সড়ক দুর্ঘটনার দায় কে নিবে?
সড়ক দুর্ঘটনার বিপ্লবে যেন পৌঁছেছি আমরা। পত্র-পত্রিকার পাতায় হাহাকার দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে অনুভূতি যেন ভোতা হয়ে গেছে আমাদের। খুব স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিতে শিখে গেছি। এমনটাই যেন হওয়ার ছিলো, বরং না হওয়াটাই অস্বাভাবিক, এই ধারণাই বদ্ধমূল হয়ে গেছে আমাদের মস্তিষ্কে। এর শেষ কোথায় উত্তর জানা নেই আমাদের কারোর ই! মৃত্যুর এ পথ যাত্রায় যোগ হচ্ছে নতুন তাজা প্রাণের। এ প্রাণ বিয়োগের দায় কে নিবে? রাষ্ট্র নাকি ব্যক্তি নিজেই? প্রশ্নটা স্বাধীন বাংলার স্বাধীন প্রশাসনের কাছে।
২০১৮ সালে সড়কে ঘটেছে ৫ হাজার ৫১৪ টি দুর্ঘটনা, এ ঘটনায় নিহত হয়েছেন, ৭ হাজার ২২১ জন, আহত হয়েছেন ১৫ হাজার ৪৬৬ জন।
সব ঘটনাকেই আমরা সবসময় দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেই। আসলে এগুলো দুর্ঘটনা নয়, ঘটনার সংজ্ঞায়নেই পরে। কিছু ঘটনা আমাদের কারণেই ঘটে থাকে,যাকে দুর্ঘটনা বলা চলে না। ২০১৮ তে ৫ হাজার ৫১৪ টি দুর্ঘটনার মধ্য আমরা নিজেরা কতটা ঘটনার পেছনে দায়ী? খুঁজে বের করতে হবে আগে। না হয় ২০১৯ সালে এমন ১০ হাজার ঘটনা ঘটবেনা, এর নিশ্চয়তাটাই আমরা কতটুকু দিতে পারি?
প্রতিটি ঘটনাকে বিশ্লেষন করে পিছনের কারণ এবং এর পিছনে দায়ী মানুষ গুলোকে শনাক্ত করলে আমরা বোধ হয় রক্ষা পেতে পারি এমন দুর্ঘটনা থেকে।
৭ হাজার ২২১ জনের প্রাণহানি শুধু মাত্র সড়ক দুর্ঘটনায়! সংখ্যার দিক থেকে এটা হিসেব করা যায়, কিন্তু এই ৭ হাজার মানুষের রক্তাক্ত দেহের রক্ত হিসেব করা যায় না। এ দুর্ঘটনায় ৭ হাজার পরিবার ধ্ধংসের মুখে পড়েছে। ৭ হাজার পরিবারের মুখের হাহাকারের দিকে তাকাতে হবে রাষ্ট্রকে। মানব মন কে বিষাদময় করে তুলে এমন হাজারো মানুষের প্রাণহানি। আমরা দূর থেকে তাকিয়ে শুধু সংখ্যার জরিপটাই করতে পারি, উপলব্ধি আমাদের হয় না! এখানে একই পরিবারের একাধিক জনের ও প্রাণহানি ঘটেছে, এতে করে পুরো পরিবার ধ্ধংস।
৭ হাজার সতেজ প্রাণ খোয়া গেছে, এতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে দায়ী আপনি, আমি কিংবা রাষ্ট্র। কিন্তু এর দায়ভার আমরা কেউ ই নিতে চাইনা। মানব মৃত্যুকে মানব হিসেবে আমরা দায় এড়াতে পারি না।
দায়সাড়া মনোভাব আর কতদিন চলবে? সড়ক নিরাপদ করতে আমরা সভা-সেমিনারে তুখোড় বক্তৃতাই সীমাবদ্ধ থাকছি। বিশ্লেষকরাও নানা মতবাদ দিচ্ছেন, কিন্তু কাজের কাজ আসলে কতটা হচ্ছে তা দেখার কেউ নেই। কাল্পনিক জগতেই আমরা ভাসছি। এ কল্পনাকে ভাঙ্গতে হবে বাস্তবতার আঘাতে। ঘুম ভাঙ্গাতে হবে, সকাল যে হয়ে গেছে, আর কত!
একেক মন্ত্রনালয় কিংবা অধিদপ্তর একেক জনের উপর দায় চাপাতে ব্যস্ত। কেউ দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছি না, তাহলে দেখার কি কেউ নেই, যারা নাকি নিশ্চিত তথ্যর ভিত্তিতে একদম ঠিক ব্যবস্থাটাই নিবে। আস্থার জায়গাটা কোথায় আমার, আপনার সহ সকলের?
বিশেষজ্ঞদের মতে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় রোজ মারা যাচ্ছে ৬৪ জন। আর এসব দুর্ঘটনায় ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান বছরে প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা! লাগাম টেনে ধরতে হবে এখনই, না হয় জীবন নিয়ে বাড়ি ফেরা স্বপ্নের মত হয়ে যাবে একসময়।
সড়ককে নিরাপদ করতে হলে, সবার আগে নিরাপদ করতে হবে আমাদের ব্যবস্থাপনাকে। নিরাপদ মানসিকতা দিয়ে অর্জিত হবে নিরাপদ সড়ক। প্রয়োজনে প্রতি জেলা -উপজেলায় বিশেষ ফোর্স করতে হবে। স্পর্শকাতর জায়গা গুলোতে যোগ্য, মানবিকতা আর দায়িত্ববোধ সম্পন্ন মানুষকে আনতে হবে। সব জায়গা সবাই ধরে রাখতে পারেনা।
মাদক বিরোধী আর বর্তমানে দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের মত নিরাপদ সড়ক অভিযান করতে হবে। সামান্য তম ত্রুটির কারণে যাতে প্রাণ না হারায় কেউ, একটু গাফিলতির কারণে যাতে অনেক মানুষের হাহাকার করতে না হয়, ঠিক এরকম ব্যবস্থাপনাই কাম্য দেশের মানুষের।
জনমানুষের ভীতিকে দূর করতে হবে, প্রশাসনের সাহসিকতা দ্বারা। দেশ এগিয়ে যাবে অথচ সড়ক হবে মৃত্যুফাদ তা মেনে নেয়া যায় না।
মহাসড়কের রাস্তা নির্মানের গাফিলতিও দুর্ঘটনার কারণ। রাস্তা ভেঙ্গে যাওয়া কিংবা রাস্তার বাকে অব্যবস্থাপনা ঘটায় দুর্ঘটনা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কড়া জবাবদিহিতার মধ্য আনা জরুরী মানুষের প্রয়োজনেই। সময়ের অনুপাতে টিকে থাকতে হবে, টিকিয়ে রাখতে হবে মানুষকে।
আইন করবে সরকার, আবার এই আইনকে প্রয়োগ এবং গ্রহণযোগ্য করে তুলার দায়িত্ব ও সরকারেই। জনসচেতনতার কথা বলে দায় এড়ালে হবে না, রাষ্ট্রকেই সেই সচেতনতা গড়ে তোলার দায়িত্বটাও নিতে হবে।
সভা-সেমিনারে কথার মধ্য সীমাবদ্ধ রাখলে নিরাপদ সড়ক হবেনা, প্রতিটা জায়গায় ধরে ধরে কাজ করতে হবে। কেন, কী,কোথায়, কে, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে সময়োপযোগী সিন্ধান্ত নেয়া এখনই খুব জরুরী, না হয় রক্তের বন্যায় ভাসবে সড়ক।
মহাসড়কে গাড়ি পাল্লা দেয়ার রেওয়াজ কি ভাবে কমানো যায়, এ বিষয়ে ভাবতে হবে কতৃপক্ষকে। মটর সাইকেল আরোহীদের বেপড়োয়া চালনায় অনেক তরুণ প্রাণের মৃত্যু ঘটে, এ ব্যাপারে লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আনতে হবে। যাত্রী নিরাপত্তায় ব্যবস্থা নিতে হবে, হাইওয়ে পুলিশের তদারকিতে সব সময় একটা শৃঙ্খলার ভেতর রাখতে হবে যান-বাহনকে। প্রত্যকটা জাযগায় সবার নিজ নিজ অবস্থান অনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে, না হয় ভুক্ত ভোগী হবে, আপনি কিংবা আপনার পরিবারেরই কেউ। ‘সকলের তরে সকলে আমরা’ মনোভাবে চলতে হবে।
দুর্ঘটনা থামানো যায়না, তবে প্রতিরোধ করা যায়। এই প্রতিরোধ করাটাই এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব আমাদের। মৃত্যু যাত্রা কমিয়ে, সমৃদ্ধশালী দেশ গঠনই আমাদের প্রথম এবং প্রধান কাজ, সে কাজে সবাই অংশ গ্রহন করাটাও কম কিছু নয়। তাই আসুন সব ভুলে গিয়ে আগামীর সড়ককে আমরা রক্তরঞ্জিত না করে, পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে ভরে দেই, প্রাণের মৃত্যু নয় বরং হাজারো প্রাণ প্রষ্ফুটিত হোক সড়কে।
সোহাগ মনি