ভূমিকা:
ছাত্র জীবন হলো মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জীবনের এই সময়ে আমরা নিজেদের চরিত্রকে ইচ্ছেমতন গড়ে তোলার সুযোগ পাই। মানুষের জীবনের জ্ঞান লাভের প্রক্রিয়া সমগ্র জীবনব্যাপী চললেও, মানুষ হিসেবে নিজের চরিত্রকে গড়ে তোলার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ জীবনে এই সময়েই হয়ে থাকে। শিক্ষা জীবনের অর্থ শুধুমাত্র বইয়ের পাতায় কিংবা বিদ্যালয়ের চৌহদ্দির মধ্যে আবদ্ধ শিক্ষা নয়।
ছাত্রজীবনের শিক্ষা হওয়া উচিত ব্যাপক এবং বিস্তৃত। তবেই শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য সার্থক হয়ে থাকে। ছাত্রজীবনের শিক্ষার এই বহুমুখী চরিত্রের মধ্যে জীবনের প্রতিটি দিকের সঙ্গে আমাদের পরিচিতি হওয়া আবশ্যক। সেই প্রাথমিক জীবন দর্শন এর মাধ্যমে একজন ছাত্রের চরিত্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ছাত্রজীবনে শিক্ষামূলক সফরের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আমাদের বিদ্যালয় থেকেও এই বছর এমনই একটি শিক্ষা সফর আয়োজিত হয়েছিল। সেই শিক্ষা সফরটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং সেই সফর থেকে লাভ করা আমাদের শিক্ষামূলক উপলব্ধির ওপর আলোকপাত করার উদ্দেশ্যেই এই উপস্থাপনা।
শিক্ষা সফরের তাৎপর্য:
আমাদের এই বছরের শিক্ষা সফর সম্পর্কে আলোকপাত করার পূর্বে মানুষ বিশেষত ছাত্রদের জীবনে শিক্ষাসফরের বাহ্যিক তাৎপর্য সম্বন্ধে আলোচনা করা প্রয়োজন। একটি শিক্ষা সফর একজন ছাত্রের সাথে বিদ্যালয়ের গণ্ডির বাইরের পৃথিবীর পরিচিতি ঘটায়। এই পরিচিতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সাথে বিশ্বপ্রকৃতির যে সংযোগ গড়ে ওঠে তা তার চরিত্র গঠনে সহায়তা করে।
তাছাড়া একজন ছাত্রের শখ, ভবিষ্যতের পেশা এবং আত্মপ্রতিভামুলক দিকনির্দেশ নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও শিক্ষা সফরের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিক্ষার্থী একটি যথাযথ শিক্ষা সফরে গিয়ে যা শেখে তা শিক্ষাঙ্গনের পুঁথিতে আবদ্ধ বিদ্যা তাকে শেখাতে পারে না। শিক্ষামূলক সফরে গিয়ে একজন ছাত্র সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, পরিবেশ তথা স্থানীয় মানুষের দৈনিক জীবন সম্পর্কে পরিচিতি লাভ করতে পারে। তাই শিক্ষা সফর থেকে লব্ধ উপলব্ধি একজন ছাত্রের সমগ্র জীবনে বিশেষ প্রভাব রেখে যেতে সক্ষম হয়।
আমাদের শিক্ষা সফর:
আমাদের বিদ্যালয় শিক্ষা সফর এই বছরই নতুন নয়। ইতিপূর্বেও অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন বিদ্যালয় থেকে আমাদের শিক্ষা সফরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই সময় মূলত ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের দিকে নজর দেওয়া হলেও এবারের সফরে ছাত্র-ছাত্রীর সার্বিক বিকাশ মুলক ভ্রমণের দিকে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
একটি শিক্ষা সফরের দ্বারা একজন শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশ তখনই সম্ভব যখন সেই সফরের বহুমুখী তাৎপর্য থাকে। তাই সব দিক বিচার করে এই বছর আমাদের বিদ্যালয় কতৃর্পক্ষের তরফ থেকে সুন্দরবনকে আমাদের শিক্ষা সফরের জন্য সংশ্লিষ্ট স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল।
স্থান নির্বাচনের কারণ:
সুন্দরবনকে আমাদের শিক্ষা সফরের জন্য নির্বাচন করার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ বিদ্যমান। এই কারণগুলির সম্বন্ধে আমরা আমাদের শিক্ষকমন্ডলীর থেকে জানতে পেরেছি। এইবারের শিক্ষা সফরের জন্য স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম মাথায় রাখা হয়েছিল শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশের কথা। শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশের জন্য সফরের স্থানটির বহুমুখী গুরুত্ব থাকা প্রয়োজন।
সেই দিক থেকে দেখতে গেলে সুন্দরবন একদিকে যেমন ভূ-প্রকৃতির দিক থেকেও অনন্য, অন্যদিক থেকে আবার উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের বিবিধ বৈচিত্রের ব্যাপারেও সুন্দরবনের জুড়ি মেলা ভার। তাছাড়া জলপথে শিক্ষামূলক ভ্রমণের যে উপাদেয় অভিজ্ঞতা সুন্দরবনে লাভ করা সম্ভব, তা সম্ভবত দেশের অন্য কোথাও সম্ভব নয়। সেজন্য আমাদের এবছরের শিক্ষা সফরের পক্ষে সুন্দরবন অপেক্ষা অধিক উপযুক্ত স্থান আর কি বা হতে পারত।
যাত্রাপথ এবং ভ্রমণ পরিকল্পনা:
আমাদের বিদ্যালয় থেকে একাদশ শ্রেণীর মোট ৪২ জন ছাত্র সুন্দরবনের শিক্ষাসফরে যাওয়ার জন্য নাম নথিভুক্ত করেছিল। আমাদের সঙ্গে আরো ১০ জন শিক্ষকের যাওয়ার জন্য একটি বাস ভাড়া করা হয়েছিল। বিগত অক্টোবর মাসের ১২ তারিখ রাত ন’টা নাগাদ আমরা সকলে বাসটিতে করে সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। পরের দিন ভোরবেলা খুলনা জেলার বাগেরহাট হয় আমাদের বাস পৌঁছায় মংলাতে।
সেইখান থেকে লঞ্চে করে যাওয়া হয় সুন্দরবন। যাবার পথেই আমাদের শিক্ষকরা সমগ্র ভ্রমণ পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে সবাইকে বুঝিয়ে দেন। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল জামতলা সৈকত। সেখান থেকে হিরণ পয়েন্ট হয়ে কটকা বিচ। মধ্যিখানে পড়বে মান্দারবাড়িয়া সৈকত। মোট চারটি রাতের সফর পরিকল্পনা।
ভূপ্রকৃতি সম্বন্ধিত জ্ঞানলাভ:
মংলা থেকে লঞ্চে করে সুন্দরবন রওনা হওয়ার পর থেকেই একটু একটু করে অনুভূত হতে থাকে সুন্দরবনের শোভা। সেইসঙ্গে আমাদের শিক্ষকেরাও সকলের কাছে সুন্দরবনের ভূপ্রকৃতি এবং তার প্রভাব সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে থাকেন। তাদের কাছে আমরা জানতে পারি সুন্দরবন হলো পৃথিবীর সবথেকে বড় লবণাক্ত বনাঞ্চল।
১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে সুবিস্তৃত এই অরণ্য ভারত এবং বাংলাদেশ এই দুই দেশের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা, এবং বাংলাদেশ খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার অংশ নিয়ে গঠিত এই সুন্দরবন। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছিল।
বাংলাদেশের সুন্দরবনের ১৮৭৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অপূর্ব মনোরম নদী-নালা তথা জনাকীর্ণ অঞ্চল। তাছাড়া প্রায় সমগ্র সুন্দরবনই ঘন বনাঞ্চল দ্বারা আবৃত। এখানকার মাটি স্বভাবগতভাবেই লবণাক্ত এবং খানিকটা দক্ষিনে অগ্রসর হলেই মিলবে বঙ্গোপসাগরের সীমানা। ভূ-প্রকৃতিগত এমন অবস্থানের কারণেই সুন্দরবন অঞ্চল বিভিন্ন স্থলচর ও জলচর পশুপাখির স্বর্গ বলে বিবেচিত হয়।
অরণ্যানী পরিদর্শন:
মংলা থেকে সুন্দরবনের দিকে প্রাথমিক পর্বেই যা চোখে পড়ে তাহলে অরন্যের বিপুল বাহার। আমাদের পরিবেশ বিজ্ঞানের শিক্ষক বললেন সুন্দরবনের প্রায় ৩৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যায়। তার মধ্যে বেশকিছু আবার দুষ্প্রাপ্য। মাটিতে লবণের ভাগ বেশি থাকার কারণে এখানকার উদ্ভিদের সিংহভাগই ম্যানগ্রোভ প্রজাতির। তবে যে গাছটি এখানে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে তা হল সুন্দরী গাছ।
এই গাছটির নামেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছিল বলে মনে করা হয়। তাছাড়া এখানকার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গাছগুলির মধ্যে চোখে পড়ল গরান, গেওয়া এবং বিখ্যাত গোলপাতা গাছ। ঘন অরণ্যানীর ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করা সূর্যের আলোয় দেখা গেল ধুন্দুল ও কেওড়া গাছ, শন, নলখাগড়া ইত্যাদি। আমাদের শিক্ষকরা বুঝিয়ে দিলেন ঘন অরণ্য একদিকে যেমন সুন্দরবনের প্রাথমিক বনজ চরিত্র, অন্যদিকে আবার এই অরণ্যই সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য জীব বৈচিত্রের জন্য পটভূমি রচনা করে।
বন্যপ্রাণী পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা:
অরণ্য পরিদর্শনের ফাঁকে ফাঁকেই মাঝেমধ্যে চোখে পড়ছিল রংবেরঙের নাম না জানা নানা পাখি, দু একটা হরিণ, গাছে ঝুলতে থাকা মৌচাক ইত্যাদি। আমাদের শিক্ষকেরা নিজেদের সাধ্যমতন পাখিগুলির ব্যাপারে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন। এরই মধ্যে একটি হরিণ চোখে পড়ায় শিক্ষকদের থেকে আমরা জানতে পারি এটি হলো সুন্দরবনের বিখ্যাত চিত্রা হরিণ।
এরপর একটি ছোট সৈকতের টাওয়ার থেকে সুন্দরবনের সৌন্দর্য পরিদর্শনের সময় হঠাৎ দেখা মেলে বহু আকাঙ্খিত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। যদিও তারপরে আরো একবার বেঙ্গল টাইগারের দেখা মিলেছিল। বাঘ দেখার সেই অনুভূতি জীবনে কখনো ভোলার নয়। এছাড়া ভ্রমণের সময় নানা ধরনের নাম-না-জানা প্রাণী, সাপ, গিরগিটি ইত্যাদির সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে।
জলজ প্রাণীদের সঙ্গে পরিচিতি:
তৃতীয় দিন শুরু হয় জলপথে আমাদের সুন্দরবন ভ্রমণ। শিক্ষকরা আমাদের বলেন সুন্দরবনের স্থলভাগের সাথে সাথে জলভাগেও ব্যাপক জীব বৈচিত্র দেখা যায়। নদীর মোহনা অত্যন্ত কাছাকাছি হওয়ায় প্রায় ৩০০ প্রজাতির শিরদাঁড়াযুক্ত মাছ, ১২ প্রজাতির কাঁকড়া ও চিংড়ি, বিভিন্ন ধরনের শামুক এবং ৮ প্রকারের উভচর প্রাণীর অস্তিত্ব সুন্দরবনে পাওয়া গেছে।
এর মধ্যেই লঞ্চ থেকে চোখে পড়ল গাঙ্গেয় ডলফিন বা শুশুকের আনাগোনা। স্থানীয় গাইডের কাছ থেকে আমরা জানতে পারলাম সম্প্রতি ক্রমবর্ধমান দূষণ এবং অন্যান্য কারণে সুন্দরবনের জলভাগে মাছের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কমে এসেছে। লঞ্চ থেকে শিক্ষকরা আমাদের দেখালেন দূরে নদীর পাড়ে কাদার উপর রোদ পোহাচ্ছে সুন্দরবনের বিখ্যাত কুমির। তারপর লঞ্চের মাধ্যমে কটকা বিচে পৌঁছে চোখে পড়ল অসংখ্য লাল কাঁকড়া।
স্থানীয় জীবনে একদিন:
ভ্রমণের চতুর্থ অর্থাৎ শেষ দিন আমরা সুন্দরবনের স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে সময় কাটালাম। অদ্ভুত সরল মনের স্থানীয় অধিবাসীরা আমাদেরকে নিজেদের দায়িত্বে ঘুরিয়ে দেখান তাদের গ্রাম, জঙ্গল, ক্ষেত ইত্যাদি। এখানেই তাদের সাথে আমরা প্রথম দেখতে পেলাম মৌচাক ভেঙে মধু সংগ্রহ করার পদ্ধতি।
এই সময় শিক্ষকদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারলাম এখানকার মানুষ খাদ্য, আশ্রয় তথা অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণরূপে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। সে কারণে জঙ্গলকে এখানকার স্থানীয় মানুষেরা বনবিবি রপে পূজা করে। এদের দেখে আমরা শিখলাম সমগ্র পৃথিবী আধুনিকতার দিকে এগিয়ে গেলেও এরা এখনও প্রকৃতির ওপর প্রাগৈতিহাসিক নির্ভরশীলতার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা খুঁজে নেয়।
উপসংহার:
এইভাবে স্থানীয় জীবনে চতুর্থ দিন কাটিয়ে পঞ্চম দিন বিকেলে আমরা ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। শিক্ষা সফরের এই অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনে যে কতটা অভূতপূর্ব ছিল তা বলে বোঝানো যাবে না। সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্য, ব্যাপক জীব বৈচিত্রের শোভা এবং বন্ধু ও শিক্ষকদের সাথে এতগুলো দিন একসাথে কাটিয়ে আমাদের মন এক অদ্ভুত পূর্ণতায় ভরে উঠেছিল।
এখানেই আমি জীবনের প্রথম জলপথে ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছিলাম। জীবন ও প্রকৃতির একটি সম্পূর্ণ অন্যরকম দিক এই সফরের ফলে আমাদের কাছে উন্মোচিত হলো। শিক্ষকরা ফেরার পথে আমাদের আশ্বাস দিলেন, আগামী বছর এরকমই আরেকটি শিক্ষা সফর আমাদের বিদ্যালয় থেকে আয়োজিত হবে।