বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
আমার সাত বছরের ছেলে মৃন্ময় এত দুষ্টু, তাল সামলানোই দায় ওকে নিয়ে। এই যে এখন সারা বারান্দাময় ছোটাছুটি করে আমার এত সাধের আচারের বোয়েমটাই দিল ভেঙে। বকব কি, অপরাধী ভাব করে মাফ করে দাও এমন ভঙ্গি করে দাড়িয়ে রইল ও।
এত দুষ্টুমি করিস, তুই যা…।
আমিতো প্লেন নিয়েই ওড়াচ্ছিলাম, পায়ে কী বাঁধছে দেখেছি নাকি! মুখ ঝামটা নিয়ে বল্ল ও। অর্থাৎ ওর কোনো দোষ নেই।
কাগজের প্লেন নিয়েই জীবন কাটতে হবে তোকে! লেখাপড়া নেই। পাজি ছেলে! খেয়াল করিনি, আমার বড় ছেলে তন্ময় হাসি মুখে ঘর আলো করে ঢুকল। এই ছেলেটাকে আমি বড় ভালোবাসি। ক্লাস টেনে পড়ে মাত্র। অথচ এত ঠাণ্ডা মাথা, ওর বাবাকেও হারিয়ে দিতে পারে বুদ্ধির জোরে।
দেখিতো তোর প্লেন কেমন ওড়ে?
আমি দরজার গায়ে ঠেস দিয়ে দু’ছেলের কাণ্ড দেখতে লাগলাম।
মৃন্ময় আগের কৃতকর্ম ভুলে গেছে। মহোৎসাহে ভাইকে প্লেন উড়িয়ে দেখাচ্ছে কেমন জোরে ছুটছে ওটা। আনন্দে চকচক করছে ওর চোখ দু’টো। মা, মাটিতে নেমে গেল! একদম রকেটের মতো, তাই না?
আমি হেসে ফেল্লাম। তুই রকেটে দেখেছিস?
দেখেনি? টিভিতে দেখলাম সেদিন। আমি বুঝি জানি না? আমি ইউরি গ্যাগারিনকেও চিনি। হুঁ!
কিন্তু বাবা, রকেটটার সাইজ দেখেছ তো, প্লেনের চাইতেও আলাদা।
হুঁ, তা ঠিক। কিন্তু…কিন্তু…একই রকম উপরে উঠতে পারে, তাই না?
মাথা দোলাল তন্ময়। -মোটেও না।
তুই কি কখনো শুনেছিস, প্লেনে করে চাঁদে গেছে কেউ? সবাই রকেটে যায়। তার মানে রকেট প্লেনের চাইতে অনেক শক্তিশালী।
মৃন্ময় কাগজের প্লেনটা ছোট্ট হাত ছুঁড়ে মারল এক পাশে। আমি রকেট চাই। আমাকে রকেট দাও। এক্ষুণি। নিচের ঠোঁঠ ফুলিয়ে আবদারের সুরে বল্ল ও।
কী আর করা। একটি আইসক্রিমের কাঠির সাথে রবার ব্যান্ডের সাহায্যে একটি বলপেন হালকাভাবে বেঁধে দিলাম। ঐ কলমটাকে রকের মতোই মনে হচ্ছিল তখন। রবার ব্যান্ডটা একটু টান দিয়ে ছেঁড়ে দিতেই সেটা কলমের পেছনে জোরে ধাক্কা দিল আর কলমটাও লাফ দিল সামনে। কাঠিটার এক মাথা নিচু করে ধরে কলমটা ছুঁড়েছিলাম উঁচু মাথা দিয়ে, ফলে সেটা সোজাসুজি উপরে উঠতে উঠতে গোলাকার পথে নেমে এল নিচে অর্থ্যাৎ সোফার ওপর।
হুররে বলে ‘রকেট’ নিয়ে লাফাতে লাফাতে চলে গেল মৃন্ময়। আজ বিকেলে বন্ধুদের আচ্ছা তাক লাগাতে পারবে, এই আনন্দেই ও আত্মহারা।
আচ্ছা মা, প্রথম রকেটের চিন্তাটা বোধ হয় এরকম খেলনা থেকেই এসেছিল। তাই না? তন্ময় প্রশ্ন করে।
অনেক ইতিহাস ঘাঁটাঘাটি করেও এই চিন্তা কার মাথা থেকে বেরুল, কে প্রথম আবিষ্কার করল, কিছুই জানা যায়নি। তবে ২০০০ বছর আগে চীনারা বিয়ে, জন্মদিন এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পটকা ব্যবহার করত।
এই পটকা কেমন হত বলছি। একটি বাঁশের নলের ভেতর গান-পাউডার ভরে শক্তভাবে বেঁধে দেওয়া হত। আগুন লাগাতেই ব্যস, প্রচুণ্ড শব্দ করে বিস্ফোরিত হত। একদিন হয়তো, বিস্ফোরণের বদলে পটকার এক প্রান্ত আস্তে আস্তে পুড়তে লাগল। শেষ-মেষ আঁকা-বাঁকা রেখায় মাটিতে নেমে এল। এটাকে প্রাচীমতম রকেট বলা হয়।
তা হলে মা, প্রাচীন মানুষ নিশ্চয় যুদ্ধে এই রকেটকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত করত?
তা আর বলতে! আগুনে-বোমা হিসেবে কোনো বুদ্ধিমান হয়তো এই প্রাচীন রকেট ব্যবহার করার বুদ্ধি দিয়েছিল। তারপর অনেক যুদ্ধেই এটি রীতিমতো বিস্ময়কর ফলাফল আনতে সাহায্যে করেছে। একটি তারের সাথে এটি বাঁধা হতে, পেছনে একটি পাখির পালক। কিছুদিন পরে অবশ্যই পালক বাদ দেওয়া হয়। এরকম চেহারার যুদ্ধাস্ত্র ত্রয়োদশ শতাব্দীতে চীনারা প্রচুর ব্যবহার করত। অনেক সময় একটি বাক্স কিংবা সিলিন্ডারে ধরিয়ে মুহুমুর্হু আঘাত করা হত। এরকম বাক্স কিংবা সিলিন্ডারে একশ’র বেশি রকট ধরত। কখনো কখনো এদের ডগায় ওরা বিষ মিশিয়ে দিত। অদ্ভুত নাম ছিল এদের । যেমন, ‘শত্রুর যম লম্বা সাপ’ অথবা ‘যুদ্ধের ত্রাস হিংস্র চিতাবাঘ’ ইত্যাদি।
খুব ভয়ংকর ছিল বুঝি ওগুলো?
তন্ময় নিশ্চয় অবাক হচ্ছে হাজার বছর আগেকার যুদ্ধবাজদের ভাণ্ডারের খবর পেয়ে আমি বল্লাম, আরে না, যত গর্জে তত বর্ষে না জানিস তো! এরা শত্রুর মনে যতটা ভয় দেখাত, ক্ষতি তত করতে পারত না। তবুও তখনকার দিনে এটাই ছিল সেরা। কই-ফুচি-ফু শহরের শাম্স কাইয়াং চিন প্রায় ৩০,০০০ মোঙ্গল সৈন্যকে মাসের পর মাস সাগর তীরে আটকে রেখেছিল এই সামান্য প্রাচীন রকেটের সাহায্যে।
বাব্বাহ্!!
এক মাঘে শীত যায় না। মোঙ্গলরা শিখে নিল ব্যাপারটা। অজেয় হয়ে উঠল মোঙ্গল সৈন্যবাহিনী। ১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে বাগদাদ দখলের সময় এবং ১২৭৪ – এ জাপানের সাথে যুদ্ধে ওরাও রকেট ব্যবহার করল। ওরা নিশ্চয় ভাবেনি, এর সাতশ’ বছর পর এই রকেট আর যুদ্ধ-ধ্বংসের কাজে ব্যবহৃত না হয়ে মানুষকে পৌঁছে দেবে চাঁদে, বুধে এমনি শুক্রেও। আরো সাতশ’ বছর পর হয়তো মহাকাশের সব জায়গায় পা ছোঁয়াবে পৃথিবীর মানুষ, সাথে থাকবে রকেট, যার জন্ম কবে তা-ই ঠিক জানা নেই।
ঠিক বলেছিস। মহাকাশবিদ্যার জনক কনস্তান্তিন ত্সিওলভস্কিতর একটি কথা মনে পড়ে পড়েছে আমার। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি প্রজাতন্ত্র, বর্তমানে স্বাধীন দেশ কিরগিজিয়ার একটি গণ্ড গ্রামের নাম বাইকোনুর। এই বাইকোনুর থেকে ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল ইউরি গ্যাগারিন মহাকাশের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তিনি যখন যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন তখন ত্সিওলভস্কি প্রচণ্ড আশা নিয়ে বলে উঠলেন- ‘মানবজাতি চিরদিন এই পৃথিবীর মাটিতে থাকবে না। তবে আলো এবং মহাশূন্যের সন্ধানে প্রথম তারা ভয়ে ভয়ে কেবল বায়ুমণ্ডলের সীমা অতিক্রম করে যাবে, তারপর জয় করবে সৌর-সান্নিধ্যের সমস্ত শূন্য দেশ।’
এই স্বপ্ন আজ সফল হবার পথে- গর্ব আমার ছেলের কন্ঠে।
অথচ জানিস, ১৮৪৮ সালে মস্কোর প্রাদেশিক পত্রিকায় ছোট্ট একটি খবর বেরিয়েছিল-‘চন্দ্রে গমনের বিষয়ে রাজদ্রোহমূলক ভাষণদানের জন্য নিকিফর নিকিতিনকে কিরগিজিয়ার বাইকোনুর গ্রামে নির্বাসনে পাঠানো সিদ্ধান্ত লওয়া হইয়াছে।’
আর এই বাইকোনুর গ্রাম থেকে শুরু হল চন্দ্রে গমনের চেষ্টা। তন্ময় হেসে বলল-মহাকাশ অভিযানের পুরোটাই আমার কাছে সুন্দর সাজানো এক কবিতার মতো মনে হয়। এই গৌরবের অংশীদার তো আমরাও, তাই না মা?
উঠতে হবে। ভাঙ্গা বোয়েমের টুকরোতে আমার ছোট্ট রকে-চালকের কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগে পরিষ্কার করতে হবে সব। পেছনে তন্ময়ের কন্ঠ শুনলাম, চীনা-পটকা এখন মহাশূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কে জানতো এতসব ঘটে যাবে একদিন!
আমি হাসলাম ছেলের দিকে তাকিয়ে। টের পাইনি, কখন যেন খুব মমতা মিশিয়ে মিষ্টি করে হাসতে শুরু করেছে ও।