স্যার আসবো?
সুনীল বাবু বাইরে তাকিয়ে মেয়েটিকে দেখেই বিরক্ত হয়ে গেলো।প্রথম দিনের ক্লাস এমন একটি কুৎসিত মেয়ের চেহারা দেখে শুরু করতে হবে তাহলে।
-নাম কী তোমার?সুনীল বাবু ধমকে ওঠেন।
-স্যার আ….আ….আমার না…..ম শ্যা….মা।
-কী আমতা আমতা করছো!
-স্যার আমার নাম শ্যামা সরকার।
-তাকিয়ে দেখো তোমরা,মেয়েটার দিকে।এমন কালো মেয়ে বোধয় আফ্রিকায় ও জন্মায় না।মুখটা কেমন তেল চিটচিটে!পোশাক দেখে তো ভিখিরির মতো লাগছে!জীবনে কোনদিন শ্যাম্পু করেছে কী না কে জানে!
সুনীল বাবু নিচু গলায় সামনের বেঞ্চের স্টুডেন্টদের বলেন যদিও সেটা শুনতে পায় শ্যামা।
-এই মেয়ে শ্যাম্পু চেনো শ্যাম্পু?
সুনীল বাবু ক্লাসের বাইরে আধ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটাকে বলে। ক্লাসের সবাই শব্দ করে হেসে ওঠে। মেয়েটা লজ্জায়,অপমানে আর ভয়ে মাথাটা নিচু করে থাকে।বলার যে কোন ভাষা নেই তার কাছে।
-আচ্ছা মেয়ে শোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার জন্য এসেছো কোচিং করতে?আমাদের কোচিং সেন্টারের একটা রেপুটেশন আছে বুঝেছো।একী তো মুখের কী শ্রী।তার উপর এমন উদ্ভটের মতো এসেছো।আশেপাশের মানুষ যদি জানে তুমি আমাদের কোচিং সেন্টারের স্টুডেন্ট আমাদের স্ট্যাটাস ধুলোয় মিশবে।শোন মেয়ে কাল থেকে সুন্দর পোশাক পড়ে,সেজেগুজে আসবে।আমাদের কোচিং সেন্টারের স্টুডেন্টদের দেখো।কতো স্মার্ট এরা।এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেলে কী তোমার মতো অজপাড়া গাঁয়ের মেয়ে পাবে!নেহাত টাকার জোরে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে পেরেছো।ভিতরে এসে বসো।
সুনীল বাবু তার দীর্ঘ সংলাপ শেষ করে। বাইরে থেকে ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে ক্লাসে ঢোকে অমাবস্যার মতো গায়ের রঙের সেই মেয়েটি। সেদিন অপমানটাকে গায়ে মেখে নেয় শ্যামা।
এই শ্যামাঙ্গিনীর নাম শ্যামা।জন্মের পর ধাইমা বলেছিলো এমন কালো মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি বাপু।মা সরস্বতী অভিশাপ দিয়েছে একে। মেয়ের নাম রাখা হলো শ্যামা।জীবনের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে এই কালো মেঘের মতো গায়ের রঙ নিয়ে তাকে খুব কথা শুনতে হয়েছে।কিন্তু জীবনের একটা পর্যায়ে শ্যামা বুঝতে পারলো মা সরস্বতী তাকে এতোটাও বোধহয় অভিশাপ দেননি।কিছুটা আশির্বাদও দিয়েছিলেন।বিদ্যার আশির্বাদ।মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডী পেরিয়ে এই ঢাকা শহরে পদার্পণ তার।কিন্তু এখানেও সে বুঝলো সুন্দর এই পৃথিবীটায় কালো রঙ বড্ড বেমানান।চার মাস কেটে গেলো।বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার রেসাল্ট দিয়েছে আজ।প্রচন্ড ভীর ক্যাম্পাসে।
কেউ কেউ রেসাল্ট বোর্ডে নিজের নাম দেখে উৎফুল্ল হয়ে ফিরছে।কেউ কেউ হতাশ হয়ে ফিরছে। এতো ভীড়ের মধ্যে সুনীল বাবুও আছেন।তার কোচিং সেন্টারের কত জন স্টুডেন্ট চান্স পেলো তা দেখতে এসেছেন তিনি।অনেক ভীড় ঠেলে সুনীল বাবু বোর্ডের কাছে এগিয়ে যান।পায়ের জুতার একটা উধাও হয়ে গেছে ততক্ষণে। ছাত্রদের ধাক্কাও কম খাননি।সুনীল বাবু পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভীর প্রায়ই কমে যায়।অতঃপর বোর্ডের সামনে পৌছান তিনি।হাত দিয়ে বোর্ডের শীর্ষ থেকে শুরু করবে বলে যেইনা বোর্ডে তাকায় তার চোখ আটকে যায় বোর্ডের প্রথম নামটিতে।
সুনীল বাবু তার চশমাটা হাতে নিয়ে তা মুছে নেন রুমাল দিয়ে।তারপর আবার তাকান।না সে যে ভুল দেখেনি।সিরিয়ালের ১ নং এ স্পষ্ট করে লেখা “শ্যামা সরকার”।পাশে তাকিয়েই ভূত দেখার মতো চমকে যান।হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্যামা।আশ্চর্য এই চার মাসে মেয়েটার মুখে কোনদিন হাসি দেখেননি তিনি।চারদিকে ভীড় কমে এসেছে।সূর্যের আলো শ্যামার হাস্যোজ্জ্বল মুখের ওপর পড়েছে।কী সুন্দর লাগছে শ্যামাকে।পৃথিবীর যেকোন স্বেতাঙ্গীনীর রূপ যেন এ রূপের কাছে হার মানায়।কালো মেঘের রঙ যেন আজ সূর্যের কিরণকেও হারিয়ে দিয়েছে।