#সর্প_রাণী
পর্ব-১
শিশির ভেজা সবুজ ঘাসে ভোরের সোনালি আলো পড়ছে। সবুজ ঘাসে ভরা বিস্তীর্ণ মাঠের এক প্রান্তে ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে আছে আজাদ। শিশির ভেজা সবুজ ঘাসের কয়েকটি ছবি তুলে বাড়ির উদ্দেশ্যে সে হাঁটা ধরল। কুয়াশা ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে। মিনিট পাচেকের ভেতর চিরচেনা টিনের ঘরের সামনে সে এসে পৌঁছাল। নিজ ঘরের ভেতর প্রবেশ করে সে বিছানাতে গা এলিয়ে দিল। শুয়ে থাকা অবস্থাতেই ক্যামেরায় বন্দি করা ছবিগুলো সে একের পর এক দেখতে লাগল। আচমকা একটা ছবিতে তার চোখের দৃষ্টি স্থির হলো। ছবিটি খানিকটা জুম করে ঘামের ফাঁকে থাকা বস্তুটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। সেকেণ্ড দুয়েক পর সে বুঝতে পাড়ল ঘাসের ফাঁকে থাকা বস্তুটা আসলে কোনো বস্তু নয়; বরং একটি সাপের লেজ। ছবিটি ডিলিট করে ক্যামেরাটি বালিশের এক পাশে সে রেখে দিল। গ্রামে মাঠে সাপ থাকা অস্বাভাবিক কিছুই নয়। এ নিয়ে আজাদ আর ভাবল না।শীতের সকালটা সে লেপের নিচেই কাটিয়ে দিল।
বিকেলে নিত্য দিনের মতোই আজাদ মাঠে গেলো বন্ধুদের সাথে খেলতে। অকর্মঠ জোয়ান যুবক সে। কাজ কর্ম তেমনই বললেই চলে। যখন তার যা মনে চায় সে তাই করে বসে।
বন্ধুদের সাথে খেলা শেষে আজাদ বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে মাঠ ত্যাগ করে কাচা রাস্তায় ওঠে দাঁড়ায়। পাঁচ ছয় কদম দেবার পরই তার বন্ধু নীলয় পেছন থেকে ডাক দিয়ে বলে, “মাঠ আয়,দেখ আমার কী পেয়েছি।’’
আজাদের একটু কৌতুহল জাগল ; তাই নীলয়ের পিছু পিছু আবারও মাঠে এসে হাজির হলো। মাঠে উপস্থিত রয়েছে তার আরো ছয় বন্ধু। সে একটু এগুতেই লক্ষ্য করলো তার বাকি বন্ধুরা গাছের ডাল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা দাঁড়িয়ে গাছের ডাল দিয়ে কিছু একটাকে আঘাত করছে। একটু সামনে আসতেই বিষয়টা তার কাছে পরিষ্কার হলো। প্রায় দশ ফুট লম্বা একটা সাপকে তারা গাছের ডাল দিয়ে আঘাত করছে।
আজাদ একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “আরে সরে আয় তোরা। ছোবল খেলে সব মজা ছুটে যাবে।’’
নীলয় আজাদকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আরে ভাই মজা নে। আমাদের ছোবল মারতে পারবে না।আর তাছাড়া প্রতিদিন আমরা এই মাঠে খেলি, সাপটিকে জীবিত রাখলে পরবর্তীতে এমনও হতে পারে এই সাপের ছোবল আমরাই খাব। এরচেয়ে বরং এখন মেরেই ফেলি।’’
নীলয় আজাদের হাতে একটা গাছের ডাল ধরিয়ে দিল। বন্ধুদের কথায় পরে সেও সাপটিকে গাছের ডাল দিয়ে কষে কয়েকটি আঘাত করলো। এক সময় তাদের সম্মিলিত আঘাতের প্রভাবে সাপটি মারা গেলো। মাঠের পাশে থাকা নদীতে মৃত সাপটিকে ফেলে দিয়ে তারা যে যার মতো বাড়ির ফেরার পথ ধরল। ইতিমধ্যে সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। কিছুক্ষণের ভেতরে সন্ধ্যা হয় যাবে। চারিদিকে ছেয়ে পড়বে অন্ধকার আর অন্ধকার।
বাড়ি ফেরার পথে আজাদের কাছে বারবার মনে হচ্ছিল কেউ তার পিছু নিচ্ছে। কিন্তু সে অনেকবার পিছন ফিরে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পায়নি। মনের ভুল ভাবে সে।
রাত তখন আনুমানিক তিনটে বাজে। কনকনে শীত পড়ছে চারিদিকে। শীত থেকে বাঁচতে তিন চারটে মোটা জামা এবং গায়ের ওপর লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে আজাদ। আচমকা সে পায়ে ঠাণ্ডা স্যাঁতস্যাঁতে কিছু অনুভব করলো। কিছুটা তার কাছে সাবান পানির মতো মনে হলো আবার পরোক্ষণে মনে হলো সে বিছানায় মূত্র বিসর্জন করে নিই তো? দ্রুত সে লাফিয়ে ওঠে বসে। ঘুমের ঘোর কাটাতে সেকেণ্ড পাঁচেক সময় নিলো সে। এরপর রুমের বাতি জ্বালিয়ে সে প্রথমে বিছানা এরপর লেপ।এবং সর্বশেষ নিজের পরিধেয় পোশাক দেখে নিলো। কিন্তু কোথায়ও সে পানির বিন্দু মাত্র ছিটে ফোটাও পেলো না।
অস্পষ্ট স্বরে মৃদু চিৎকার করে সে বলল, “ধ্যাত!বোকার মতো বিনা কারণে শীতে দিয়ে ওঠেছি আমি।’’
আচমকা তার কান দুটো খাড়া হয়ে গেলো। গায়ের লোমগুলো হালকা দাঁড়াতে শুরু করলো। যেন তার দেহ কোনো বিপদের আভাস পেয়ে সতর্ক হচ্ছে। তারে কানে দূর থেকে মৃদু হিস হিস শব্দ ভেসে আসছে। শব্দের উৎসটা ঠিক কোন দিকে তা সে বুঝে ওঠতে পারেনি। মিনিহগহট দুয়েক পর শব্দটা ধীরে ধীরে কমতে লাগলো। দ্রুত পায়ে আজাদ বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। বুকের ভেতরটা তার কাঁপছে। কিন্তু সে কেনো ভয় পাচ্ছে তা সে জানে না। কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়ল নিজেও টের পায়নি।
সকাল সকাল তার কানে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ এলো। রুম থেকে বেরিয়ে বাহিরে এসে সে থমকে দাঁড়ালো। তাদের পাশের বাড়িটা নীলয়ের। সেখানে বেশ বড় সড় একটা ভিড় জমেছে। নিজ মাতাকেও সে সেখানে পেলো। তার মায়ের কাছ থেকে সে জানতে পাড়ল তার বন্ধু নীলয় মৃত! কথাটা তার কানে কয়েকবার প্রতিধ্বনিত হলো। গতদিনই তো নীলয়ের সাথে একসাথে সে খেলাধুলা করেছিল। আর আজ শুনছে সে মৃত!
কিছুতেই আজাদ বিশ্বাস করতে পারছে না তার বন্ধু মারা গেছে। নীলয়ের বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই সে থমকে দাঁড়ালো। নীলয়ের মৃত দেহটা নীল বর্ণ ধারণ করেছে। আশে পাশের মানুষের মুখনিঃসৃত ভাষা থেকে সে বুঝতে পাড়ল সাপের কামড়ে নীলয়ের মৃত্যু হয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ আজাদ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ঠিক একটা মূর্তির মতো সে দাঁড়িয়ে আছে। আচমকা বন্ধু হারানোর শোকটা কিছুটা প্রশমিত হলে সে নীলয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। নিজ রুমে এসে ধকধক করে এক গ্লাস পানি পান করলো। এরপর কয়েকটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে খাটে এসে বসে পড়ল।
“এত বিষধর সাপ আমাদের গ্রামে কোথা থেকে এলো? নীলয়ের দেহ দেখে তো বুঝা যাচ্ছিল অত্যধিক বিষধর কোনো সাপ কামড় দিয়েছে, যার প্রভাবে তার দেহ হালকা নীল বর্ণ ধারণ করেছে। বাংলাদেশে আদৌও কী এত বিষধর সাপ রয়েছে? আমার জানা মতে তো নেই।’’
খাটের ওপর বসে মনে মনে ভাবল আজাদ।
“আচ্ছা, এটা কোনো হত্যা নয় তো? কোনো বিষ প্রয়োগ করে নীলয়কে হত্যা করা হয় নাই তো? এমা না, না! এসব হতে পারে না। নীলয়কে মেরে কারোই বা ফায়দা?’’
ভাবতে ভাবতে আজাদের কানে আবারও সেই হিস হিস শব্দটা আসতে লাগলো। কান দুটো ধীরে ধীরে খাড়া হতে লাগলো, সেই সঙ্গে শব্দটাও তীব্র হতে লাগলো। এ যেন কোনো বিপদের আগাম সতর্কতা।
চলবে……