বর্তমান আধুনিক যুগের জন্য বিদ্যুৎ অপরিহার্য। বিদ্যুৎ ছাড়া সবকিছু অচল। দৈনন্দিন জীবন বিদ্যুৎ নির্ভর জীবন। যুগ যত আধুনিক হচ্ছে ততই মানবজীবনের প্রতিটি স্তরে বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ কি :
বিদ্যুৎ এমন এক শক্তি যা আলো ,শব্দ ,গতি ইত্যাদি উৎপন্ন করে এবং যার দ্বারা বিভিন্ন কার্য সমাধান করা হয়।
বিদ্যুৎ দুই প্রকার। যথা ১.স্থির বিদ্যুৎ ২.চল বিদ্যুৎ
বিদ্যুৎ কে আবিষ্কার করেন :
বিদ্যুৎ সম্পর্কে আমরা শুনে থাকি মাইকেল ফেরাডে বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেন। কিন্তু বিদ্যুৎ আসলে একজন ব্যক্তির আবিষ্কার নয়। অনেক মহান ব্যক্তি এই আবিষ্কারের পিছনে আছেন।
বিদ্যুৎ শক্তির একটি রূপান্তর। অনেকে বলেন বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন বিদ্যুতের আবিস্কারক। কিন্তু তার পরীক্ষাগুলোতে কেবল বজ্রপাত ও বিদ্যুতের মধ্যে কি সম্পর্ক আছে তা জানা যায়।
বিদ্যুৎ আবিষ্কার কখন হয়েছিল তা বলা মুশকিল। এটি দুই হাজার বছর আগে উদ্ভাবিত হতে পারে।
উইলিয়াম গিলবার্ট নামে একজন ইংরেজ চিকিৎসক কিছু বস্তুর উপর ঘর্ষণের ফলে উৎপাদিত বলকে electricus শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। টমাস ব্রাউন নামে আরেকজন বিজ্ঞনী বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন ও গিলবার্টের কাজের উপর ভিত্তি করে তার তদন্ত বর্ণনা করে ইলেকট্রিসিটি শব্দটা ব্যবহার করেছেন।
বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন এই ধারণা ব্যক্ত করেন যে বিদ্যুৎ এর পজিটিভ ও নেগেটিভ নামে দুটি উপাদান রয়েছে। এবং এই উপাদানের ভিতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। তার মতে আকাশের বজ্রপাত হল বিদ্যুতের একটি রূপ।
তিনি কিছু কাজ করে এই ধারণা প্রমান করেন যে বজ্রপাত ও ক্ষুদ্র ইলেক্ট্রিক স্পার্ক একই জিনিস। পরবর্তীতে অনেক বিজ্ঞানী এ ধারণা থেকে বিদ্যুৎ সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছেন। যেমন টমাস আলভা এডিসন ১৮৭৯ সালে বৈদ্যুতিক বাল্ভ আবিষ্কার করেন।
মাইকেল ফেরাডে নামে একজন বিজ্ঞানী একটি ইলেকট্রিক dianamo তৈরী করেন। যেটি এখন বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করছে। তিনি তার জেনারেটরে একটি চুম্বক ব্যবহার করতেন যার ফলে তামার তারের ভিতর ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ সৃষ্টি হতো।
১৯০০ সালের শুরুতে আমেরিকান প্রকৌশলী নিকোলা টেসলা বাণিজ্যিক ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। তিনি টমাস এডিসনের সাথে কাজ করে ইলেক্ট্রো-মাগনেটিজম এর অনেক বিপ্লবী উন্নয়ন ঘটান। তিনি এসি ,এসি মোটর,পলিফেস ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম তৈরী করেন।
আমেরিকান বিজ্ঞানী জর্জ ওয়েস্টিংহাউস অল্টারনেটিং কারেন্ট উৎপাদন করেন। তিনি তার কাজ দ্বারা আমেরিকান সমাজকে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করলেন যে বিদ্যুতের ভবিষ্যত ডিসি র পরিবর্তে এসি এর উপর বেশি নির্ভরশীল হবে।
অতএব বলা যায় ,কেবল একজন মানুষ বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেননি। অনেক মহান মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের দ্বারা আজ বিদ্যুৎ এই অবস্থায় এসেছে।
বিদ্যুৎ কিভাবে উৎপাদন করা হয় :
বিদ্যুৎ কিভাবে তৈরী হয় অনেকেই জানেনা। এটি তৈরী হয় টারবাইন ঘুরিয়ে। এই টারবাইন যখন পানির প্রচন্ড চাপে ঘুরে তখন বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পে এভাবেই বিদ্যুৎ উৎপাদিত করা হয়।
অনেক দেশে জলপ্রপাতের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। জলপ্রপাতের পানি যখন প্রচন্ড বেগে নিচের দিকে নামে তখন সেখানে থাকে টারবাইনের বড় বড় পাখা। এই পাখা যখন ঘুরতে থাকে পানির চাপে তখন বিদ্যুৎ তৈরী হয়।
এখন সাগরের ঢেউকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। সাগরের ঢেউ গুলো বিরামহীন ভাবে তীরে আছড়ে পড়ে। সাগরের তীরে যখন ঢেউ আছড়ে পড়বে তখন সেখানে থাকবে ব্লেডের পাখা। এর ফলে পাখা ঘুরবে এবং বিদ্যুৎ তৈরী হবে।
সৌরবিদ্যুৎ :
সৌরবিদ্যুৎ হল এমন এক পক্রিয়া যেখানে সূর্যরশ্মিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করা হয়। আজকাল অনেকের বাড়ির ছাদে একটা প্যানেল দেখা যায়। এটি ব্যবহার করা হয় সূর্য আলোকে কাজে লাগিয়ে শক্তি সঞ্চয় করার জন্য।
এই শক্তি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ এই দুইভাবে কাজ করে থাকে। প্রত্যক্ষ ভাবে সূর্যশক্তি ব্যবহার করাকে বলে ফটো ভোল্টাইক ও পরোক্ষটাকে বলা হয় কন্সেন্ট্রেডেট সোলার পাওয়ার।
সৌরবিদ্যুৎ আবিষ্কার করেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং।
বাংলাদেশে এখন সৌরবিদ্যুৎ বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। গ্রামাঞ্চলে ষাট লাখের বেশি বাড়িতে এখন সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহৃত হচ্ছে।
দেশে প্রথম বারের মতো সরকারিভাবে স্থাপিত হয়েছে একটি সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সেই কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রীডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হচ্ছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র :
বাংলাদেশে বর্তমানে পাঁচ ধরণের বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এগুলি হল ১.গ্যাস টারবাইন ২.স্টিম টারবাইন ৩.হাইড্রো পাওয়ার প্লান্ট ৪.কম্বাইন্ড সাইকেল গ্যাস টারবাইন ৫.উইন্ড টারবাইন পাওয়ার প্লান্ট।
স্টিম টারবাইন কেন্দ্রগুলোতে প্রাকৃতিক গ্যাসের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। দেশের সব চাইতে বড় স্টিম টারবাইন কেন্দ্রটি নরসিংদী জেলায় অবস্থিত। এ কেন্দ্র থেকে ৯৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।
গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে হরিপুরে প্রতিটি ৩৩ মেগাওয়াট সম্পন্ন তিনটি বেজ লোড প্লান্ট ইউনিট ও সিদ্ধিরগঞ্জে ১০৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি পিকিং প্লান্ট ইউনিট রয়েছে।
বাংলাদেশের রাঙামাটি জেলায় একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র অবস্থিত। এই কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়।
কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র অবস্থিত দিনাজপুর জেলার বড় পুকুরিয়ায়। এখানে ১২৫ মেগাওয়াট সম্পন্ন দুটি ইউনিট রয়েছে।
খুলনা জেলায় রয়েছে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট। এ কেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১৭০ মেগাওয়াট।
ফেনীতে দেশের প্রথম বায়ুভিত্তিক বিদ্দুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। এ কেন্দ্রে ০.৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
পাবনার রূপপুরে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হতে যাচ্ছে। রাশিয়ার সাথে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ কেন্দ্রে প্রতিটি ১০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন দুটি
ইউনিট স্থাপন করা হবে।
বিদ্যুৎ কিভাবে সাশ্রয় করবেন :
বিদ্যুৎ আমাদের জাতীয় সম্পদ। এই বিদ্যুৎ যাতে অপচয় না হয় সেদিকে সবাইকে নজর দিতে হবে। কারণ এই সম্পদ অপচয় করলে ক্ষতি আমাদের হবে। আমরা যদি সচেতন না হই তবে মাস শেষে বেশি বিল আসবে। তাই বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য সচেতনতা জরুরি। কিছু পদক্ষেপ নিলে বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয় হতে বাধ্য।
মেশিন বা ইস্ত্রি ব্যবহার না করলে প্লাগ খুলে রাখতে হবে। কারণ প্লাগ খুলে না রাখলে কিছুটা বিদ্যুৎ ব্যায় হতে পারে।
ঘরে না থাকলে আলো বা ফ্যানের সুইচ অন করে রাখবেন না।
সবসময় এসি চালানোর দরকার নেই। কারণ এসিতে বিদ্যুৎ বিল বেশি আসে। গরম বেশি না হলে ফ্যান চালিয়ে রাখুন।
ল্যাপটপ বা কম্পিউটার ব্যবহার না করলে অফ করে রাখুন। এতে বিদ্যুৎ খরচ অনেক কমবে।
রান্না করার সময় বার বার ওভেনের দরজা খুললে তাপমাত্রা কমে যায়। ফলে ওভেন আগের তাপমাত্রায় ফিরে যেতে বিদ্যুৎ খরচ বেশি হয়।
ঘরে এনার্জি সেভিংস ভাল্ব ব্যবহার করুন। লাল আলোর সস্তা ভাল্বগুলো ব্যবহার না করাই উত্তম।
যেহেতু বিদ্যুৎ একটি জাতীয় সম্পদ তাই এর যাতে অপচয় না হয় সেদিকে সবাইকে নজর দিতে হবে। আজকাল অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে বিদ্যুৎ না থাকলে আমরা একদিনও চলতে পারিনা।