—ম্যালরাইটার?
—জ্বি স্যার, ম্যালরাইটার।
—কিভাবে কাজ করে তোমার এই ম্যালরাইটার? ফয়সাল সাহেব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন তরুণ প্রোগ্রামার আরিফ হাসানের দিকে।
আরিফ হাসানের বুদ্ধিদীপ্ত চোখ ঝকমক করছে উত্তেজনা, উৎসাহ আর উদ্দীপনায়।
—স্যার, এটাতে ফিফথ জেনারেশনের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের লেটেস্ট ভার্সন ইনস্টল করা আছে।
—তাই নাকি? খুব অবাক হলেন ফয়সাল সাহেব।
—জ্বি, স্যার। আরিফ উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করে, একটা শক্তিশালী রাইটার বট নিউরাল নেটওয়ার্ক আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি ব্যবহার করে অবলীলায় যেকোনো লেখকের ওয়েবসাইটের ফায়ারওয়াল, পাসওয়ার্ড সব ভেদ করে নিমেষেই ঢুকে যেতে পারে। সেকেন্ডে চুরাশি মিলিয়ন ডেটা স্ক্যান-রিড আর চব্বিশ মিলিয়ন ডেটা এনালাইসিস করতে পারে। সেইসাথে বারো মিলিয়ন ডেটা ম্যাপিং ও রিরাইট করতে পারে। তারমানে এই ম্যালরাইটার দিয়ে আমরা জনপ্রিয় রাইটারদের লেখাগুলো ম্যাপিং করে নতুন নতুন বই লিখিয়ে নিতে পারবো। সেক্ষেত্রে ম্যালরাইটারে শুধু সাবজেক্ট সেট করে দিতে হবে। এই যেমন— ফিকশন কিংবা নন-ফিকশন, গল্প, কবিতা কিংবা উপন্যাস; এগুলোর কিওয়ার্ড ও সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন মেনুতে সেট করে দিলেই হবে। আমরা পেয়ে যাব অসাধারণ সব পাণ্ডুলিপি।
—গোল্ডমাইন! ফয়সাল সাহেব আরিফ হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তো দারুণ কাজ করে ফেলেছ। তোমার এই ম্যালরাইটার যদি সত্যি সত্যিই কাজ করে, তাহলে এই ম্যালরাইটার দিয়ে আমি প্রকাশনা শিল্পে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলবো, এটা সুনিশ্চিত। জনপ্রিয় নামকরা লেখকদের লেখা ম্যাপিং করে আমরা দারুণ দারুণ সব বই বের করে ফেলবো। শেলী, কীটস, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, আলবেয়ার কামু থেকে শুরু করে রবীন্দ্র-নজরুল, এমনকি হুমায়ূন-জাফর ইকবালেরও আমরা কপি করে ফেলব।
একনাগাড়ে রুদ্ধশ্বাসে কথাগুলো বলতে বলতে ফয়সাল সাহেবের চোখ আনন্দে বিস্ফারিত হয়ে যায়। গভীর একটা শ্বাস নিয়ে আবারও আনন্দ উত্তেজনায় বিভোর হয়ে বলতে থাকেন— আচ্ছা, তুমি জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশনগুলো তোমার এই ম্যালরাইটার দিয়ে ম্যাপিং করে একটা নতুন শর্ট স্টোরি কিংবা সায়েন্স ফিকশন প্রিন্ট দাও দেখি। যদি তোমার ম্যালরাইটার সফটওয়্যার ঠিকমতো কাজ করে, তাহলে আমি নগদ দশহাজার টাকায় ওটা এক্ষুনি কিনে নেব।
মাত্র দশ হাজার! আক্ষেপ আর হতাশায় আরিফ হাসানের মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। প্রায় তিনমাস ধরে অনেক খেটেখুটে এই সফটওয়্যারটা বানিয়েছে সে। মনে অনেক আশা ছিলো— অন্তত লাখখানেক টাকায় বিক্রি করতে পারবে এই ম্যালরাইটার সফটওয়্যারটা। আর এখন কিনা ‘জ্ঞানবর্তিকা প্রকাশনী’র সত্ত্বাধিকারী ফয়সাল সাহেব মাত্র দশহাজার টাকা দিয়ে তাকে ঠকাতে চাইছেন। অথচ এই ম্যালরাইটার দিয়ে তিনি চাইলে কোটি টাকা কামাতে পারবেন। এসব ভাবনা মনে খেলে যেতেই কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে আরিফ হাসান।
কোনভাবেই এই ম্যালরাইটারটা সে ফয়সাল সাহেবকে দেবে না। আর সিদ্ধান্তটা নেয়ার সাথে সাথেই বুদ্ধি করে সে বলে— এই ম্যালরাইটার সফটওয়্যার এখন শুধু ইংরেজি রিড করতে পারে, বাংলা এবং অন্যান্য ভাষা রিড করতে পারে না। আজ রাতে আমি বাংলা এবং অন্যান্য ভাষার সফটওয়্যার আপডেট করে এতে ইনস্টল করবো। কালকে আপনাকে ড. জাফর ইকবালের বই ম্যাপিং করে প্রিন্ট দেবো।
বিরস মুখে ফয়সাল সাহেব বলেন— আচ্ছা ঠিক আছে, কাল সকালে যত তাড়াতাড়ি পারো ওটা নিয়ে এসো; আমি তোমাকে আরো পাঁচ হাজার টাকা বাড়িয়ে দেব।
ফয়সাল সাহেবের জ্ঞানবর্তিকা প্রকাশনী থেকে বেরিয়ে আরিফ একবার ভাবলো— আদর্শঘর প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী মাহবুব সাহেবের কাছে যাবে। এই লোকটাও কৃপণ, তবে ফয়সাল সাহেবের মতো টাকা দেওয়া নিয়ে ধানাই-পানাই করে না। যা মুখে বলে, তা সাথে সাথে দিয়ে দেয়। আর ফয়সাল সাহেব পরে যে আরো পাঁচ হাজার টাকা দিতে চেয়েছেন, সেটা পরে আর কখনো দেবেন না। এটা সে নিশ্চিত ভাবেই জানে।
সেজন্য মাহবুব সাহেবের আদর্শঘর প্রকাশনীর দিকে যাওয়ার জন্য যেই বাঁ দিকের গলিতে ঢুকতে যাবে, তখনই দূরে ফয়সাল সাহেবের অফিসের পিয়ন নুরুকে সতর্কভাবে আসতে দেখে ভালো করেই বুঝলো, সে কোথায় যায় না যায়, সেটা দেখার জন্য নুরুকে পেছনে লাগিয়েছেন ফয়সাল সাহেব। সাথে সাথে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, আজকে আর মাহবুব সাহেবের ওখানে যাবে না। তাই সে ওখান থেকে ফিরে চললো তার বাসার দিকে।
বাসা বলতে ওয়ারির র্যাংকিন স্ট্রিটের এক চিপা গলির মুখে চারতলা বাড়ির ছাদের চিলেকোঠায় একটা খুপরি ঘরে থাকে সে। এই বাড়িটার নিচতলার পুরোটা জুড়ে ছাত্রদের চারটা মেস। আগে সে এই চারটা মেসের একটায় থাকতো। সেখানে দুই বছর থাকার পর একটু নিরিবিলি কাজ করার জন্য সে ছাদের উপরে সিঁড়ি ঘরের পাশে চিলেকোঠার এ রুমটায় এসেছে।
এখানে তেমন কোনো ঝামেলা নেই। শুধু সকালে দোতলা থেকে বাড়ির মালিক হালিম সাহেব তার প্রিয় গিরিবাজ কবুতরগুলোকে ওড়াতে ছাদে আসেন। আর বিকেলে তার ছোট মেয়ে শাহরিন শখের বাগানে কি কি ফুল ফুটেছে, তা দেখতে আসে। শাহরিন জগন্নাথে বোটানিতে পড়ে। অনার্স সেকেন্ড ইয়ার।
মায়াকাড়া হরিণ চোখের এই মেয়েটির সাথে তার মাঝেমধ্যে চোখাচোখি হয়। চোখে চোখ পড়লে বুকে কিরকম যেনো শিহরণ হয় তার। তারপরও মেয়েটা চোখ সরিয়ে নেয় না। কেমন মায়াময় আয়তচোখে অপলক তাকিয়ে থাকে। যেন কিছু বলতে চায়! আরিফেরও ইচ্ছে করে ওর সাথে কথা বলতে। কিন্তু সাহস হয় না।
মেয়েটিকে নিয়ে সে স্বপ্নও দেখে অনেক। এরকম একটি মায়াবতী মেয়ের সাথে তার বিয়ের কথা মা বলে, কিন্তু বাড়িতে তার বিবাহযোগ্যা ছোট বোন আছে। ছোট বোনকে বিয়ে না দিয়ে সে বিয়ে করবে না। ওদিকে মা-বাবা অসুস্থ। তাদের চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠায় সে। কিন্তু তিন মাস প্রায় শেষ হতে চলল, এখনও টাকা পাঠাতে পারেনি; এ কথা ভাবতেই তার মনটা ছোট হয়ে যায়। আজকে যদি ম্যালরাইটারটা ফয়সাল সাহেব একলাখ না হোক, অন্তত পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকায় কিনে নিতেন, তাহলে সেও বাবা-মার চিকিৎসা এবং বোনের বিয়ের জন্য টাকা পাঠিয়ে দিতে পারতো। এসব কথা ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আরিফ।
২.
অনেক রাত পর্যন্ত ম্যালরাইটারটা ডেভলপের কাজ করে ঘুমে যখন চোখ জড়িয়ে এসেছে তখন বিছানায় শরীর এলিয়ে শুয়ে পড়ে আরিফ। খুব ভোরবেলায় ঘুমের ঘোরে তার মনে হয়— ঘরে যেন কেউ ঢুকেছে। কিন্তু সে মনে করে, ওটা বুঝি শুধু একটা স্বপ্ন।
৩.
সকালে ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে হঠাৎ কম্পিউটারের দিকে চোখ পড়তেই চমকে ওঠে আরিফ। কম্পিউটারের পোর্টে লাগিয়ে রাখা পেনড্রাইভটা নেই। অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে, এন্টি-ম্যালরাইটারের পেনড্রাইভটা গতরাতে কম্পিউটারে লাগিয়েই রেখেছিল। গভীর ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে আসায় আর খুলতে মনে নেই তার। সাথে সাথে বালিশ তুলে দেখে— হ্যাঁ, যেটা তার কাছে থাকা দরকার, সেটা ঠিকই আছে। তার মুখে গভীর পরিতৃপ্তির প্রশান্তিময় এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।
৪.
কম্পিউটার অপারেটর জাকিরকে খুব তাড়া দিচ্ছেন ফয়সাল সাহেব। নুরুর নিয়ে আসা পেনড্রাইভ থেকে তাড়াতাড়ি ম্যালরাইটার সফটওয়্যারটা কম্পিউটারে ইন্সটল করার জন্য। জাকির খুব দ্রুত ম্যালরাইটার সফটওয়্যারের পেনড্রাইভটা কম্পিউটারের পোর্টে লাগিয়ে ইন্সটল করতে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে তার কম্পিউটারের মনিটর একেবারে সাদা! জাকির হতভম্ব হয়ে বলে, এটা কি হলো স্যার? আমাদের সব ফাইল ডিলিট হয়ে গেল! সাথে সাথে ঘ্রং ঘ্রং করে বিচিত্র এক আওয়াজের সাথে মনিটরে ভেসে উঠলঃ
ইউ আর সেভ নাউ…!
—এন্টি-ম্যালরাইটার!!
………………………★★★……………………………
সাইফুল হক : লেখক, সম্পাদক, গবেষক।
ম্যালরাইটার
সফটওয়্যার
এন্টি-ম্যালরাইটার
সায়েন্স ফিকশন