রাত্রি তখন ঠিক কটা বাজে আমার মনে নেই। মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেছে সেই অনেকক্ষণ আগে। হাতে ঘড়ি থাকলেও আমি ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি না। আমি যে সিচুয়েশনের মধ্যে করেছি সেখানে ঘড়ির কাটার কোন মূল্য নেই। যেদিকে তাকাচ্ছি শুধু বালি কনার এক বিশাল সাম্রাজ্য। বাম দিকে তাকাতেই মনে হয় যেন দূরে, অনেক দূরে কিছু ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। আমি সে দিকে এগোতে লাগলাম। কিন্তু আমি যতই এগোচ্ছি ততই সেই ঘরবাড়িগুলো দূরের দিকে সরে যাচ্ছে।
তখন আমি বুঝতে পারলাম আমি গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছি। সবকিছুই মরীচিকার মত লাগছে। আকাশের দিকে তাকাতেই দেখলাম জোসনা টা স্বাভাবিকের থেকে একটু বড়। অদ্ভুত এক আলোতে পুরো বালির চর একদম ধবধবে সাদা হয়ে যাচ্ছে। ভেবেছিলাম কিছু শিয়াল কুকুরের ডাক শুনতে পাব। কিন্তু না তেমনটি হচ্ছে না। আমি নিজের উপর নিজে বিশ্বাস হারাতে শুরু করলাম। মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হচ্ছিল আমি এত বড় ভুলটা কিভাবে করলাম। তবুও সাতপাঁচ না ভেবে আমি শুধু সামনের দিকেই এগুতে লাগলাম।
কিছুদূর এগিয়ে যেতেই দেখলাম আমার সামনে নদীর কূল।অর্থাৎ নদীটি এঁকেবেঁকে অনেক শাখা-প্রশাখা তৈরি করে গেছে। এখান দিয়ে একটি নালা তৈরি হয়ে গেছে। নালার ওই পারে আবার চর। এপার থেকে ওপারে ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। আমি প্রচন্ড পরিমাণ বিব্রত হতে শুরু করলাম। আমার হাতের ব্যাগটি আমার কাছে খুব ভারী ভারী মনে হতে লাগলো। মনে হচ্ছিল সব কিছু ফেলে দিয়ে এখানে শুয়ে পড়ি। সকালবেলা কোন না কোন কিছু খুঁজে পাবো। তবুও মন মানছে না। আষাঢ় চাহিদাটা কে আরো বাড়িয়ে, আমি এগোতে লাগলাম।
মনকে অনেক সাহস দিতে শুরু করলাম। মনে মনে ভাবছিলাম আমি খুব সাহসী। তবে মনের ভেতরের অবস্থাটা আমি আন্দাজ করতে পারছিলাম । এখন আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আমার আর কোন পথ নেই। আমি কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে নদীর কিনারায় বসে পড়লাম।মনে মনে ভাবতে লাগলাম এতক্ষণ তো শুধু বালিয়ার বালি দেখতে পেয়েছি এখন নদীর কুল টা তো পেলাম। নিশ্চয়ই এখান দিয়ে মানুষজন যাতায়াত করে। কিছু কিছু মানুষের পায়ের ছাপগুলো স্পষ্ট সে কথারই ইঙ্গিত করছিল। মনে মনে একটু খুশি হলাম। তাহলে মানুষ এই পথ দিয়ে যাতায়াত করে। কিন্তু একটু চিন্তাভাবনা করে দেখলাম সম্ভবত সব সময় যাতায়াত করে না মাঝে মাঝে মানুষ হয়তো এখানে আসা যাওয়া করে।
তবুও মনের মাঝে আশার এক বিশাল সঞ্চার শুরু হয়ে গেল। আমি নদীর পাড়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। নদীর পানি গুলো অদ্ভুত এক রং ধারণ করেছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে নীল আবার মনে হচ্ছে ঘোলাটে। জ্যোৎস্নার আলোতে নদীর মাঝে চিকচিক চিকচিক এক বৈচিত্রময় সৌন্দর্য আমি আমার মনকে আনন্দদায়ক করে তুলতে পারছি না।। হয়তো অন্য কোন সময় হলে খুব ভাল লাগতো। কিন্তু এখন আমি কি করবো? কোন কিছুই ভেবে উঠতে পারছিলাম না। বারবার শুধু পিছনের দিকে ফিরে তাকাচ্ছি। এদিক ওদিক তাকিয়ে কোন লাভ হল না।
প্রকৃতপক্ষে যেটা বোঝা যাচ্ছে সেটা হল এখানে কোন মানুষের বসবাসই নেই। একটু দূরে চোখ মেলে দেখলাম কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। টর্চের আলোতে আমি নিশ্চিত হয়ে নিলাম। এটা কোন কিছুই নয় একটি বড়ই গাছ। আমি সেদিকে এগুলো সাহস পেলাম না। ভাবলাম যা হবার তা এখানেই হোক। আমি দুই হাত মাটিতে চেপে আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম। এখন ধীরে ধীরে আমার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হতে শুরু করল। মনে হচ্ছিল সেই নৌকার মাঝি, যাকে আমি কাকা বলে সম্বোধন করেছি, সেই লোকটি আমাকে ভুল কোন জায়গায় নামিয়ে দিয়েছে। যদিও আমি ততক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিত নই। কারণ আমি এখানে নতুন। একদম নতুন যেখানে আমার কখনোই আসার কথা ছিল না।
যাই হোক একদম হান্ডেট পার্সেন্ট নিশ্চিত হলাম আজ আমার বিপদ আছে। যতই রাত্রি গভীর হচ্ছে ততই আমার মনের মাঝে হৃদপিণ্ডটা কাঁপছে। আমি ইচ্ছে করেই ঘড়ির টাইম দেখছি না। কারণ এখন টাইম দেখে লাভ নেই। সময় যাই হোক না কেন আমাকে রাত্রিবেলা এখানের কাটাতে হবে। এই কথাটা একদম নিশ্চিত।আমি নদীর পানিতে কিছুটা নেমে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। ধুলোবালিতে জামা কাপড় নষ্ট হয়ে গেছে। প্যান্টি আমি একটু গুছিয়ে নিলাম। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটি হচ্ছে সেটা হচ্ছে প্রচন্ড পরিমাণ ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে এখন।
চারিদিক থেকে হিমেল হাওয়া ভেসে আসছে। কিছুটা কুয়াশা চারদিকটা আর অন্ধকার করে দিচ্ছে।এখন নদীর মাঝখানে তাকালেও আমি সেখানে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। এমন একটি থমথমে পরিস্থিতি আমি কিভাবে সামাল দিব সেটা আমি নিজেও ভেবে পাচ্ছিনা। কারণ আমি একদম একা। এই পুরো চর একদম ফাঁকা। সেখানে আমি ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে আমার মনে হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। যদি একটি কুকুর বিড়ালও সেখানে থাকত তাহলে ও হয়তো তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে কিছুটা সাহস যুগিয়ে নিতাম। কিন্তু আমার ভাগ্যে এরকম কোন কিছুই হলো না। কিছুক্ষণ আগেও যেখানে আমি ঘেমে গিয়েছিলাম সেখানে শীতে আমার শোরীল বরফ হয়ে আসছে।
এখানে হয়তো শীতটা একটু বেশি বেশি লাগছে। তবু কিছু করার নেই। আমি পুরোপুরি ফেঁসে গেছি। বিষয়টি আসলে ফেঁসে যাওয়ার মত এই। পুরো এই দ্বীপের মতো চর , আমি একা কোন প্রাণী। এখনো যদি আমার মনে হয় সেদিনের কথা আমার শরীরের লোম গুলো একদম খাড়া খাড়া হয়ে যায়। ভেবে দেখ দেখি আসলেই তো জিনিসটা ভয়ের। একা একজন মানুষ, এত বড় একটি চরে, যেখানে কোন প্রাণীর অস্তিত্ব নেই, সেখানে এক ভয়ঙ্কর রাত্রিবেলা একা একা কিভাবে থাকা সম্ভব। তবুও অসম্ভবকে সম্ভব করার একটি প্রয়াস নিয়ে আমি নদীর কূলে বসে রইলাম।
ঘন্টা দুয়েক এভাবেই পার করলাম। কিন্তু সমস্যাটা শুরু হলো ঠিক তখনই। মাঝে মাঝে নদীর পানি গুলোতে কল কল শব্দ। এই শব্দগুলো একটুও অস্বাভাবিক। আমার মনে হচ্ছিল পানির ভেতর থেকে কিছু একটা উঠে আসবে। আমি সেদিকে টর্চলাইট মারছিলাম। কিন্তু আমি যখন টর্চের আলো ফেলে তখন কোন কিছুই দেখতে পাই না। ভিতরে ভিতরে ভয়ের মাত্রাটা 104 কে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এবার ভাবলাম না ভয় পেয়ে লাভ নেই যা হবার তাই হবে। মিথ্যে মিথ্যে এবং মিছেমিছি মনকে শান্ত করার জন্য আমি সব বলে যাচ্ছিলাম। প্রকৃতপক্ষে আমি আমার মধ্যেই ছিলাম না।
এতটা ভয় আমি জীবনে কখনো পাইনি। রাত্রি গভীর হতে শুরু করল। তখন ঠিক কটা বাজে আমার জানা নেই।ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখে ঝাপসা ঝাপসা দেখতে শুরু করেছি তা আমি নিজেও জানিনা। হঠাৎ আমি দেখতে শুরু করি, আমি কল্পনায় দেখছি নাকি বাস্তবে দেখছি সেটা বুঝে উঠতে পারছি না। আমার শরীরটা পাথরের মত হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হচ্ছিল আমি কোন সিনেমা হলে বসে সিনেমা দেখছি। আমি দেখতে লাগলাম, একদল লোক মাথায় টুপি পরা। তারা দলবেঁধে নদীর মাঝ থেকে উঠে আসছে।আমি অবাক না হয়ে সেই দৃশ্যগুলো মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলাম। তাদের প্রত্যেকের মুখেই কিছু না কিছু শোনা যাচ্ছিল। আমি নিজেকে সাহস দিতে লাগলাম।
আমি বোধ হয় স্বপ্ন দেখছি।মনে মনে ভাবছি যদি স্বপ্ন হতো তাহলে তো আমি বেঁচে গেলাম। নিজেকে নিজে চিমটি কাটছি। কিন্তু না সেই লোক গুলো আমার দিকে আসতে লাগলো। সামনের লোক গুলোর কাঁধে কোন কিছু রাখা আছে , ঠিক মৃত ব্যক্তির লাশ যেমন মানুষ জানাজা করতে নিয়ে যায় ঠিক সেইরকম। তাঁরা ধীরে ধীরে আমার সামনে আসতে শুরু করল। তাদের প্রত্যেকের চোখ গুলো আমার চোখের দিকে তাক করা।
আমার থেকে তারা বেশি দূরে নয়। কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে তাদের আচরণ এবং বাচনভঙ্গি গুলো একদম পজেটিভ। লোকগুলো দেখে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তারা আমার সামনে আসতে লাগলো। ততক্ষনে আমার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারব না। আমি শুধু তাকিয়ে আছি তারা অন্যদিকে না যে আমার দিকে কেন আসছে।এত রাত্রি বেলা যেখানে কোন মানুষের চিহ্ন নেই সেখানে এতগুলো মানুষ কোথা থেকে আসছে। বিষয়টি নিয়ে ভাববার মতো সময় আমার ছিলনা। লোক গুলো আমার খুব কাছে চলে এলো।
এবার আমি সবচেয়ে বেশি অবাক হলাম। লোক গুলো আমার সামনে এসে ডান দিক দিয়ে চলে যেতে লাগলো।তাদের গায়ের থেকে খুব সুন্দর আতরের গন্ধ আসতে লাগলো। মনে হচ্ছিল লোক গুলো খুব পবিত্র মনের। তারা একটি কথা ও আমার সাথে বলল না। তারা কিছুদূর গিয়ে সবাই থেকে পড়ল। এবার আমি একটু বেশি ভয় পেতে শুরু করলাম। আমার ভাইয়ের মাত্রাটা হয়তো আমি ভাষায় বুঝাতে পারব না। শুধু অনুভবের স্কেলে এটাকে মাপা সম্ভব। তারা তাদের মাথার উপর থেকে খাটিয়া টা নামিয়ে । সবাই পিছনের দিকে ফিরে তাকাল।
আমিও কোন রোবটের মত তাদের দিকে তাকিয়ে আছি। না থাকি উপায় উপায় নেই। প্রাকৃতিকভাবেই তাদের দিকে তাকিয়ে আছি। তবে শেষবার আমি যা দেখলাম তা আমার কল্পনাতেও আমি কখনো দেখিনি। যে খাঁটি তারা নাম নিয়েছে, এবার সে খাটিয়া থেকে মরা লাশ উঠে দাঁড়ালো।আস্তে আস্তে তার মুখে থেকে কাফনের কাপড় সরতে লাগালো। আমি এবার সবচেয়ে বেশি ভয় পেতে শুরু করলাম। মনের মাঝে আমার অনেক উৎসাহ দেখি লোকটা কে হতে পারে। তবে আমি যা দেখেছিলাম সে কথা আমি আর বলতে চাই না। শুধু এতোটুকুই আমার মনে আছে,।
খুব সকালবেলা আমার ঘুম ভাঙ্গে। আমি নিজেকে আবিষ্কার করি চরের ঠিক মাঝখানে। আমার মাথার উপর তখন সূর্যমামা হেলে পড়েছে। আমি নিজেকে হাতিয়ে এ দেখছি। আমি কি সত্যিই বেঁচে আছি। নাকি আমি সব কিছু ভুল দেখছি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে শুকরিয়া আদায় করে নিলাম। গায়ে চিমটি কেটে দেখলাম আমি সত্যি সত্যিই বেঁচে আছি। পরদিন আমি অনেক কষ্টে সেখান থেকে মুক্তিলাভ করলাম।
কিছু মাঝি এসেছিলেন মাছ ধরার জন্য। আমি তাদের কাছে সকল কিছু বর্ণনা করার পর তার আমাকে নৌকা দিয়ে পার করে দিয়েছিল। আমি ফুপিকে আর দেখতে যেতে পারিনি। হয়তো আর কোনদিন পারবো না। ঘটনাটি একদম আমার বাস্তব জীবনের। তবে একথা সত্যি যে আমি কোনদিন মর্গের লাশ দেখেও এতটা ভয় পাইনি। আমার শরীরের লোম আজও দাঁড়িয়ে যায়, সেদিনের সেই ঘটনাটি মনে পড়ে গেলে।
ঘটনাটি ভালো লাগলে কমেন্ট করে জানাবেন। Writing by: Momin Sagar, phone: 01755321309,