ইনফ্লুয়েঞ্জা নাক, গলা ও ফুসফুসের একটি মারাত্মক রোগ। এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। শীতকালে এ রোগের প্রকোপ বেশি হলেও বছরের অন্যান্য সময়ও এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
কারা ঝুঁকিতে আছে?
* পাঁচ বছর বয়সের কম শিশু।
* ৬৫ বছরের বেশি বয়সী বৃদ্ধ।
* অন্যান্য বয়সী যাদের হূৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি, লিভারের সমস্যা আছে।
* যাদের হাঁপানি ও ডায়াবেটিস আছে।
* যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম।
লক্ষণসমূহ
হঠাৎ জ্বর, শুকনো কাশি, সর্দি, মাথাব্যথা, মাংসপেশি ও গিঁটে ব্যথা। যদিও এই লক্ষণসমূহ এক সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়, তবুও মাঝেমধ্যে যারা এই রোগের ঝুঁকিতে থাকে, বিশেষ করে শিশুরা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়; এমনকি তাদের মৃত্যুও হতে পারে।
কীভাবে ছড়ায়?
যখন একজন এ রোগে আক্রান্ত হয়, তার হাঁচি-কাশির মাধ্যমে অন্যদের শরীরে এ রোগের জীবাণু ছড়ায়। হাতের মাধ্যমেও এই রোগজীবাণু ছড়াতে পারে।
সাধারণত যেখানে জনসমাগম বেশি, যেমন—নার্সারি, স্কুল, হাটবাজার, মসজিদ ইত্যাদি স্থানে একজনের কাছ থেকে অনেক মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়।
প্রতিরোধ কীভাবে করবেন?
শিশু ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হলে মা-বাবার উচিত হবে তাকে স্কুলে না পাঠানো। বড়দের হলেও যেখানে জনসমাগম হয়, সেখানে যাওয়া থেকে তারা বিরত থাকবেন। আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে হাত মেলাবেন না, অথবা সঙ্গে সঙ্গে হাত ধুয়ে ফেলবেন। আক্রান্ত রোগী কাশি বা হাঁচি দেওয়ার সময় টিস্যু পেপার দিয়ে নাক, মুখ ঢেকে নেবেন এবং বারবার হাত ধোবেন।
এ ছাড়া এই রোগটি টিকা দেওয়ার মাধ্যমেও প্রতিরোধ করা যায়। এই টিকা আমাদের দেশে পাওয়া যায়। টিকা সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং অত্যন্ত কার্যকরী। যেসব শিশু বা বয়স্ক ব্যক্তি ঝুঁকিতে আছেন, তাঁরা টিকা নিতে পারেন।
চিকিৎসা
জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল দেবেন। বারবার শরীর স্পঞ্জ করে দেবেন। বেশি করে পানি, শরবত, ফলের রস খেতে দেবেন।
যদি নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
অধ্যাপক তাহমীনা বেগম
শিশু বিভাগ, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও বারডেম
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০২, ২০১০
ঋতু পরিবর্তনে শিশুর কাশি
ঋতু পরিবর্তনের এই সময়টাতে শ্বাসতন্ত্রের যত উপসর্গের জন্য আমরা শিশুদের নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাই, তার মধ্যে কাশি হচ্ছে প্রধান সমস্যা। কাশি হওয়া মানেই যে আপনার সন্তান অসুস্থ, এ কথা সব সময় ঠিক নয়। শ্বাসতন্ত্র থেকে শ্লেষ্মা, অস্বস্তিকর পদার্থ ও সংক্রামক জীবাণু বের করে দিয়ে কাশি আসলে শরীরের রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
সুস্থ-স্বাভাবিক শিশুরা দিনে এক থেকে ৩৪ বার পর্যন্ত কাশতে পারে এবং এই কাশি চলতে পারে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত। তবে রাতে ঘুমের মধ্যে কাশি হলে সেটা সব সময়ই অস্বাভাবিক মনে করতে হবে। তখন দরকার চিকিৎসকের পরামর্শ। শিশুদের কাশি দুই রকম হতে পারে। অ্যাকিউট কাশি (মেয়াদকাল এক থেকে দুই সপ্তাহ) এবং ক্রনিক কাশি (চার সপ্তাহের বেশি)।
অ্যাকিউট কাশি
এ ক্ষেত্রে প্রধান কারণ হচ্ছে শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাসজনিত সংক্রমণ। বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস এই কাশির জন্য দায়ী হতে পারে। প্রাক-বিদ্যালয়ও বয়সের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী শিশু বছরে ছয় থেকে আটবার ভাইরাসজনিত শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হতে পারে। এগুলো সচরাচর প্রত্যক্ষভাবে বায়ুবাহিত ভাইরাসের সংক্রমণ।
ক্রনিক কাশি
ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী কাশি (চার সপ্তাহের অধিক সময়ব্যাপী) শিশুদের মধ্যে খুব বেশি পরিমাণে দেখা যায়। এ ধরনের কাশির কারণ হচ্ছে-
হাঁপানির উপসর্গ হিসেবে কাশি
হাঁপানি বা অ্যাজমায় আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে কাশি হচ্ছে প্রধান উপসর্গ (থেকে-থেকে বুকের মধ্যে শাঁ শাঁ শব্দ এবং ছোট ছোট শ্বাস)। কোনো কোনো শিশুর ক্ষেত্রে উপসর্গ হিসেবে শুধু কাশিকেই খেয়াল করতে হবে। হাঁপানিজনিত কাশির প্রকোপ বেড়ে যায় ভাইরাস সংক্রমণের কারণে, বিশেষ করে রাতে। খেলাধুলা ও ঠান্ডা বাতাস কাশি আরও বাড়িয়ে দেয়। হাঁপানিজনিত এ কাশির চিকিৎসায় শিশুদের ক্ষেত্রেও বড়দের মতোই ইনহেলার ও মুখে খাওয়ার ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
নাক ও সাইনাসের সমস্যা থেকে কাশি
নাক ও সাইনাসের প্রদাহ থেকে শিশুদের দীর্ঘস্থায়ী কাশি হতে পারে। নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া বা সর্দি ঝরা থাকলেও এ ক্ষেত্রে মূল উপসর্গ হিসেবে খুঁজে পাওয়া যায় কাশি। এর আরেকটি কারণ হচ্ছে, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস (ই-ফিভার)। এটি নির্দিষ্ট সময়ে বা হতে পারে সারা বছরও। এ ক্ষেত্রে অ্যালার্জি পরীক্ষা করা দরকার। সাইনাসের সংক্রমণের কারণে যে কাশি হয়, তা সপ্তাহের পর সপ্তাহ, এমনকি এক মাসের বেশি সময় ধরেও চলতে পারে। রোগ নির্ণয়ের জন্য সাইনাসের এক্স-রে বা সিটিস্ক্যানের প্রয়োজন হতে পারে।
পাকস্থলী ও খাদ্যনালির অসুস্থতাজনিত কাশি
কিছু শিশুর ক্ষেত্রে ক্রনিক কাশির কারণ হিসেবে পাকস্থলী ও খাদ্যনালির সংক্রমণ দায়ী। গ্যাস্ট্রো-ইসোফেসিয়াল রিফ্লাক্স রোগ হচ্ছে সবচেয়ে সাধারণ। এ অসুখের সঙ্গে বুকজ্বলা থাকে। তবে শিশুরা বুকজ্বলার কথা তেমন বলে না। সম্ভবত তারা বুঝতে পারে না যে এটি একটি রোগের লক্ষণ। এমনও হতে পারে যে তারা এই কষ্টের অনুভূতি ঠিকমতো ব্যক্ত করতেও শেখেনি। তবে অনেক শিশুর ক্ষেত্রে এর সঙ্গে বুকজ্বলা থাকে না। কারও কারও গলার স্বর কর্কশ হয়ে যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি চিকিৎসক শিশুকে ওষুধও দিতে পারেন। মনে রাখা দরকার, খেতে বসে ঢেকুর তোলা বা খাবার গিলতে অসুবিধা হওয়ার কারণে কাশির উদ্রেক হওয়া শিশুদের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক নয়।
দীর্ঘস্থায়ী কাশির অন্যান্য কারণ
ভাইরাস সংক্রমণ-পরবর্তী কাশি, ভাইরাসের কারণে শ্বাসতন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টি হলে কয়েক সপ্তাহব্যাপী কাশি হতে পারে। শিশুর হাঁপানি, অ্যালার্জি বা সাইনোসাইটিস না থাকলেও এমনটি ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। অনেক সময় এমনিতেই কাশি সেরে যায়। কফ সিরাপ ব্যবহার করলে অনেক সময় ভালো ফল পাওয়া যায়।
নাকে কোনো কিছু প্রবেশ করা
প্লাস্টিকের খেলনার ক্ষুদ্র অংশ, বাদাম বা শক্ত চকলেটের অংশ দুই থেকে চার বছরের শিশুদের নাকে-গলায় আটকে যাওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি থাকে। অনেক সময় এক্স-রেতেও এসব জিনিস ধরা পড়ে না। এগুলো অপসারণ না করা পর্যন্ত শিশুর কাশি ভালো হয় না।
অভ্যাসজনিত কাশি
এ ধরনের দীর্ঘস্থায়ী কাশির কোনো সুনির্দিষ্ট শারীরিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। শিশু-কিশোর ও সদ্য তরুণদের মধ্যে এ ধরনের কাশি দেখা যায়।
শুরু হয় সচরাচর ভাইরাসের সংক্রমণ দিয়ে। কাশির ধরন শুকনো ও নির্দিষ্ট বিরতিতে কাশি হওয়া। আক্রান্ত শিশু থেকে তাদের অভিভাবক বা শিক্ষকেরাই কাশির ঠা ঠা শব্দ শুনে আতঙ্কিত হয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে ঘুমের মধ্যে কখনোই কাশি থাকে না।
অস্বস্তিকর কফ
অনেক সময় আশপাশে কেউ ধূমপান করলে ধোঁয়ার কারণে কাশি হতে পারে। এ ছাড়া বায়ুদূষণ, গাড়ির ধোঁয়া, আগুন প্রভৃতি কারণেও কাশি হতে পারে। হাঁপানি ও অ্যালার্জিতে আক্রান্ত শিশুদের এসব অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে দূরে রাখতে হবে।
চিকিৎসা
ভাইরাসজনিত কাশির ক্ষেত্রে সাধারণত কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয় না। এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে এমনিতেই এ কাশি সেরে যায়।
দীর্ঘস্থায়ী কাশির ক্ষেত্রে প্রথমেই খুঁজে বের করতে হবে কাশির কারণ। হাঁপানি, রাইনাইটিস, সাইনোসাইটিস, অন্ত্রের সমস্যা-এগুলোর যেকোনোটি কাশির কারণ হতে পারে। গুয়াইফেনেসিন-জাতীয় কফ সিরাপ প্রয়োগে তেমন ফল পাওয়া যায় না। বড় ডেক্সট্রোমেথরফেন-জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে এতেও খুব ভালো ফল পাওয়া যায় না। যেসব সিরাপের মধ্যে কোডেইন থাকে, সেগুলো বেশ কার্যকর। তবে এ-জাতীয় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুব বেশি। তাই বেশি দিন ধরে এ ওষুধ খাওয়ানো ঠিক নয়। দীর্ঘস্থায়ী কাশির মূল কারণ খুঁজে বের করে তার চিকিৎসা করাতে হবে। যদি কাশির ধরন পরিবর্তিত হতে থাকে, ওষুধে কোনো ফল না দেয়, যদি কাশির সঙ্গে রক্ত আসতে থাকে অথবা কাশির কারণে ঘুম ও কাজকর্মের ব্যাঘাত ঘটতে থাকে, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
কখন হাঁপানি বা অ্যালার্জি বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে
— তিন-চার সপ্তাহ বা তার চেয়ে বেশি সময় কাশি থাকলে।
— কাশির সঙ্গে যদি হাঁপানির টান থাকে।
— দীর্ঘস্থায়ী কাশির সঙ্গে যদি নাক ও সাইনাসের রোগ থাকে।
— দীর্ঘস্থায়ী কাশির সঙ্গে পরোক্ষ ধূমপান বা অন্য উত্তেজক পদার্থের উপস্থিতি থাকলে।
ডা· গোবিন্দ চন্দ্র দাস
সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও বিভাগীয় প্রধান
অ্যালার্জি ও অ্যাজমা রোগ বিশেষজ্ঞ
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১১, ২০০৯
দীর্ঘমেয়াদি কাশি
সাধারণত সর্দিজ্বর বা ঠান্ডা লাগলে সবারই কমবেশি কিছুটা কাশি হয়। কখনো শুকনো, কখনো বা সামান্য কফও বের হয়। ফ্লু-জনিত বা গলায় সামান্য প্রদাহের কারণে কাশি তেমন অসুবিধার সৃষ্টি করে না, দু-চার দিন পর উপশম হয় এবং কাশির জন্য খুব বেশি ওষুধের দরকারও হয় না। কিন্তু কিছু রোগে কাশি একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দেয় এবং বেশ কয়েক দিন কাশি থাকে। কাশি রোগ নয়, কিন্তু রোগের উপসর্গ। এ জন্য সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করে ওষুধ খেলে দীর্ঘমেয়াদি কাশি ভালো হয়ে যায়।
দীর্ঘমেয়াদি কাশিঃ যে কাশি একনাগাড়ে তিন সপ্তাহের বেশি থাকে, তাকেই দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক কাশি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেসব রোগে দীর্ঘমেয়াদি কাশি হয়, সে সম্পর্কে কিছুটা জানা থাকলে রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় সুবিধা হয়। ক্রনিক কাশি হলে কারও কারও কাশির শেষে কিছুটা টানের ভাব থাকে, কখনো বা শ্বাসকষ্টও দেখা দেয়। শিশুদের ক্রনিক কাশি থাকলে দেরি না করে কাছাকাছি চিকিৎসাকেন্দ্রে বা স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ নিতে হবে। বয়স্ক ও যারা কোনো রোগে শয্যাশায়ী, তাদের ক্রনিক কাশি হলে সত্বর প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি কাশি হচ্ছে রোগের উপসর্গ, রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করলে কাশিজনিত রোগ পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়।
হাঁপানি বা অ্যাজমাঃ হাঁপানি সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই কিছুটা ধারণা আছে। এই রোগে দীর্ঘমেয়াদি কাশি একটি প্রধান উপসর্গ। সাধারণত দুই বছরের কমবয়সী শিশুদের হাঁপানি বা অ্যাজমা দেখা যায় না। দু-একজন শিশুর কখনো বা হাঁপানি দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে পারিবারিকভাবে হাঁপানির ইতিহাস থাকে। হাঁপানির কারণে যে ক্রনিক কাশি হয় তার লক্ষণ হচ্ছে, কোনো নির্দিষ্ট মৌসুমে বা রাতের বেলায় খুব বেশি বা ঘন ঘন কাশি, বেশি নড়াচড়া করলে কাশি বেড়ে যায়, অনেকক্ষণ কাশির পরে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, আক্রান্ত রোগী মুখ দিয়ে শ্বাস নিয়ে থাকে, নাকের দুই পাশ ও বুকের পাঁজর ঘন ঘন ওঠানামা করে। ঘন ঘন কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সালবিউটামল ওষুধ বা ইনহেলার ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া যায়। রোগটি হাঁপানি বলে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিলে দীর্ঘমেয়াদি কাশি থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব।
যক্ষ্মাঃ টিউবারকুলোসিস হলে দীর্ঘমেয়াদি কাশি দেখা যায়। শুধু দীর্ঘমেয়াদি কাশি থাকলেই ফুসফুসের যক্ষ্মা বলা যাবে না, সঙ্গে অনেক দিন ধরে শরীরে অল্প জ্বর, শরীরের ওজন কমে যাওয়া, ঘাড়ের লিম্ফনোড বা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ থাকলে বুকের যক্ষ্মা বলে সন্দেহ করা যেতে পারে। বুকের যক্ষ্মা থাকলে ক্রনিক কাশি একটি প্রধান উপসর্গ। এ ক্ষেত্রে বুকের এক্স-রে, কফ ও মনটুস পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করে নিয়মিত ওষুধ খেলে বুকের যক্ষ্মা পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়; সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি কাশি থেকে নিরাময় পাওয়া যায়।
হুপিং কাশিঃ হুপিং কাশির জন্য ডিপিটির পি অর্থাৎ পারটুসিস বা হুপিং কাশির প্রতিষেধক নেওয়ার পরও কোনো কোনো শিশুর সামান্য হুপিং কাশি দেখা দিতে পারে। লক্ষ রাখতে হবে, শিশুর কাশির সময় টান বা হুপ শব্দ হয় কি না, কাশতে কাশতে বমি করে কি না এবং শ্বাসকষ্ট হয় কি না।
শিশুদের ডিপিটির সব ডোজ সঠিক সময়ে না দিলে হুপিং কাশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং শিশু ক্রনিক কাশিতে ভোগে। চিকিৎসকের পরামর্শে শিশুকে ডিপিটির প্রতিষেধক টিকা দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণত ১২ বছর বয়সের পর শিশুদের হুপিং কাশি দেখা যায় না। বর্তমানে স্বাস্থ্যসচেতনতার জন্য টিকা ব্যবহার অনেক বেড়েছে বলে রোগটি প্রায় নিয়ন্ত্রিত এবং এখন খুব বেশি শিশু হুপিং কাশিতে আক্রান্ত হয় না।
ব্রংকিয়্যাকটেসিসঃ এ রোগটি সাধারণত শিশুদের হতে দেখা যায় না। আমাদের দেশে বয়স্ক পুরুষদের মধ্যেও এটি বেশি দেখা যায়। ঘন ঘন ফুসফুসের সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, ফুসফুসে পুঁজ প্রভৃতি কারণে এ রোগ হয়। এই রোগটির অন্যতম প্রধান উপসর্গ হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি কাশি। ব্রংকিয়্যাকটেসিস হলে বিচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘস্থায়ী কাশি হয়। সাধারণত সকালের দিকে কাশি বেশি হয়, কাশির রং সচরাচর সবুজ হয় এবং গন্ধযুক্ত কফে পুঁজ থাকে। রোগটি নির্ণয়ের জন্য বুকের এক্স-রে এবং কিছু পরীক্ষার দরকার হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেলে রোগটি সেরে যায়।
আরও কিছু কারণঃ শ্বাসনালির লিম্ফনোড বা গ্রন্থি বড় হয়ে গেলে, নিঃশ্বাসের সঙ্গে বাইরের কোনো বস্তু ফুসফুসে বা শ্বাসনালিতে ঢুকলে ক্রনিক কাশি হতে পারে। খুব বেশি বা দীর্ঘদিন ধূমপান করলেও অনেকের ক্রনিক কাশি দেখা যায়। ক্রনিক কাশির উপসর্গ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ খেলে পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়। তবে তিন-চার দিনের কাশিকে ক্রনিক কাশি ভেবে কোনো ওষুধ খাবেন না।
ডা· রেজাউল ফরিদ খান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১২, ২০০৮
সর্দি-কাশি হলে কি করবেন
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে একটু সতর্কতা অবলম্বন করে সাধারণ সর্দি ঠাণ্ডা কাশি থেকে খুব সহজেই মুক্ত থাকা সম্ভব। সাধারণ ঠাণ্ডা-সর্দি (Common Colds) এড়াতে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কয়েকটি পরামর্শঃ-
একঃ সর্দি কাশিতে আক্রান্ত ব্যক্তির বা কাশি বা হাঁচি থেকে কমপক্ষে তিন ফুট দূরে অবস্থান করুন। মিচিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি কলেজ অব ইউম্যান মেডিসিনের ডাক্তার ডেনিস ম্যুরের মতে সর্দি-কাশির জীবাণু খুব সহজেই আপনার চোখ অথবা নাকের ভেতর দিয়ে সংক্রমিত হতে পারে।
দুইঃ হাত সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। অহিত্ত স্টেট ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের ডাঃ জোসেফের মতে হাঁচি বা কাঁশির সাথে নির্গত ঠাণ্ডার জীবাণু যে কোন বস্তুতে লেগে থাকতে পারে। স্পর্শের মাধ্যমে তা হতে সংক্রমিত হতে হবে।
তিনঃ পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি গ্রহণ করুন। ডাঃ গ্রেডিসনের মতে যথেষ্ট পরিমাণে (কমপক্ষে দৈনিক আট গস্নাস) পানি গ্রহণ শরীরের বিশুদ্ধতা দূর করে এবং দেহ থেকে জীবণু নির্গমনে সাহায্য করে।
চারঃ আঙ্গুল দিয়ে ঘন ঘন নাক অথবা চোখ খুটবেন না।
পাঁচঃ বিছানায় পড়ে না থেকে হাঁটাহাঁটি মৃদু ব্যায়াম করুন।
ছয়ঃ রাত্রে যথেষ্ট পরিমাণে ঘুমান। চিকিৎসা গবেষণায় তথ্য রয়েছে যে অনিদ্রা দেহের রোগজীবণু ধ্বংসকারী কোষের সংখ্যা হ্রাস করতে পারে। অন্যদিকে পর্যাপ্ত ঘুম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
সাতঃ কম চর্বিযুক্ত চিকেন স্যুপ খান। ডাঃ গ্রাডিসনের মতে গরম গরম চিকেন স্যুপ প্রোটিন, ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান সরবরাহ করে দেহকে ঠাণ্ডা-সর্দির জীবানুর সাথে যুদ্ধে সাহায্য করে।
আটঃ কফ কাশি, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, গলা ব্যথা, জ্বর ইত্যাদি উপসর্গে রেজিস্ট্যার্ড ডাক্তারের পরামর্শে সুনির্বাচিত ঔষধ প্রয়োজনে গ্রহণ করুন।
দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ জুন ২০০৮
শীতে নবজাতকের সর্দি-কাশি
নবজাতক বলতে জ্নের পর থেকে ২৮ দিন পর্যন্ত বয়সী শিশুকে বোঝায়। এই শিশুদের শীতের সময় সবচেয়ে বেশি যে সমস্যা হয় তা হচ্ছে ঠান্ডা লাগা। শিশু ঘনঘন হাঁচি দেয়, নাক বন্ধ থাকে, শব্দ হয়, মাঝেমধ্যে কাশিও হয়। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন উদ্বিগ্ন মনে শিশুকে হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই স্থানীয় ওষুধের দোকান থেকে নিউমোনিয়া হয়েছে ভেবে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কিনে শিশুকে খাওয়াতে থাকেন। কখনো কখনো চিকিৎসকদের মধ্যে কেউ কেউ অকারণেই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ, এমনকি ইনজেকশন পর্যন্ত দেন, যা একদম ঠিক নয়।
আসল কথা হলো নবজাতক পৃথিবীতে নতুন। মাতৃগর্ভের উষ্ণতা থেকে মাত্র পৃথিবীতে এসেছে। শীতের ঠান্ডা বাতাস শিশুর নাক দিয়ে প্রবেশ করে নাক ও শ্বাসনালিতে সুড়সুড়ি দেয়, ফলে শিশুর হাঁচি বা কাশি হয়। নাকের ভেতরের চামড়া ফুলে উঠলে শিশুর নাক বন্ধ থাকে। এ ক্ষেত্রে খেয়াল করুন আপনার শিশু দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে কি না (মিনিটে ৬০ বার বা তার বেশি)। বুকের পাজরের নিচের অংশ ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে কি না, যদি হয় তাহলে বুঝতে হবে শিশুর নিউমোনিয়া হয়েছে। যদি উল্লিখিত লক্ষণ দুটো থাকে বা শিশু নিস্তেজ হয়ে যায়, কম খায় বা শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট হয় তাহলে জরুরিভিত্তিতে শিশুকে চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সাধারণ ঠান্ডায় অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো প্রয়োজন নেই- এ কথাটি আমরা যেন ভুলে না যাই।
নাক বন্ধ থাকলে শুধু নরম কাপড় দিয়ে বা কটন বাডে দুই ফোঁটা ‘নরমাল ড্রপ’ দিয়ে নাক মুছে দিলেই শিশু আরাম পাবে ও খেতে পারবে।
শিশুর যাতে ঠান্ডা না লাগে এ জন্য গরম কাপড় দিয়ে শিশুকে বিশেষ করে তার মাথা ঢেকে রাখুন। নরম কাপড়ের টুপি পরান। দু-তিন দিন পরপর কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করান। আর বারবার শিশুকে মায়ের দুধ দিন। মায়ের বুকের দুধ শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়; সেই সঙ্গে মায়ের মমতা শিশুকে উষ্ণ রাখে। আপনি ও আপনার নবজাতক সুস্থ থাকুন।
দৈনিক প্রথম আলো, ২৬ ডিসেম্বর ২০০৭
লেখকঃ অধ্যাপক ডা· তাহমীনা বেগম
শিশু বিভাগ, বারডেম
কফ-কাশির নেপথ্য কারণ এবং তার প্রতিকার
প্রায় সব বক্ষব্যাধিতেই কফ-কাশি দেখা দেয়। কিছু হৃদরোগেও কফ-কাশি লেগে থাকে। প্রত্যেকের জীবনেই কফ-কাশির কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা থাকবেই। এখন প্রশ্ন হলো, কফ-কাশি কেন হয়?
মানুষের দেহে দুটি ফুসফুস রয়েছে। এই ফুসফুসগুলোর মধ্যে রয়েছে অসংখ্য বড়-ছোট শ্বাসনালী। সেই শ্বাসনালী বা ব্রংকাস থেকেই তৈরি হয় কফ।
কফ-কাশির নাম নিলেই যে রোগের কথা প্রথমে মনে আসে, সেটি হলো যক্ষ্মা। যক্ষ্মা হলে কাশি লেগেই থাকে। প্রথমদিকে কফ পাতলা শ্লেষ্মা জাতীয় থাকে। অনেক সময় জীবাণু সংক্রমিত হয়ে সেটা পেকে হলুদ হয়ে যায়। একজন রোগী যদি তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অবিরাম কাশতে থাকে তবে তাকে অবশ্যই কফ পরীক্ষার জন্য তাগিদ দিতে হবে। কফে যদি যক্ষ্মা জীবাণু ধরা পড়ে তবে তো কথাই নেই। কিন্তু অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, মাত্র দশ শতাংশ যক্ষ্মা রোগীর কফে যক্ষ্মা জীবাণু ধরা পড়ে। অর্থাৎ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যক্ষ্মা রোগ নির্ণীত হয় এক্সরে পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে। এরপর আসা যাক ব্রংকি একটেসিসের কথায়। ব্রংকি একটেসিস নামের রোগটিতে পাকা পাকা হলুদ কফ নির্গত হয়। প্রধানত সকালের দিকেই এই দুর্গন্ধযুক্ত কফ বের হয়ে থাকে। ফুসফুসে এনএরোবিক জীবাণু সংক্রমণের ফলে এই দুর্গন্ধ হয়ে থাকে। এই রোগের অন্যতম লক্ষণ হলো-কফের সঙ্গে নিয়মিত রক্ত যাওয়া। এ ধরনের প্রচুর রোগীকে যক্ষ্মা ভেবে ভুল করে যক্ষ্মার ওষুধ খাওয়ানো হয়ে থাকে।
ক্রনিক ব্রংকাইটিস এমন একটি রোগ যা পরিবেশ দুষণ এবং মুলত ধুমপানের জন্য হয়ে থাকে। এই রোগে শ্বাসকষ্ট হলো অন্যতম প্রধান লক্ষণ। তবে কফ-কাশির সমস্যা লেগেই থাকে। কফ প্রথমে অল্প আঠালো এবং পিচ্ছিল হয়ে থাকে। পরে জীবাণু সংক্রমিত হয়ে কফ পেকে হলুদ হয়ে যায়। তখন শ্বাসকষ্ট প্রবল হয় এবং জ্বর দেখা দেয়। হাঁপানি রোগীর কফ বের হতে চায় না। একটু কফ বের হয়ে গেলে রোগী শ্বাসযন্ত্রণা থেকে আরাম পায়।
নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগীর কফ আবার আলাদা ধরনের হয়। কখনো সাদা কখনো হালকা হলুদ। নিউমোনিয়ার একপর্যায়ে কফের মধ্যে মরিচার মতো লাল রঙ মিশ্রিত থাকে। ফুসফুসের ক্যাসারেও কফ থাকে। কফে ছিঁড়ে ছিঁড়ে রক্ত যায় এবং বুকে প্রচন্ড ব্যথা থাকে। এ ধরনের রোগের শেষের দিকে রোগীর কাশি অনেক সময় ভিন্ন শব্দে শুনতে পাওয়া যায়, যাকে Bovine Cough বলে। ফুসফুসের ফোঁড়া বা Lung Abscess হলে কফ পেকে হলুদ হয়ে যায় এবং অনেক সময় কফে দুর্গন্ধ থাকে। কফ রক্তমিশ্রিত থাকতে পারে। এলার্জিজনিত হাঁপানিতে এবং ট্রপিক্যাল ইয়োসিনোফিলিয়াতে কফ ঘন হয়। কফ পরীক্ষা করলে তাতে প্রচুর ইয়োসিনোফিল দেখতে পাওয়া যায়। একজন নিয়মিত ধুমপায়ীর সবসময় কফ-কাশি লেগেই থাকে। আবার ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গেও কফের একটা সম্পর্ক থাকে।
সূত্রঃ দৈনিক আমারদেশ, ১৬ ডিসেম্বর ২০০৭
লেখকঃ অধ্যাপক (ডা.) ইকবাল হাসান মাহমুদ
লেখকঃ বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ, ডিটিসিডি, পিএইচডি, এফআরসিপি, ইকবাল চেষ্ট সেন্টার, ৮৫, মগবাজার ওয়্যারলেস