Cheap price backlink from grathor: info@grathor.com

রাজধানীর নতুন বিড়ম্বনা. রাইড শেয়ারিং ‘কই যাইবেন’!

যানজটে নাকাল রাজধানীতে দ্রুততম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে মোটর বাইকের জুড়ি নেই। ২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে ঢাকায় অ্যাপ ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা চালু হওয়ার পর জনপ্রিয় হয়ে ওঠতে খুব বেশি দিন লাগেনি। শুরুতে প্রযুক্তিভিত্তিক এই পরিবহন সেবায় যুক্ত হয় শিক্ষিত পেশাজীবীরা, বেশিরভাগ রাইডারই পার্টটাইম ভিত্তিতে বাইক চালাতেন। নগরজীবনে এটি ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ায় এবং লাভজনক হয়ে ওঠায় ফুলটাইম রাইড শেয়ারিং শুরু করেন। তরুণপ্রজন্মের বেকারত্বের জ্বালা এড়ানোর অন্যতম অবলম্বন হয়ে ওঠে এটি। পাঠাও, উবার, ওভাই, সহজ ইত্যাদি অ্যাপে যুক্ত হতে থাকে শত শত বাইকার। আর এটা তো বাঙালির চিরন্তন অভ্যাস কোনো কিছু লাভজনক দেখলেই সদলে হামলে পড়া, রাইড শেয়ারিংয়েও তাই হলো।

একটা সময় অ্যাপে রাইড রিকোয়েস্টের তুলনায় চালকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় রাইডাররা শুরু করে দিল অ্যাপ ছাড়াই রাস্তা থেকে দরকষাকষি করে বাইকে যাত্রী ওঠানো। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ঘর থেকে মোড়ের দোকানে যাবেন, একাধিক রাইডার আপনার পথ আগলে বলবে ‘কই যাইবেন?’ নগরীতে এ এক নতুন বিড়ম্বনা। যাত্রী নিয়ে টানাটানি, বাইক চালনায় অদক্ষতা. বেপরোয়া গতি, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে মোটর সাইকেল নিয়ে দাঁডিয়ে থেকে রাইডাররা তৈরি করছে যানজট। অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা এখন হুমকির মুখোমুখি।

রাইডাররা এখন অ্যাপ রেখে ‘খ্যাপে’ ঝুঁকেছে। চুক্তিতে গন্তব্যে যাত্রী পৌঁছে দেয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে, যা দিন দিন বাড়ছে। এতে বাড়ছে নানারকম হয়রানি ও নিরাপত্তার ঝুঁকি। কোনো নির্জন স্থানে নিয়ে চালক যেমন যাত্রীর ক্ষতি করতে পারে, তেমনি চালকও যাত্রীর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে কারণ অ্যাপ ছাড়া যাত্রী তোলায় কে উঠছে সেই তথ্য থাকছে না কোথাও। ভাড়াও গুনতে হচ্ছে বেশি। তার ওপর যাত্রী পছন্দের গন্তব্যে পৌঁছাতেও আপত্তি থাকে চালকদের।

ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ডাকাডাকি করে বাইকে যাত্রী ওঠানো রাইডারদের মাঝে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ জুড়ে ব্যাক্তিগত উদ্যোগে এক জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, এদের ১০ জনের মধ্যে ৭ জনই রাইড শেয়ারিংয়ের কোনো অ্যাপ ব্যবহার করছেন না। অ্যাপ ছাড়া বাইকে যাত্রী পরিবহন আগে স্বল্প সংখ্যায় চালু খাকলে তা ব্যাপকতা পেয়েছে করোনাকালীন সময়ে। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে গত ২৬ মার্চ থেকে প্রায় পাঁচ মাস রাইড শেয়ারিং বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। স্থগিত রাখা হয় অ্যাপসগুলোর কার্যক্রম। তবে বিআরটিএ নির্দেশনা অমান্য করেই ওই সময় রাজধানীতে বাইক চলেছে, করোনাকালে মানবিক কারণে এটা উপেক্ষা করে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। ওই সময়কার দরকষাকষি করে যাত্রী ওঠানোর অভ্যাসই হালে রাইড শেয়ারিংয়ের প্রধান মাধ্যমে পরিনত হয়েছে।

গত সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বিআরটিএ স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে মোটর বাইক রাইড শেয়ারিং সেবা চালুর অনুমতি দেয়। ঘোষণা করা হয়, কেবলমাত্র এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট থাকা সাপেক্ষে বাইকে শেয়ার করা যাবে রাইড। সেই অনুযায়ী এনলিস্টমেন্ট নিবন্ধন থাকা মাত্র এক হাজার ১৫৬টি মোটর সাইকেলকে রাইড শেয়ার করার জন্য অনুমতি দিয়েছে বিআরটিএ। অথচ রাজধানীতে রাইড শেয়ারিং বাইক চলে দুই লাখেরও বেশি বেশি।

করোনাকালীন কর্মহীন হয়ে পড়ে শত শত নতুন বাইকার রাইড শেয়ারিংয়ে যুক্ত হচ্ছে। তবে শিক্ষিত রাইডারদের তুলনায় শেয়ারিংয়ে বেড়ে গেছে এখন অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত চালকের বিচরণ। তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে গতানুগতিক পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকরণের জন্য প্রবর্তিত রাইড শেয়ারিংকে মান নামিয়ে এনেছে। অ্যাপভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে খ্যাপে রাইড শেয়ারে এরা বেশি মনোযোগী। মফস্বল থেকে আসা একশ্রেনীর রাইডার রাজধানীর অচেনা রাস্তায় যাত্রীদের ফেলছে বিড়ম্ব্নায়। পাঠাও, উবার বা ওভাইয়ের মতো রাইড শেয়ারিং কোম্পানীর সঙ্গে যুক্ত না হয়ে অনভ্যস্থ রাস্তায় বেপরোয়া বাইক চালিয়ে ও ট্রাফিক আইন অমান্য করে রাজধানীর রাস্তায় তৈরি করছে নিত্য নতুন সমস্যা।

বাইকারদের বেপরোয়া হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ, সময় বাঁচিয়ে কত বেশি ভাড়া পাওয়া যায়। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, এসব অ্যাপভিত্তিক মোটর সাইকেলের বেশিরভাগই রাজধানীর বাইরে দেশের বিভিন্ন জেলা এমনকি গ্রাম থেকে আসছে। যারা এসব মোটর বাইক চালায়, তারা নিজেদের এলাকায় যেভাবে বেপরোয়া মনোভাব নিয়ে চালাত, রাজধানীতে এসেও একইভাবে চালাচ্ছে। তারা এটা বুঝতে পারে না, মফস্বল শহর বা গ্রামে মোটর সাইকেল চালানো আর রাজধানীতে চালানো এক কথা নয়।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের গত আগস্ট মাসের পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, গত আগস্ট মাসে ৩০২টি দুর্ঘটনার মধ্যে ১২১টিই ঘটেছে মোটর সাইকেলের কারণে। গত বছর সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় জড়িত যানবাহনের মধ্যে মোটর বাইক ছিল দ্বিতীয়। ফলে মোটর চালিত এই দ্বিচক্র যানটি এখন ‘মরণযান’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বিআরটিএ-এর হিসাব মতে, সারাদেশে নিবন্ধিত ৪৪ লাখ ৭১ হাজার যানবাহনের মধ্যে ২৯ লাখ ৯১ হাজারই মোটর সাইকেল। এর মধ্যে ২৫ শতাংশই ঢাকায় চলাচল করে। ২০১৯ সালে সাড়ে তিন লাখ মোটরবাইক বিক্রি হয়েছে। প্রতিদিন ঢাকায় নিবন্ধিত হচ্ছে ৪১৫টি বাইক। ভাড়ায় চালনার সুযোগ থাকায় মোটর বাইকের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছেই।

রাজধানীকে একসময় রিক্সার শহর বলা হতো, ঢাকা এখন বাইকের শহরে পরিনত হয়েছে। রাইড শেয়ারিংয়ে হয়ে সারাদেশ থেকে হাজার হাজার বাইকার রাজধানীতে ভীড় করছে। একদিকে ঢাকায় কর্মজীবীদের যানবাহন সংকট অন্যদিকে সারাদেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত লাখ লাখ বেকার তরুণ স্বাধীন কর্মসংস্থানের সহজ উপায় হিসেবে যেনতেন একটি মোটরবাইক নিয়ে রাইড শেয়ারিংয়ে যুক্ত হয়ে পড়ছে। মোটর সাইকেলের এই দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি দুর্ঘটনার হারও বাড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকায় যানজটের দুর্ভোগ থাকলেও ব্যক্তিগত বাইক চালকদের দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার ঘটনা খুব কমই ঘটে। রাইড শেয়ারিং বাইকারদের সমাগম বৃদ্ধির পর থেকে গত দুই বছরে রাইড শেয়ারিংয়ে বেশ কিছু মানুষ হতাহত হয়েছে। রাইড শেয়ারিংয়ে থাকা অনভ্যস্থ বেপরোয়া বাইক চালনার কারণে প্রায়শ: ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে আরোহীরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়কে মোটর বাইক এবং পথচারীরা সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ। তারাই বেশি দুর্ঘটনার শিকার হয়। যত বেশি মোটর বাইক বৃদ্ধি পাবে, দুর্ঘটনার হারও তত বেশি হবে। এখন সবকিছু খুলে যাওয়ায় দুর্ঘটনাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।

মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলতে হবে, এই অবাস্তব ধারণা সমর্থন করা যায় না। অন্তত কয়েক লাখ রাইডারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তাদের পরিবারসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২০ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকার ব্যবস্থা এবং তীব্র আয়-বৈষম্য কমানোতে অবদান রাখা রাইড শেয়ারিংয়ের বিরুদ্ধে আমরা নই। নগরবাসীর দাবি বেপরোয়াভাবে চালিত মোটরবাইক নিয়ন্ত্রণ, আর এই নিয়ন্ত্রণেই স্বার্থেই অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং ছাড়া খ্যাপে চালিত বাইক বন্ধ করা।বিআরটিএ’র উচিত বাইক রাইডারদের লাইসেন্স দেয়ার আগে তাদের দক্ষতা ভালোভাবে পরীক্ষা করা। রাজধানীর বাইরে থেকে আসা মোটর বাইক নিয়ন্ত্রণ ও নিরুৎসাহী করাটাও জরুরি। রোড সেফটি নিয়ে যেসব সংস্থা কাজ করছে, তাদের উচিত ভাড়ায় চালিত মোটর বাইক চালকদের নিয়ে ওয়ার্কশপের আয়োজন করা। তাদের বোঝাতে হবে, জীবিকার কারণে বেপরোয়া বাইক চালিয়ে জীবন হারানোর চেয়ে সুশৃঙ্খলভাবে চালিয়ে জীবিকা অর্জন অনেক বেশি দামি।#

Related Posts

8 Comments

Leave a Reply

Press OK to receive new updates from Firstsheba OK No