পার্ট -৩
মােটকথা, মানবসৃষ্টি-সম্পর্কিত কোরআনের বর্ণনা বিস্ময়করভাবে এত
বেশি সঠিক যে, মানবিক জ্ঞানের ধারায় তার ব্যাখ্যা বলতে গেলে অসম্ভব।
কেননা, কোরআন যে সময়ে নাজিল হয়েছিল সে সময়ে মানুষের সৃষ্টি-সংক্রান্ত
এ ধরনের তথ্য-বক্তব্য ও বর্ণনা ছিল মানবজ্ঞানের সম্পূর্ণ বহির্ভূত বিষয়। গােটা
পশ্চিাত্যজগতেও মানবসৃষ্টি-সম্পর্কিত কোরআনের এই বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য –
জ্ঞান এইমাত্র সেদিন (১৯৭৬ সালের ৯ নবেম্বর) পর্যন্ত ছিল সম্পূর্ণ অজানা।
ওই তারিখেই আমি ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল একাডেমী অব মেডিসিন-এ একটি প্রবন্ধ
উপস্থাপন করি। সেই প্রবন্ধেই প্রথম দেখাবার প্রয়াস পাই যে, বর্তমান বিজ্ঞানের আবিষ্কারমূলক অগ্রগতির প্রায় চৌদ্দ শ’ বছর আগেই কোরআনে মানবসৃষ্টি-সংক্রান্ত শারীরবিজ্ঞান ও ভূতত্ত্ব-সম্বলিত নির্ভুল তথ্য-উপাত্তের সঠিক
বর্ণনা বিদ্যমান। মানুষের অরিজিন-সংক্রান্ত কোরআনের এই বর্ণনার সঙ্গে কোরআনেই বর্ণিত প্রকৃতির বিভিন্ন বিষয়-সংক্রান্ত বক্তব্য যদি একত্রিত করে নেয়া হয়, তাহলে, পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব সম্পর্কে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সেই আদিকাল থেকে যে বিরােধ চলে আসছে, সেই বিরােধ নিরসনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাদান আমরা অনায়াসেই পেতে পারি। শুধু তাই নয়, মানুষের অরিজিন সম্পর্কে ধর্ম ও বিজ্ঞানের বিতর্ক-আলােচনায় কোরআন নতুন যুক্তি জোগান দিতেও সক্ষম। বস্তুত, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত মনের তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে কোরআনের মত একটি পবিত্র ধর্মীয়গ্রন্থের
তব্যের এই যে মিল ও সাযুজ্য, তাও আমাদের সেই বিতর্ক-আলোচনায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিতে পারে। এর ফলে, মানুষের আদি উৎস তথা পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব-সম্পর্কিত উপরে বর্ণিত তথাকথিত বিজ্ঞানীদের তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তের ব্যাপারেও আমরা নতুন করে পুনর্বিবেচনার ক্ষেত্র ও অবকাশ পেতে পারি। বলা অনাবশ্যক যে, তথাকথিত বিজ্ঞানী-গবেষকদের ওইসব তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তে পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব সম্পর্কে কাল্পনিক ধারণাকে যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, বাস্তব সত্যকে করা হয়েছে ততটাই উপেক্ষা ও অস্বীকার। উনিশ শতকের শুরু থেকেই পাশ্চাত্যে বিজ্ঞান ও ধর্ম পরস্পরের বিরােধী অবস্থান গ্রহণ করে আসছে। এর কারণ অবশ্য অবােধগম্য নয়। ধর্মীয় বক্তব্য বলতে সে সময় থেকে এ যাবত কেবলমাত্র বাইবেলের বর্ণনাকেই গ্রহণ করা হয়েছে। অথচ বিজ্ঞানের প্রমাণিত তথ্য ও উপাত্তের সঙ্গে বাইবেলের বক্তব্যের অসংগতি সর্বজনবিদিত। এই অবস্থায় বিজ্ঞানের তথ্য-প্রমাণের দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত বাস্তব সত্যকে যদি আমরা স্বীকার করে নেই, তাহলে মানুষের আদি উৎস তথা পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব সম্পর্কে বাইবেলের বর্ণনা যে গােড়া থেকেই। বিজ্ঞানের সেই আবিষ্কৃত ও প্রমাণিত সত্যের বিপরীত হয়ে পড়ে, সে সম্পর্কে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ থাকে না। খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ববিদরা সবাই বাইবেল সম্পর্কে একান্ত গুরুত্বের সঙ্গে যে বক্তব্যটি উল্লেখ করে গেছেন, এই প্রসঙ্গে তা স্মরণ করা যেতে পারে। সে বক্তব্যটি হল, বাইবেল মানুষের দ্বারা রচিত হলেও এটি রচনার বেলায় সংশ্লিষ্ট লেখকবৃন্দ বিধাতা কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। কিন্তু তারা যাই বলুন, এ কথা আজ আর অস্বীকার করার উপায় নাই যে, বাহরেল-রচয়িতাবৃন্দ তাদের ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণা সত্ত্বেও বাইবেলের বর্ণনায়। যতসৰ অসঠিক বক্তব্য লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এর একটা কারণ এই হতে। পারে যে, বাইবেল রচনার বেলায় সংশিষ্ট লেখকদের ভাষা তাদের এশ্বারক। অনুত্ত্বেণীকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে নাই; অথবা সে সময়ে প্রচলিত। যেসব কাহিনীকে জনসাধারণ ধর্মীয় বক্তব্য বলে মর্যাদা দিতেন—রচয়িতাবৃন্দ সে । সবের সূত্র অবলম্বন করে বাইবেল রচনা করতে গিয়েই এ ধরনের বিচ্যুতির
শিকার হয়েছেন।