কানাডার টরেন্টো শহরে বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা। একটি বাঙালি রেস্টুরেন্টে আমরা প্রবাসী কয়েকজন পরিচিত মুখ আড্ডা দিচ্ছি। এর মধ্যে ছিলেন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও চিকিৎসক ডা. সুধীর সেন। সুধীরদা আমাদের সকলের সিনিয়র।
বহু বছর ধরে এই কানাডায় আছেন। বহু সম্পত্তি গড়েছেন। অথচ বিয়ে-টিয়ে কিছুই করেননি। ঘরসংসারহীন বৈরাগী স্বভাবের জীবন তাঁর। তাঁর অতীত জীবন সম্পর্কে আমরা খুব কিছু যে জানি তাও নয়। একবার শুধু বলেছিলেন যে, ৭৫ এ বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরই দেশের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে দেশ ছাড়েন। আফ্রিকায় ছিলেন কিছু দিন। এরপর চলে আসেন কানাডা। ডাক্তারী পেশায় আফ্রিকা গিয়েছিলেন জানতাম। কিন্তু কানাডায় যে কি করে এলেন, তা জানতাম না। আজকে আমরা সে কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি তাঁর নিজের জীবনের সেই অজানা গল্প বলতে রাজি হয়ে গেলেন।
সুধীরদা সিগারেটে একটা টান দিয়ে মুখ দিয়ে আয়েশ করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আমাদের দিকে তাকিয়েই বললেন- ‘ সেই দিনগুলোর কথা আমি এখন আর ইচ্ছা করে স্মরণ করতে চাই না। কিন্তু আপনারা যখন এত করে বলছেন। তখন আর না বলে পারছি না। আমি কানাডা আসি ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে। প্রচুর টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগ করি। তাতে সহজেই ভিসা হয়ে যায়।’
আমি বললাম, বুঝাই যাচ্ছে। আপনি আফ্রিকায় আপনার ডাক্তারী পেশাকে জমিয়ে তুলেছিলেন। খুব রোজগার করেছিলেন নিশ্চয়ই?
তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে জোরে না করতে করতে বললেন – আরে না না! ব্যাপারটা তার ঠিক উল্টো। আফ্রিকার মানুষগুলো তখন এতই গরীব ছিল যে এরা ডাক্তার দেখাতে পারতো না, পারলেও পয়সা দিতে পারতো না। আমাকে যে কতবার উপোস করতে হয়েছিল, ভাবতেও পারবেন না।
আমরা বিস্মিত হয়ে বললাম -‘তাহলে?’
আমাদের সৌরভ দাদা অবশ্য উঠে দাড়িয়ে ব্যাপারটা ধরে ফেলেছেন এমন ভাব নিয়ে বিজ্ঞের মত বললেন – ‘মঁশাই,তাহলে নিশ্চয়ই আপনার দেশে অনেক পৈত্রিক সম্পত্তি ছিল?’
ভদ্রলোক আবারও হাসলেন। বললেন -না, না। তাও নয়। পৈত্রিক সম্পত্তি আমিও এক কড়াও পাইনি৷ সব গেছে ভাই-বোন আর দখলদারদের পেটে! ‘
আমরা নিরাশ হয়ে বললাম -‘ডাক্তারী করে কামাননি, পৈত্রিক সম্পত্তি পাননি। তাহলে অত টাকা পেলেন কোথায়? লটারি পেয়েছিলেন নাকি?’
তিনি সিগারেটটা হাত থেকে রেখে মুখে একটা ভঙ্গিমা এনে চাপা গলায় বললেন -‘অনেকটা এমনই। গোলাপী মুক্তো।পিংক পার্ল!’
আমরা লাফিয়ে উঠে বললাম- ‘হেহ! বলেন কি?’
তিনি নড়েচড়ে বসলেন। ‘সেই গল্পটাই তো আজ আপনাদের বলতে চাচ্ছি। দেখেন বিশ্বাস হয় কিনা। আমার আফ্রিকার প্রথম দিনগুলো কাটে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া৷ তারপর ধীরে ধীরে সেখানে প্রসার কমতে শুরু করলে মুজাম্বিক চলে যাই। অনেক ম্যালেরিয়া রোগীর চিকিৎসা করি। কিন্তু সেখানেও বিপত্তির শেষ নেই। এক ম্যালেরিয়া রোগীর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হলে লোক আমাকেই দায়ী করে। আমার ক্লিনিকে তারা ভাঙ্গচুর করে, ক্লিনিকটা একেবারে ধসিয়ে দেয়। বুঝুন তখন কতটা বিপাকে পড়েছিলাম। আমার পেশা তো সেখানে বন্ধ হলই,সাথে উপোস করেও মরার উপক্রম হল, কারণ কেউ আমাকে আর কোন সাহায্য করতে রাজী ছিল না। তখন একজন ভারতীয় বন্ধুর পরামর্শে মুজাম্বিক ছেড়ে তানজানিয়া গেলাম। সেখানে পৌছতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। শত শত কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছি, কখনও ঘোড়ায় চড়ে, কখনও পায়ে হেঁটে। ভাবতে পারেন, কত পথশ্রম আমাকে সইতে হয়েছে? এরপর তানজানিয়া গিয়ে যে গ্রামে ঘাঁটি গাড়লাম তাকে সভ্যতা-বিবর্জিত বলাই ভালো। আধুনিক দুনিয়ার কোন কিছুই সেখানে নেই। তবে লোকগুলো অনেক ভালো ও সাদাসিধে ছিল। আমাকে খুব খাতির করল। তারা আমাকে পেয়ে অনেক খুশি হয়েছিল,কারণ ওখানে কোন ডাক্তার ছিল না। আফ্রিকার অন্য যেখানেই চিকিৎসা করেছি, এত খাতির যত্ন পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। আমাকে আর দুমুঠো অন্ন আর বাসস্থানের চিন্তা করতে হল না।
একদিন সকালের ঘটনা। এক রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছি, এমন সময় বাইরে একটা ছেলে দরজা ধরে দাড়ালো। বয়স,২৬-২৭ হবে আন্দাজ৷ ভাবসাব দেখে মনে হল সে আমাকে কিছু বলতে চায়। আমি প্রথম দেখায় ভাবলাম, সেও বুঝি আমার পেশেন্ট। তাকে ভেতরে ডাকলাম। সে এলো৷ প্রথমে একটু ইতস্তত করছিল,পরে ভয় কাটিয়ে বলল- তার নাম স্যামুয়েল উসাস৷ সে এই গ্রামেই বাস করে। আমাকে কিছু তার বলার আছে৷ তবে একটু গোপনে বলতে হবে।
এই শুনে আমি ভাবলাম, নিশ্চয়ই তার কোন গোপন রোগ আছে৷ তাই সবার সামনে বলতে চায় না। তাই আমি তাকে নিয়ে ঘরের পেছনে গেলাম৷ সে বলল, ডাক্তার সাহেব আমার কাছে একটা দামী জিনিস আছে। এটা বিক্রি করতে পারলে অনেক টাকা পেতাম। কিন্তু কোথায় বিক্রি করবো, জানি না।
আমি বললাম – জিনিসটা কি?
সে পকেট থেকে একটা ছোট তোয়ালে বের করল। সে তোয়ালে মোড়া ছিল একটা গোলাকার বস্তু। যেই না তোয়ালেটা সরাল অমনি এর উপরে পড়া সূর্যের রশ্মিতে আমার চোখ যেন ঝলসে গেলো।আমি প্রায় চমকে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম।
গোলাপী মুক্তো!
সে আমাকে হতবাক করে দিয়ে আমার হাতে-পায়ে ধরে বসল। বলল,ডাক্তার সাহেব, আমার কোন মা-বাপ নেই।জগৎসংসারে আমার কেউ নেই। আপনি এই জিনিসটা রাখেন। আপনি এটা বিক্রি করে অর্ধেক টাকা আমাকে দিবেন। আর বাকি অর্ধেক আপনার৷
আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, তুমি এটা পেলে কোথায়?
সে ঘামতে ঘামতে বলল,আপনাকে এখন বলতে পারবো না। আরেকদিন বলব।আপনি এটা সাবধান করে রাখবেন। ‘
ডক্টর সুধীর সেন তার কথা থামালেন৷ আমি ফাঁক পেয়ে বললাম, তারপরে আপনি মুক্তোটা নিলেন?
সুধীর সেন মাথা নাড়িয়ে বললেন- ‘না নিয়ে কোন উপায় ছিল না৷ ছেলেটি এত সহজ,সরল ছিল যে তাকে আমি নিরাশ করতে পারিনি৷ তাকে আমি আশ্বস্ত করলাম যে আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব। সে খুশি হয়ে মুক্তোটা আমায় দিয়ে চলে গেলো৷ আমি মুক্তোটা ঘরের সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থানে এনে রেখে দিলাম। এবং ওই দিনই আমি সাউথ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায় আমার পরিচিত কয়েকজনের কাছে চিঠি লিখে রত্নব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করে দিলাম। কিন্তু এরই মধ্যে ঘটে গেল একটি দুর্ঘটনা। যা সব কিছুই ওলট-পালট করে দিল।’
আমাদের সৌরভ দাদা আবারও উত্তেজিত হয়ে বিজ্ঞের মত বলে বসলেন – মঁশাই আপনার পিংক পার্লটি চুরি গেছিল নিশ্চয়ই? ‘
সুধীর সেন হেসে মাথা নাড়িয়ে সে কথা উড়িয়ে দিলেন। ‘আরে না না, তা নয়। স্যামুয়েল উসাস হঠাৎ ডাকাতের হাতে খুন হয়ে গেল৷ গ্রামের মানুষ এসে আমাকে এ খবর দিতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। তারাও হতবাক হয়েছিল, কারণ তারাও বুঝতে পারছিল না যে কেন উসাসের মত একটা হতদরিদ্র ছেলের ঘরে ডাকাত পড়লো, আর তারা তাকে খুন করল। আসল কথা জানতাম কো কেবল আমি। আর সম্ভবত ওই ডাকাতরা। তাদের কাছে নিশ্চিত ওই রত্নের খবর ছিল।
বুঝতেই পারছেন এরপরে আর আমার ওখানে থাকাটা নিরাপদজনক ছিল না। তাই হঠাৎই একদিন কাউকে কিছু না বলে, আমার নেয়ার মত যা কিছু ছিল, সেগুলো নিয়ে, যে পথে যেভাবে এসেছিলাম, সেভাবেই আবার গেলাম মুজাম্বিক। তারপর সাউথ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া। সেখানে পুরনো বন্ধুদের সহায়তায় রত্নব্যবসায়ীদের কাছে গোলাপী মুক্তোটা বেচলাম। ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকের কথা বলছি৷ মুক্তোটা নাকি রেয়ার ছিল। তাই তখনকার দিনেই কত টাকা পেয়েছিলাম জানেন? পুরো দশ কোটি টাকা! ‘
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, বলেন কি?
তিনি গৌরব ভরা কন্ঠে বললেন, ‘আসলে এতটা যে দাম এর তা আমি নিজেও কিন্তু ভাবিনি৷ পরে জেনেছিলাম, এটা যেহেতু ছিল একটা রেয়ার পার্ল, সেহেতু যাচাই-বাছাই করে আরও বড় রত্ন ব্যবসায়ীকে ধরলে হয়তো আরও অনেক বেশি পেতাম। যাক সেকথা। আমার হাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ চলে এল। এত বিপুল টাকা আমি কি করব, নিজেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তখন এক বন্ধুর পরামর্শে আমি কানাডায় বিনিয়োগ করলাম। এরপর সহজেই কানাডায় আশ্রয় হয়ে গেলো। জীবনের যেন মোড়টাই ঘুরে গেলো!’
সৌরভ দাদা ভারাক্রান্ত গলায় বললেন, আপনি উসাস নামক ছোকরাটার ভাগের টাকাও পকেটস্থ করে ফেললেন। এটা কিন্তু ঠিক হল না। আইনের দিক থেকে না হোক, অন্তত বিবেকের দিক থেকে…!
সৌরভ দাদার কথা শেষ হওয়ার আগেই সুধীরদা খেঁকিয়ে উঠলেন -‘না জেনে কোন কথা বলবেন না, বুঝেছেন? উসাসের ভাগের টাকা আমি চেষ্টা করেও পকেটস্থ করতে পারিনি। কানাডায় আসার পরে আমি এক বছর পর্যন্ত শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। প্রায়ই স্বপ্নে উসাস এসে বলতো, সাহেব আমার মুক্তোটা কোথায়? আমার মুক্তো ফেরত দিন! ‘
আমি বললাম,বুঝো ঠেলা!
‘উসাসের কোন আত্নীয়-স্বজন ছিল না, সেটা আমি আগেই বলেছি। সে খ্রিষ্টধর্মের ছিল। তাই তার ভাগের ৫ কোটি টাকা আমি বিনিয়োগ থেকে উইথড্র করে কিছু দান করলাম, গির্জায়, কিছু অনাথ আশ্রমে। আর কিছু অন্যান্য চ্যারিটি ফান্ডে৷’
আমি বললাম, এরপর উসাস আর স্বপ্নে দেখা দিয়েছিল কি?
সুধীর সেন বললেন, হ্যা। মাত্র একবার। এবং সেটাই শেষ দেখা। আমি দেখলাম, সে একটা খোলা মাঠে বিশাল এক গাছের নিচে দাড়িয়ে আছে৷ আমাকে দেখে হাসছে। তারপর শান্ত ভঙ্গিতে পেছন ফিরে হাঁটতে হাঁটতে কুয়াশার ভেতর হারিয়ে গেল।
- আমি তার পেছনে পেছনে ছুটলাম। কিন্তু কোনভাবেই ও কুয়াশার ভেতর ঢুকতে পারলাম না। এরপর আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলো৷ আমি বিছানায় বসে অনেকক্ষণ তার কথা স্মরণ করে কাঁদলাম।এরপর আর কখনও তাকে স্বপ্নে দেখিনি৷ আজকে ২০ বছর হয়ে গেল। ‘
সুধীর সেন উঠে দাড়ালেন৷ আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু আমরা কেউই উঠলাম না। গল্পের মোহ যেন আমাদের এখনও কাটেনি।