সমাজ,সংসার,সামাজিক,পারিবারিক শিক্ষা বদলে দিতে পারে কিছু মানুষের জীবন। সমাজকে করতে পারে অভিশাপ মুক্ত।আমার আজকের এ লেখায় দু’টো জীবনের তুলনামূলক আলোচনা করে বুঝিয়ে দিতে চাইব কিছু সত্য। এ লেখাটা পড়ে যদি একজন মানুষের ও মনের পরিবর্তন হয় তাহলে বুঝব পরিবর্তনের চিন্তা মানুষের মধ্যে আছে ,আর আছে বলেই আমাদের বিশ্বকে আমরা আমাদের মতো করে সাজিয়ে নিতে পারবো।
রূপে গুণে মেধায় কিছুতেই কম ছিলনা শেফালি। ছোটবেলা থেকেই তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ রবিউল। শেফালির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা থাকার পরও মুখ ফুটে বলতে পারেনি কারণ সে গরীব।মনের কথা মনেই রয়ে গেল। সবার পছন্দের পাত্রের সাথে শেফালির বিয়ে ঠিক হলো।
খুব ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করতে হবে ,না হয় দুই পরিবারের সম্মান ক্ষুন্ন হবে। বিয়ের পাত্রী পুতুল সেজে বসে রইল। ভাবী,বান্ধবী,শালী সহ শ খানিক পছন্দের মহিলার উষ্ণ অভ্যর্থনায় ধন্য হলো হিরো জামাই জলিল। তার হিরোগিরী কানায় কানায় পূর্ণ করে বিয়ে করে নিয়ে আসল শেফালিকে । না তার হিরোগিরী শেফালির জন্য নয়। শত নারীর কল্পনায় বিভোর জলিলের জন্য শেফালি শুধু ব্যবহারের পাত্রী।
বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে শশুর বাড়ির সবাই বুঝতে পারে এই বউকে তারা যেভাবে ইচ্ছা চালালে কোন সমস্যা নেই। শশুর বাড়িতে জলিলের মূল্য তোলা তোলা। শেফালির এতটা মূল্য বাবার বাড়ি থেকে কেউ বোঝাতে আসেনি। তাই সবার প্রয়োজন শেষ হলে শেফালির জগতে চোখের পানিই শুধু সাথী হয়।
শশুর বাড়ি যাওয়ার সময় দুই হাত ভরে কত কিছু নেয় জলিল। শেফালি খুশি হয় কিন্তু তার খুশির তোয়াক্কা জলিল করেনা। জলিলের উদ্দেশ্য হিরোগিরী দেখাতে হবে। বাবার বাড়ি এসে বাবার সংসার আর ছোট ভাই বোনদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে শেফালি। তাদের খাওয়া দাওয়া,লেখাপড়া এসব নিয়েই তো দিন রাত ভেবে ভেবে বেঁচে আছে সে। শেফালি সবাইকে নিয়ে কাজে ব্যস্ত আর জলিল ব্যস্ত তার হিরোগিরী কানায় কানায় পূর্ণ করাতে।
শশুর বাড়ি এসেও শেফালির চিন্তার শেষ থাকেনা ভাই বোনদের নিয়ে। কখন যে ওরা বড় হবে,কখন ওদের লেখা পড়া শেষ হবে। এদিকে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রটা শেফালিকে সংসারের সাথে আরও ভালো করে বেঁধে দেয় শক্ত করে। ছেলে মেয়ের মা হয় শেফালি। এ সংসার যেন শেফালির প্রাণ কেননা এখানে তার প্রাণের সন্তান আছে। মরুভূমিতে ফসল ফললেও এ ফসল যে কত কষ্টের তা শেফালিই শুধু বোঝে।
সন্তান মানুষ করার জন্য যখন শেফালি যুদ্ধ করছে ঠিক তখনি জলিল বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে দিল শেফালিকে সে আর এভাবেও চায়না। বিভিন্ন কৌশলে ছেলে মেয়ে এবং আত্মীয় স্বজনকে বোঝাতে সক্ষম হল শেফালির চরিত্র খারাপ।সব মেনে নিলেও এটা মানতে আত্ম সম্মানে বাঁধে শেফালির। তাই গোপনে বাবার বাড়িতে গিয়ে সেখানে থাকার ব্যাপারে কথা তুলতেই শেফালি বুঝতে পারে বাস্তবতা। তার ভাইয়েরা পরিস্কার জানিয়ে দেয়, বোনের চেয়ে দুলাভাইয়ের সম্মান তাদের কাছে বেশি। বাবার বাড়িতে শেফালির কোন অধিকার নেই।শশুর বাড়ি,স্বামীর সংসারই শেফালির আসল ঠিকানা।বাবার বাড়িতে একবেলা খাওয়ার চিন্তা ও সে যেন না করে। ভাইদের সংসার হয়েছে। বউ ছেলে মেয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর তারা আবার শেফালির দায়িত্ব নিবে,প্রশ্নই আসে না। নিজের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য হাত খরচের টাকা জমিয়ে রাখতো শেফালি। নিজে কষ্ট করতো তবু টাকা গুলো রেখে দিত। ভাইদেরকে দেখলেই আঁচলের গিট থেকে টাকা গুলো হাতে গুঁজে দিয়ে আনন্দে হাসতো শেফালি। সে ভাইয়েরাই আজকে বলছে তার একবেলা খাওয়ার দায়িত্ব ওরা নিতে পারবে না। চরম ভাবে অপমান বোধ করে চোখ মুছতে মুছতে বের হয়ে গেল। তারই কিছু মেয়ে রক্ত তাকে বুঝিয়ে দিল জলিল কতো ভালো ছেলে। জলিলের জীবন থেকে শেফালি চলে গেলে তাদের রাস্তা পরিষ্কার হবে। এ লজ্জা শেফালি রাখবে কোথায়। সে যেন আর কষ্টের , লজ্জার ভার বইতে পারছে না।
ফিরে যায় জলিলের সংসারে। জলিল বুঝতে পারে শেফালি সব জায়গায় অবহেলিত। সে এবার খেলবে ফাইনাল খেলা। শেফালিকে ঘর থেকে সোজা বের করে দেয়। কোথায় যাবে শেফালি। সে তো বাবার বাড়ি স্বামীর সংসার ছাড়া কিছুই চিনে না। বাবার বাড়িতে তার অবস্থান বুঝেও বাধ্য হয়ে যায় সেখানে। বেশি দিন সে তাদের দেয়া কষ্ট সহ্য করতে হয়নি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মানসিক ভারসাম্য হারায় শেফালি। অনাদর ,অবহেলা,বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকে একটা ছোট্ট রুমে।
জলিল একেবারে মুক্ত। বাবা মা ও মারা গেছে। তাকে বাঁধা দেওয়ার কেউ নেই। হাজার নারীর কাছে ঘুরে বেড়ায় জলিল,কিন্তু বেশিদিন পারেনা। কি সব এইডস না কি রোগের ভয়। আবার একটা বৈধ সম্পর্ক দরকার। না এবার সে নিজের ইচ্ছা মতো বউ পছন্দ করবে। তার পছন্দের রং মাখানো রাস্তায় ঢং দেখানো একটা মেয়েকেই আনতে হবে। শেফালিদের বাড়ির দিকে ভুলেও তাকায় না সে কারণ সেখানে পাগলী শেফালি আছে। সেখানকার অপক্ষেমাণ তালিকা বাদ দিয়ে পছন্দ মতো বিয়ে করে নেয় জলিল। বিয়ের এক সপ্তাহ পর শুনতে পায় আপদটা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে।খুশি হয় জলিল। খুশি হয়না শুধু একজন । রাতের অন্ধকারে শেফালির কবরে এসে কাঁদে রবিউল।
একদিন সকাল বেলা ঘর থেকে বের হয়ে জলিল চলে আসে শেফালিদের গ্রামে। পাগলের মতো খুঁজতে থাকে শেফালির কবর। কবরে মাথা রেখে চিৎকার করে বলতে থাকে সে ভুল করেছে। তার বিয়ে করা বউ তাকে নরক যন্ত্রণায় রেখেছে। রং মাখানো ঢং দেখানো রাস্তার মেয়েটার ১৮ পুরুষের সাথে সম্পর্ক। জলিলকে সে জানিয়ে দিয়েছে সে শেফালি না। তার দিকে শেফালির মতো করে তাকালে জলিলের চোখ তুলে হাসপাতালে দান করে দিবে। ভয়ে দিশাহারা জলিল। শেফালির যত্নে গড়া সন্তান গুলো নষ্ট হয়ে গেছে। জলিল শেফালিকে ডাকে। শেফালি সাড়া দেয় না। অসহায় জলিল জীবনে এবার প্রথমবারের মতো একা চলে যায়। শেফালি আর কোনদিন যাবে না। কবর তার স্থায়ী দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। শেফালি আর কোথাও যেতে হবে না। এবার শেফালির আত্মা হাসতে থাকে। শেফালি কবর থেকে দেখে তার বাবার পরিবারে কতগুলো শেফালি বউ। কতগুলো শেফালি মেয়ের জন্ম হয়েছে। জলিল হিরোর যত নায়িকা শেফালিকে আঘাত করেছে সবার ঘরেই এখন অনেক শেফালির বসবাস। শেফালির আত্মা হাসে ,দুনিয়া কাঁপিয়ে হাসে। হাসিতে ভয় পায় রবিউল। রাতের অন্ধকারে শেফালির কবরে গিয়ে সে শুনতে পায়, জীবনে যাকে বলতে পারলি না কিছু কবরে তাকে মালা দিবি আয়। ভয়ে পালিয়ে যায় রবিউল।
নিজেকে শেফালির মতো মনে হচ্ছে? বা আশে পাশে অনেক শেফালিকে দেখতে পাচ্ছেন? পড়তে পড়তে চোখে পানি এসেছে। আসবেই তো ,এ হল আমাদের সমাজ। হাজার শেফালির জীবন ,চলাচল এখানে।আসুন আমরা এবার তাপসীর জীবনটা বুঝি।
সুন্দরী,মেধাবী,গুণী তাপসী বুঝ হওয়ার পর থেকেই জানে, তার বাবা সবাইকে বলে দিয়েছে, বাবার বাড়িতে ছেলেদের যতটুকু প্রাপ্য অধিকার ,মেয়েদের ও ঠিক ততটুকু। তাপসীকে পছন্দ করে মিনহাজ। তাপসী মিনহাজকে বলে তার বাবাকে বলতে হবে। মিনহাজ তাপসীকে বলে সে তার বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠাবে খুব শীঘ্রই। কারণ পছন্দ যাকে করেছে তাকেই বিয়ে করতে হবে এটাই মিনহাজের শিক্ষা। সে তার বাবাকে পাঠায় তাপসীর বাবার সাথে কথা বলতে। তাপসীর বাবা তাদেরকে জানিয়ে দেন ,তাপসী ছেলেকে পছন্দ করলে উনার কোন অমত নেই। মিনহাজ তাপসীকে শান্তিতে রাখার নিশ্চয়তা দিলে উনি মিনহাজকে নিজের ছেলে করে বরণ করে নিবেন।
সামাজিক সৌন্দর্য আর ধর্মীয় ভাবে তাপসীর বিয়ে হয় মিনহাজের সাথে। শশুর বাড়ি গিয়ে তাপসী শুনতে পায় বাবার মতো কিছু কথা। শশুর উনার ছেলেকে বলছেন বউকে খুশি রাখলে দুনিয়া খুশি। যার যার সম্পর্কের মর্যাদা দিবে ঠিক আছে কিন্তু বউ যেন থাকে সবার উপরে। তাপসী মিনহাজ খুঁজে পায় একটা জান্নাত। ধ্যানে,জ্ঞানে অনুভূতিতে শুধু দুজন দুজনকে দেখতে পায়। তাদের জগতে তারা দুইজন। সংসারটা যেন জান্নাতের বাগান। বছর না ঘুরতেই জান্নাতের ফুল হয়ে আসে সন্তান। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে সংসার নামের জান্নাত।
সম্মানে গৌরবে মাথা তুলে দাঁড়ায় মিনহাজ। প্রথম দিনের হাতে হাত রেখে কথা দেয়া আর সেদিনের অনুভূতি প্রতিদিন তার পথ চলার প্রেরণা হয়ে তার চলার পথে শান্তি জোগায়। অফিস আর বাসা এতটুকু দূরত্ব ছাড়া একদিনের জন্য ও একজন আরেকজনকে ছেড়ে যায় না। এতটুকু দূরত্বেও কতবার মন চলে যায় বাসায়। তিন চার বার ফোন দিয়ে খবর নিতেই হবে তাপসীর। জলিলের মতো অফিসে বসে পরের বউয়ের কিংবা অন্য নারীর সাথে কিভাবে কথা বলতে হবে মিনহাজ সেটা জানে না,জানতে চায়ও না। মিনহাজের অনুভূতিতে শুধুই তাপসী। জলিল শেফালিকে নিয়ে কোথাও যেতে চাইতো না কারণ বউ নিয়ে ঘুরলে তার ভাবী,বন্ধুর বউ,বসের বউ,শালার বউ,বউয়ের বোনেরা কিংবা প্রতিবেশি কষ্ট পাবে। তাদেরকে কষ্ট দিবেনা বলে একটা জীবনকে শেষ করে দিয়েছে। নিজেও একটা মুহূর্তের জন্য ও পায়নি সত্যিকারের জান্নাতি সুখ। মিনহাজের অনুভূতিতে কেউ কখনো প্রবেশ করার সাহসই পায়নি কোনদিন,একমাত্র তাপসী ছাড়া। তাপসীর একটা হাত ধরেই সে ঘুরে বেড়ায়। জান্নাত তার সঙ্গী হয়। একটা হাতের বন্ধন তাকে এনে দেয় অনাবিল আনন্দ। তাপসীর জীবন ও হয় সুখময় সুন্দর।
সুন্দর জীবন কে না চায়।অথচ নিজেদের কিছু ভুলের কারণে সমাজ সংসার হয় বিষের মতো বিষাক্ত।শেফালিদের করুণ আর্তনাদ আর বোবাকান্নার অভিশাপ বয়ে বেড়ায় সমাজ। সমাজের প্রত্যেকটা মানুষ যদি মেয়েদের আত্মনির্ভর শীল করার দায়িত্ব নেয়,তাদের প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দিয়ে তাদের মাথা গোজার ঠাই নিশ্চিত করে দেয় ,তাহলে কোন শেফালি যদি কোন জলিলের খপ্পরে পড়ে ও যায় ,তাকে আর পাগল হতে হবেনা। তাকে নির্মমভাবে মরতে হবেনা। একজন স্বামী পরিত্যক্তা মেয়েকে অভিশাপ না ভেবে, আশীর্বাদ মনে করে মেনে নিতে পারলেই আমাদের সমাজ হবে শেফালিদের আত্মার অভিশাপ মুক্ত। জন্ম হবেনা আরও অনেক গুলো শেফালির। আল্লাহ্ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুক।
-নাজমুন নাহার অপর্ণা