছল করে উঠল। বলল ওই বুবু, তুই এমনি কইতে পারলি? তুমি চইল্যা গেলে আমি রাতে কার লগে থাকুম, বুবু। রাইতে আমার প্রসাব চাপলে কেডায় দাঁড়ায় থাকব?
রাবিনা আর কিছু বলতে পারল না। ওর চোখও ছলছল করে উঠেছে। অন্য দিকে তাকিয়ে ও পানি মুছে নিল আর বলল, হ তুমি আমারে বিয়া দিবা না। নিজে বিয়া কইরা শেষে বউরে দিয়ে গাল শুনাইবা। রবি এবার হেসে উঠল। বলল, বিয়াই করুম না। তোরেও যাইতে দিমু না বুবু। রাবিনা আর কথা বাড়ালো না। দুজনই হেঁটে চলল।
রাতে আনিসুল খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমাতে গেল। আয়েশা তখন বলল,
শোনো, রাবিনা বড় হইছে। আমাগো টাকা পয়সাও অত নাই। আশপাশের অবস্থা ও তেমনি সুবিধার ঠেকে না। সেদিন সাইদ রে বাড়ির আশপাশ আমি ঘুড়তে ফিরতে দেখছি। কয়েকদিন পরপর ডিস লাইন এর বিল নাই, তার ঠিক নাই বইল্যা আসে। বাড়িতে তুমি থাক না। এখনকার অঘটন তো কওন যায় না। আপা আইজ এক পোলার কথা কইল। শুনে আমার ভালোই মনে হইলো। তুমি কি কও?
আনিসুল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, মাইয়্যা ডা পড়তে চাইছিল, লেহাপড়ায়ও ভাল। তা পোলায় কি করে?
আয়েশা হয়তো একটু ভরসা পেল। আনিসুল এর দিকে কাত হয়ে শুয়ে বলল, ছেলের নাকি বাজারে দুইটা রড, বালু, সিমেন্ট এর দোকান আছে। তুমি আপার সাথে কথা কও না।
সকাল বেলা আনিসুল বোন শাফিয়ার সাথে কথা বলল। সব শুনে পাত্র তার পছন্দ হলো।
এক রাতে, খাবার সময় আনিসুল বলল, দিনকাল যা হয়া গেছে। একটা পোলা দেখছি। তুই কি কইস।
রাবিনার কথাটা শুনে গলা দিয়ে ভাত যেন নামে না। পানি দিয়ে কোনোমতে গিলে বলল তুমি যা ভালো বোঝো আব্বা।
রাতে শুতে এসে দেখে রবি ঘুমায়নি। রাবিনা মশারি টাঙাচ্ছে, এমন সময় রবি বলল, ওই বুবু জামাল ভাই’র বাড়িতে সাপ ঢোকার গল্প তো তুমি শুইনলা না?
রাবিনা কোনো কথা বলতে পারল না। মনে হচ্ছে ওর বুকে এক কাঠঠোকরা ঠুকিয়ে যাচ্ছে একমনে।
বুবু রে? ওই বুবু। কথা কও। ওই বুবু, তুই চুপ থাকলে আমার ভালো লাগে না। রাবিনা চুপ করে শুয়ে পড়ল দেখে রবি বলল, ও বুবু, আব্বা কি কইল? তুমার কি সত্যই বিয়া হইব? আর রাবিনা চুপ থাকতে পারল না। রবিকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলো।
এরই মাঝে দেখা সাক্ষাৎ বিয়ের দিন সব ধার্য হয়ে গিয়েছে। এতো তাড়াতাড়ি সব হচ্ছে যেন কতকাল আগে ঠিক হয়ে আছে সব। সবই চলছে দ্রুতগতিতে। কেবল রবিটাই কেমন যেন নেতিয়ে পড়ছে।
গায়ে হলুদের রাতে হঠাৎই জ্বর এলো রবির। সারা গা পুড়ে যাচ্ছে যেন ভাত সেদ্ধ করা যাবে। ঔষধ খাইয়েও জ্বর গেল না।
পরেরদিন সারাক্ষণ রবি বুবুর পাশে শুয়ে থেকে বুবুর সাজানো দেখল। রাবিনাও রবিকে কাছে নিয়ে কতোবার চোখের পানি ফেলল হিসাব নেই। বরযাত্রী এলে রবিকে অন্য ঘরে নিয়ে গেল রবির মামী। একে একে সব শেষে এলো বিদায়ের পালা।
সবার থেকে বিদায় নিয়ে রাবিনা রবির কাছে গেল। যেহেতু বিয়ে বাড়িতে বউই প্রধান আকর্ষণ তাই বউ এর সাথে সবাই এলো রবির ঘরে।
রাবিনা রবির কাছে এসে ডাকল, রবি রে তাকা? রবি মুখ ঘুড়িয়ে ওপাশে শুয়ে আছে। তাকায় না। শাফিয়া এসে বলল, রবিরে তাকা, তোর বুবুর যাওনের সময় হইচে। রবি এবার মুখ খুলল।
বলল, ওই বুড়ি তুই কথা কইস না। তুই আমার বুবুর বিয়া জুটাইছোস।
রবি কাঁদছে, বাড়ির সবাই কাঁদছে।
জ্বরে ও কথা বলতে পারছে না। তবুও রাবিনাকে জড়িয়ে ধরে বলছে, বুবু রে যাইয়ো না তুমি। আমার রাতে মাথা টিপব কেডা। তোমার পায়ে ধরি বু..বু। ও বুবু আমি একা থাকতে পারুম না, তোমার মিনিরে দেইখ্যা একা ঘরে মইরা যাবো।
…….
চারপাশ থমথমে। এরই মাঝে সামাজিক নিয়মে রবির হাত ছেড়ে নতুন পথে রওনা হলো রাবিনা। আসবার সময় যে জামাল ভাইয়ের সাথে ধাক্কা লাগল সেদিকে আর খেয়াল গেল না ওর।