এক সিংহ বয়স হয়ে যাওয়ায় শিকার ধরতে পারছিল না । দিন দুই খাবার না জোটায় সে নিজের গুহাতেই পড়ে ছিল । কিন্তু খিদের জ্বালা বড় জ্বালা । অসহ্য হয়ে সে তার অনুচর শেয়ালকে ডেকে বলল , ওহে আর তো পারছি না । আমার সঙ্গে সঙ্গে তোমারও অনাহারে দিন কাটছে । যেমন করে পার অন্ততঃ একটা হরিণকে তুলিয়ে তালিয়ে আমার কাছে নিয়ে এসো । সিংহের কথায় শেয়াল তখনি হরিণ খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল ।
কিছুদূর গিয়ে দেখতে পেল একটা বেশ হৃষ্টপুষ্ট হরিণ ঘাসের বনে চরছে । সে এগিয়ে গিয়ে মোলায়েম গলায় ডেকে বলল , ও ডাই হরিণ , আমি যে একটা সুখবর দেবার জন্য তোমাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছি । ঘাস থেকে মাথা তুলে হরিণ বলল , সুখবরটা কী শুনি । শেয়াল বলল , তুমি তো জান পশুরাজ সিংহ বুড়ো হয়েছেন । এখন আর চলতে ফিরতেও পারেন না । তার পরে কে পশুদের রাজা হবে এই নিয়ে তিনি খুবই ভাবনায় পড়েছেন । দেখো , বুনো শুয়োরের গায়ে হল আছে , কিন্তু তারা বড়ই গোঁয়ার । ভালমন্দ বোঝে না । তালুও বলবান প্রাণী । কিন্তু বেজায় আলসে ।
দিনভর ঘুমুতে পেলে আর কিছু চায় না । আর আছে নেকড়ে । কিন্তু এরা এত অস্থির যে রাজার কাজে তাদের মানায় না । মহারাজ সিংহ বলেন , সবদিক দিয়ে কেবল হরিণরাই পশুদের রাজা হওয়ার উপযুক্ত । তারা সব জন্তুর চাইতে দেখতে সুন্দর । ছুঁচলো শিং জোড়া সকলেই ভয় পায় । তার ওপরে তোমাদের আয়ুও অনেক দিন । হরিণদের মধ্যে তুমি আবার সবার চাইতে বলবান ও সুন্দর । তাই পশুরাজ সিংহ স্থির করেছেন , মরার আগে তোমাকেই পশুদের রাজা করে যাবেন । এই সুখবরটা দেবার জন্যই আমি তোমার খোঁজ করছিলাম । শেয়াল আবার বলল , তোমাকে একটা কথা বলি শোন , তুমি আমার সঙ্গে চল । সিংহের এখন তখন অবস্থা । এই সময় তোমাকে কাছে পেলে নিশ্চিস্ত হবেন ।
ধূর্ত শেয়ালের মিষ্ট কথায় হরিণের মন গলে গেল সে ভাবল , সত্যিই তার অনেক গুণ । পশুদের রাজা হতে হলে তারই হওয়া উচিত । এই ভেবে সে শেয়ালকে বলল , এত করে যখন বলছো , তাহলে চলো , যাওয়া যাক । ছলনায় ভুলে হরিণ চলল শেয়ালের সঙ্গে । কিন্তু সিংহের গুহায় ঢুকতে না ঢুকতেই সিংহ লাফিয়ে এসে পড়ল তার ঘাড়ে একে বুড়ো বয়স তার ওপরে উপোসে দুর্বল শরীর । সিংহ তাই জুতমতো হরিণকে ধরতে পারল না । তার থাবার নথ লেগে হরিণের দুই কান ছড়ে গেল । সেই অবস্থাতেই সে পড়িমরি করে ছুটে বনে পালিয়ে গেল।শেয়াল হায় হায় করে উঠল । সিংহ অগ্রস্তুত হয়ে বলল , বড্ড ফস্কে গেল ছে । তুমি আর একবার চেষ্টা করো । নিশ্চয় অন্য কোনও হরিণকে নিয়ে আসতে পারবে । খিদে আর সহ্য হচ্ছে না । চেষ্টা করে । শেয়াল বলল , মহারাজ , কাজটা বড় কঠিন ।
তবু বলছেন যখন দেখি গুহা থেকে বেরিয়ে শেয়াল হরিণের পায়ের ছাপ দেখে দেখে বনের দিকে এগিয়ে চলল । এদিকে হরিণ হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে তয়ে – ময়ে অনেকটা পথ ছুটে চলে এসেছিল । ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে সে এক গাছতলায় শুয়েছিল । তাকে খুঁজে খুঁজে কিছুক্ষণের মধ্যেই শেয়াল হাজির হল সেখানে । সে হরিণকে বলল , কী ভায়া , বোকার মতো অমন করে পালিয়ে এলে কেন ? হরিণ রাগে চিৎকার করে বলে উঠল , ওরে শয়তান শেয়াল , তুই আবার এসেছিস ? শিগগির এখান থেকে পালা নইলে শিং দিয়ে এখুনি তোর পেট ফুটো করে দেব । ভেবেছিস তোর মিষ্টি কথায় ভুলে আমি আবার ফাঁদে পা দেব । তোকে চিনতে আমার বাকি নেই । যারা তোকে চেনে না , তাদের গিয়ে রাজা করবার লোভ দেখা গে ।অবাক হবার ভান করে শেয়াল বলল , তুমি যে এমন নিরেট তা তো জানা ছিল না হে ।
যে তোমার সবচেয়ে বড় বন্ধু , তাকেই তুমি ভুল বুঝছ ? পশুরাজের উদ্দেশ্যটা তুমি বুঝতে পারনি বলেই অমন কথা বলছ । তুমি পশুদের রাজা হবে , তাই তিনি চেয়েছিলেন তার শেষ উপদেশ তোমার কানে । কানে বলে যাবেন । আর তুমি ভাবলে তিনি তোমায় আক্রমণ করেছেন । এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি পশুদের রাজা হবে কি করে ? একটু থেমে শেয়াল আবার বলল , মহারাজ তোমার ব্যবহারে খুবই দুঃখ পেয়েছেন । তিনি এখন ভেবেছেন নেকড়েকেই রাজা করবেন । আর নেকড়ে রাজা হলে আমাদের সকলেরই অমঙ্গল । তাই আমি আবার তোমাকে বলতে এলাম । মিছে ভয় পেয়ে এমন সুযোগটা হারিও না । মহারাজের সঙ্গে এখুনি গিয়ে দেখা কর । আমি শপথ করে বলছি , তিনি আর তোমাকে ছোঁবেন না ।
এখনও সময় আছে , যদি তাকে খুশি করতে পার , তুমিই হবে আমাদের রাজা । হরিণটা ছিল খুবই সরল । তাই শেয়ালের ছলাকলায় ভুলে রাজা হবার লোভে আবার রওনা হল সিংহের গুহার দিকে । এবারে সিংহ তৈরি হয়েই ছিল । হরিণ গুহার মুখে পৌছবার সঙ্গে সঙ্গেই লাফিয়ে পড়ে তার ঘাড় কামড়ে ধরে এক ঝটকায় মেরে ফেলল । খিদেয় পেট জ্বলছিল সিংহের । তাই তার আর সবুর সইল না । খাবলা খাবলা মাংস তুলে গিলতে লাগল । শেয়ালের দিকে একবার ফিরেও তাকাল না । শেয়াল দূরে বসে সিংহের খাওয়া দেখছিল । সে লক্ষ্য রাখছিল কখন হরিণের হৃদপিণ্ডটা দেখা যায় ।
এক সময় নাড়িভুড়ির সঙ্গে হৃদপিণ্ডটা বেরিয়ে এল । অমনি শেয়াল চুপি চুপি পেছন থেকে গিয়ে সেটা মুখে পুরে আবার জায়গায় বসে পড়ল । সিংহ কিছুই টের পেল না । খেতে খেতে হরিণের মাংসের মধ্যে হৃদপিণ্ডটা খুঁজে না পেয়ে সিংহ শেয়ালকে বলল , ওহে পণ্ডিত , সুস্বাদু হৃদয়টা তো দেখছি না কোথাও । দূরে থেকেই শেয়াল বল্ল , মহারাজ , ওটা খুঁজে পাবেন না । ওই হরিণটা ছিল হৃদয়হীন । যে প্রাণীর শরীরে হৃদয় থাকে , সে একবার আক্রান্ত হয়ে দ্বিতীয়বার সিংহের গুহায় ফিরে আসে না ।