* ক্লিওপেট্রা : এক রহস্যময়ী নারীর ইতিবৃত্ত •••
ক্লিওপেট্রার জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৬৯ সালের প্রাচীন মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায়। তার পুরা নাম ছিলো ক্লিওপেট্রা সপ্তম ফিলোপেটর। মেসিডোনিয়ান বংশোদ্ভূত সপ্তম মিসরীয় রানী হওয়ায় তাকে এই পরিচিতি বহন করতে হয়। গ্রিক শব্দ kleos আর pater থেকেই ক্লিওপেট্রা। যার স্ত্রী বাচক অর্থ করলে দাঁড়ায় “গ্লোরী অফ দ্য ফাদার“। তার আগে আরো ছয়জন কিওপেট্রা ছিলেন।তার পূর্বপুরুষ টলেমি ছিলেন মহামতি আলেক্সান্ডারের একজন সেনাপতি।খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ সালে আলেক্সান্ডার মারা গেলে তার অন্যতম সেনাপতি টলেমি মিসরে স্বাধীন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। কিওপেট্রা এই বংশেরই শেষ শাসক। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মিসরে প্রায় ৩০০ বছরের মেসিডোনিয়ান শাসনের অবসান ঘটে। তার মায়ের দিককার পরিচয় অবশ্য পাওয়া যায় না। এ কারণে তিনি রোমানদের মতো শ্বেতাঙ্গ ছিলেন, নাকি মিসরীয়দের মতো কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন, তা জানা যায়নি।
মাত্র ৩৯ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে কখনো ছিলেন রাজকন্যা, কখনো বা পরাক্রমশালী রানী, আর কখনো তিনি ছিলেন প্রেয়সী। ক্লিওপেট্রা কে মনে করা হয় সম্মোহনী সৌন্দর্য্য আর সীমাহীন ক্ষমতার সত্বাধিকারী। রুপালি পর্দায় তাঁকে রুপসী হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে, পরমাসুন্দরী হিসেবে তার খুব বেশি খ্যাতি ছিল না। তবে তাঁর তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তা, মন্ত্রমুগ্ধকর ব্যক্তিত্ব, সহজাত রসবোধ,প্রচণ্ড উচ্চাভিলাষ ও তা বাস্তবায়নের অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে তিনি সর্বকালের সেরা মহিলাদের কাতারে স্থান করে নিয়েছেন।
ক্লিওপেট্রাকে ঘিরে ইতিহাসে বিতর্ক আর রহস্যের যেন শেষ নেই। যেমন রহস্যময় তার জীবন ও রাজ্য শাসন, তেমনি রহস্যময় তার প্রেম। তাঁকে নিয়ে গল্প-কবিতা-উপন্যাসের পাশাপাশি নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রও।উইলিয়াম শেক্সপিয়র, জর্জ বার্নাড শ, জন ড্রাইডেন, প্লুটার্ক, হেনরি হ্যাগার্ড, ড্যানিয়েল– প্রত্যেকেই আলাদাভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর চরিত্র। হ্যালিওয়েল তাকে ‘দ্য উইকেডেস্ট উইম্যান ইন দ্য হিস্ট্রি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
প্রেম আর মৃত্যু এই নারীর জীবনে একাকার হয়ে গেছে। তিনি যেমন ভালোবাসার উদ্যাম হাওয়া বইয়ে দিতে পারতেন, তেমনি প্রয়োজনে মারাত্মক হিংস্র হতেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করতেন না।
দান্তের মতে, লালসার শাস্তি হিসেবে তিনি নরকের দ্বিতীয় স্তরে দাউ দাউ করে পুড়ছেন। কারো কারো দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন ‘সারপেন্ট অব দ্য নাইল’। অনেকে আবার তাঁর আবেদনময়ী দিকটিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। ফারাও রাজবংশের সর্বশেষ রাণী ক্লিওপেট্রা শুধুমাত্র মিসরীয় ইতিহাসের এক বিস্ময়কর নামই নন, ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত নারীদের মধ্যেও তিনি একজন।
অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে খ্রিস্টপূর্ব ৫১ অব্দে রোম সম্রাট টলেমি অলেতিস মারা যান। মারা যাওয়ার আগে তার বিশাল সাম্রাজ্য ১৮ বছর বয়সী কন্যা ক্লিওপেট্রা [ক্লিওপেট্রা-৭] ও ১o বছর(কারো কারো মতে ১২ বছর) বয়সী পুত্র টলেমি-১৩-কে উইল করে দিয়ে যান। সেই সঙ্গে মৃত্যুর সময় রোমান নেতা পম্পে-কে রাজ্য ও তার সন্তানদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখনকার মিসরীয় আইন অনুসারে দ্বৈত শাসনের নিয়মে রানী ক্লিওপেট্রার একজন নিজস্ব সঙ্গী থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। কাজেই ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করতে হয় তারই ছোটভাই টলেমি-১৩ কে, যখন টলেমির বয়স ছিল মাত্র ১০বছর (কারো কারো মতে ১২ বছর)। ফলে আইনগতভাবে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পিত হলো ক্লিওপেট্রা এবং তার স্বামী (ওরফে ছোট ভাই) ত্রয়োদশ টলেমির উপর। ক্ষমতায় আরোহণের পর নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও ক্লিওপেট্রা তার শাসন চালিয়ে গেলেন।
ধারণা করা হয় কিওপেট্রার বড় দুই বোনের একজন (ক্লিওপেট্রা ষষ্ঠ) শৈশবেই মারা গিয়েছিলেন ও অপরজনকে (বেরেনিস) টলেমি অলেতিস-ই হত্যা করেছিলেন। এ ছাড়া ক্লিওপেট্রার ছোট আরো দু’টি ভাই ছিল।
সে সময়ের মুদ্রায় অঙ্কিত ক্লিওপেট্রার প্রসন্ন ভাব, স্পর্শকাতর নিখুঁত গ্রিসিয়ান মুখাবয়ব, গোলাকার দৃঢ় চিবুক, ধনুকের মতো ঢেউ খেলানো ভুরু যুগলের নিচে অনিন্দ্য সুন্দর চোখ, প্রশস্ত ললাট আর সুতীক্ষ্ম নাসিকার চমৎকার সমন্বয় দেখা যায়। সৌন্দর্যে ঘাটতি থাকলেও প্রখর বুদ্ধিমত্তা, যেকোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা, সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব তাকে করেছিল তুলনাহীন। তবে ক্লিওপেট্রা ও টলেমি-১৩ এর মধ্যকার সুসম্পর্ক স্থায়ী হয়নি। সিংহাসনে বসার মাস কয়েক পরেই দু’জনের মধ্যকার সম্পর্কে ফাটল ধরে।
ক্লিওপেট্রাও সব সরকারি দলিলপত্র থেকে তার ভাইয়ের নাম মুছে ফেলতে থাকেন। এমনকি মুদ্রায় তার একক পোর্ট্রেট ও নাম সংযোজন করেন। তবে তিনিও টীকতে পারেননি। দুর্ভিক্ষ, বিশৃঙ্খলা, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ফলে ক্লিওপেট্রাকেও সরে যেতে হয় ক্ষমতা থেকে। কিন্তু তিনি দমে যাননি মোটেও ধারণা করা হয় বোন আরসিনোইকে নিয়ে আরব সৈন্যদের সহায়তায় তিনি সিরিয়ায় চলে যান এ সময়।
এরই মধ্যে ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ফারসালুসের যুদ্ধে( রোমের গৃহযুদ্ধ) দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাপতি পম্পে পরাজিত হলেন। রোমের গৃহযুদ্ধের নায়ক হিসেবে অনেকাংশেই দায়ী করা হয় পম্পেকে। জনসাধারণকে তিনি বুঝিয়েছিলেন, সিজার ও তার পৃষ্ঠপোষকরা ভীষণ অবিচার করেছেন পম্পের পিতাকে অকারণে হত্যা করে। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে তার সিজারের বিরুদ্ধে তার এই বিদ্রোহ। সিজার শুনতে পেলেন, তার বিরোধীরা দল বেঁধে পম্পের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। সিজার কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত তার একান্ত বিশ্বস্ত লেপাডাইসের সঙ্গে পরামর্শ করে একজন দূতকে পাঠালেন মিসরে। অনেক টানাপড়েন সত্ত্বেও সফল হলেন তিনি। খ্রিস্টের জন্মের ৪৯ বছর আগে যে গৃহযুদ্ধের সূচনা,তার সমাপ্তি ঘটল পম্পের পরাজয়ে। পম্পে পালিয়ে গেলেন ক্লিওপেট্রার আলেকজান্দ্রিয়ায়।
সিজার তার অনুচরদের আদেশ দিলেন যে করেই হোক পম্পেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে। ওঁত পেতে রইল তারা। সে বছরই আলেকজান্দ্রিয়ায় সিজারের অনুচররা ছুরিকাঘাতে হত্যা করল পম্পেকে। এর চার দিন পর সিজার বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে মিসরে পৌঁছালেন। মিসর-সম্রাট টলেমি তাকে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলেও সফল হতে পারেননি। ক্লিওপেট্রাও পুরো ঘটনার ওপর তীক্ষ্ম নজর রাখছিলেন। তিনি সুযোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি দেখলেন সিজার শক্তিশালী এবং সেই সাথে একনায়ক। সবচেয়ে বড় কথা তার ওপর নির্ভর করা যায়। তার সহায়তায় ক্লিওপেট্রা আবার রাজক্ষমতা ফিরে পাওয়ার উদ্যোগ নেন। এ সময় সিজারের চাহিদা ছিল সম্পদের,আর কিওপেট্রার ক্ষমতার। দু’জন দু’জনের পরিপূরক হিসেবে অবস্থান নিলেন। এতে দু’জনই লাভবান হলেন।
সিজারের সাথে ক্লিওপেট্রার সাক্ষাতের ঘটনাটিও বেশ আকর্ষণীয়। আলেক্সান্দ্রিয়ার রাজপ্রাসাদে সিজারের পাহারায় ছিল ক্লিওপেট্রার স্বামী-ভাইয়ের বাহিনী। ফলে পরিচয় প্রকাশ করে সিজারের কাছে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাও ছিল না। তাই কৌশল গ্রহণ করলেন। এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীকে হাত করলেন তিনি। এক দিন সিজারের সামনে মুঁড়ানো কয়েকটি কার্পেট আনা হলো। একে একে সবগুলো খোলা হলো সিজারের সামনে। সেগুলোরই একটির ভেতর থেকে নাটকীয়ভাবে বেরিয়ে এলেন ক্লিওপেট্রা। তার বুদ্ধিমত্তা আর সৌন্দর্যের সামনে হেরে গেলেন রোমান সম্রাট।
কী ঘটতে যাচ্ছে টলেমি ত্রয়োদশ ঠীক বুঝতে পারলেন। তিনি নগরবাসীকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু এবারেও ব্যর্থ হলেন। পরিণতিতে তাকে নীল নদে ডুবিয়ে দেয়া হলো। অবশ্য তার আগে থেকেই মিসরের ব্যাপারে রোমান শাসকেরা নাক গলাতে শুরু করেছিল। ক্লিওপেট্রার পিতাও রোম সম্রাটের সাহায্যে ক্ষমতা পুনর্দখল করেছিলেন।
অনেকের মতে, সিজার চেয়েছিলেন ক্লিওপেট্রাকে মিসরে রোমের বশংধর হিসেবে রাখতে। সমঝোতা হিসেবে কিওপেট্রা তার অপর ভাই টলেমি চতুর্দশকে বিয়ে করেন (তা স্থায়ী হয়েছিল ৪৭-৪৪ খ্রিষ্টপূর্ব পর্যন্ত)। এই বিয়েটা হয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়াবাসী ও মিসরের পুরোহিতদের খুশি রাখতে। কারণ বিয়ে সত্ত্বেও একই সাথে তিনি সিজারের মিসরে অবস্থানকালে তার প্রেমিকা হিসেবেও বহাল থাকেন। চাঁদনি রাতে বজরায় করে দুইজনে নীলনদে ভেসে বেড়ান। সিজারের এক পুত্রসন্তানের জন্মও দেন তিনি। তার নাম রাখা হয় সিজারিয়ান (ছোট সিজার বা টলেমি সিজার)। সে-ই ছিল সিজারের একমাত্র পুত্র। রোমে অবস্থিত সিজারের স্ত্রীর কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর পর কিছু সময়ের জন্য মিশরের অধিকর্তাও হয়েছিলেন সিজারিয়ান।
পম্পেই এবং অন্যান্য শত্রু দমন করতে সিজারের কয়েক বছর কেটে যায়। তবে দু’জনের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। কিওপেট্রা প্রায়ই সিজারের সাথে সাক্ষাৎ করতে যেতেন। আসলে তিনি রোমান শাসকদের সাথে সুসম্পর্ক রেখেই মিসরের স্বাধীনতা বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ সালে সিজারের অনুরোধে ক্লিওপেট্রা,পুত্র সিজারিয়ান ও তার স্বামী-ভাইকে(টলেমি-১৪) নিয়ে রোমেও যান তার জয়োল্লাস প্রত্যক্ষ করতে। রোমে সিজার ক্লিওপেট্রাকে অত্যন্ত সম্মানিত আসন দান করেন। এমনকি ভেনাসের মন্দিরে ক্লিওপেট্রার একটি স্বর্ণমূর্তিও স্থাপন করা হয়। তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, সিজারিয়ান তার ছেলে। কিন্তু এসব কিছু রোমানদের ভালো লাগেনি। এমনকি তারা মনে করতে থাকে সিজার হয়তো ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন, যদিও রোমান আইনে একই সাথে দুই স্ত্রী রাখা কিংবা বিদেশিনী বিয়ে করা নিষিদ্ধ। তা ছাড়া জুলিয়াস সিজার রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়ায় সরিয়ে নিতে চান বলেও গুজব ছড়ানো হয়।
খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪ সালে তার রোমে অবস্থানের সময়েই সিনেট ভবনের বাইরে সিজার সিনেটরদের হাতে নিহত হন মাত্র ৫৫ বছর বয়সে। সিজারের আকস্মিক মৃত্যুতে ক্লিওপেট্রার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভের প্রথম প্রয়াস ব্যর্থ হয়। কেননা, মৃত্যুর আগে সিজার ক্লিওপেট্রা কিংবা সিজারিয়ানকে তার উত্তরসূরি মনোনীত করে যেতে পারেননি। ক্লিওপেট্রা মিসরে ফিরে আসেন। রোমান রাজনীতিতে তিনি নিরপেক্ষ থাকার নীতি অবলম্বন করেন। তবে রোমান রাজনীতির ওপর তীক্ষ্ম নজর রাখছিলেন। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন, যে-ই চূড়ান্তভাবে জয়ী হবে, তিনি থাকবেন তার পাশে।
••• ক্লিওপেট্রা ও মার্ক অ্যান্টনি —
এরমধ্যেই পটভূমিতে আবির্ভাব ঘটলো রোমের পরাক্রমশালী বীর মার্ক অ্যান্টনির। লোকমুখে তিনি ক্লিওপেট্রার রূপ-লাবণ্যের কথা আগেই শুনেছিলেন। কিন্তু কিভাবে সেই রূপ-লাবণ্য চাক্ষুষ করবেন? একদিন তিনি রোম থেকে এসে হাজির হলেন ক্লিওপেট্রার কারুকার্যশোভিত প্রাসাদের সামনে। এই খবর গোপন থাকার কথা নয়। দ্রুতই বীর অ্যান্টনির আগমনের খবর পেয়ে গেলেন রানী ক্লিওপেট্রা। মার্ক অ্যান্টনির কথা তিনিও শুনেছেন আগেই। সেই থেকেই শুরু। অবশ্য কারও কারও মতে মিসর আক্রমণ করতে এসে ক্লিওপেট্রার প্রেমে পড়ে যান রোমান বীর অ্যান্টনি। তবে উভয়ক্ষেত্রেই প্রথম দর্শনেই একে অন্যের প্রেমে পড়ে যান বলে মনে করা হয়।
অ্যান্টনির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা প্রকট রূপ নিল। মার্ক অ্যান্টনি মশগুল ক্লিওপেট্রার প্রেমে। আর ক্লিওপেট্রাও নিঃসঙ্গ জীবনে কেবল একজন সঙ্গীই নয়, বরং তার সিংহাসন রক্ষায় এক পরাক্রমশালী বীরের সমর্থন পেয়ে গেলেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৪২ সালে প্রতিদ্বন্দ্বী অল্প বয়স্ক অক্টাভিয়াসকে বেকায়দায় রেখে মার্ক অ্যান্টনি হন রোমের শাসক। ক্লিওপেট্রাও নতুন পরিকল্পনা করেন, রোমান শক্তি দিয়েই রোমকে রুখতে হবে। রোমের শাসনক্ষমতা পেয়েই অ্যান্টনি অন্যান্য রোমান জেনারেলের মতো পারস্য অভিযান শুরুর উদ্যোগ নেন। সুযোগটি নিলেন ক্লিওপেট্রা। অ্যান্টনি ছিলেন বিবাহিত। তার স্ত্রী ফুলভিয়া ইতালিতে অবস্থান করে স্বামীর প্রতিদ্বন্দ্বীদের নানাভাবে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ক্লিওপেট্রার ছলনায় ডুবে রইলেন অ্যান্টনি।
ইতিহাস বিদদের মতে,ক্লিওপেট্রা নিজে উদ্যোগী হয়ে জাঁকজমকভাবে এশিয়া মাইনরের টারসাসে তার কাছে যান। একজন পরাক্রমশালী জেনারেল হওয়া সত্ত্বেও অ্যান্টনি ছিলেন উচ্ছৃঙ্খল, আর ছটফটে চরিত্রের। ক্লিওপেট্রাও এই দিকটি জেনে নিলেন এবং নিজের স্বার্থে তা ভালোভাবেই কাজে লাগালেন। নিজের উপর তিনি ছিলেন যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। এ সময় তার বয়স ছিল ২৮ কি ২৯ বছর। সুন্দরী মেয়েদের বাওয়া রুপার পাতে মোড়ানো নৌকার গলুই, মুক্তা ও রত্নরাজিতে পাল সাজিয়ে প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির সাজে আঁধশোয়া ক্লিওপেট্রা যখন মার্ক অ্যান্টনির কাছাকাছি পৌঁছালেন, বলাবাহুল্য, অ্যান্টনিও নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি। রোম সম্রাট অ্যান্টনি পারস্য অভিযান বাদ দিয়ে ক্লিওপেট্রার কেনা গোলাম হিসেবে তার সাথে আলেক্সান্দ্রিয়ায় (মিসরের তদানীন্তন রাজধানী) চলে গেলেন।
ক্লিওপেট্রাও অ্যান্টনিকে বশে রাখার জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করেন। ক্লিওপেট্রার মোহে ডুবে থাকা রোমান সম্রাট অ্যান্টনি ঘোষণা করেলেন, মিসর রোমের কেবল একটি রাজ্যই নয়, বরং স্বাধীন একটি দেশ আর ক্লিওপেট্রা এ দেশের রানী। বেশ কিছু দিন তারা একত্রে কাটান।
খ্রিষ্টপূর্ব ৪০ সালে তিনি রোমে তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী অক্টাভিয়াসের সাথে বোঝাপড়ার উদ্যোগ নেন। এই উদ্যোগ সাময়িকভাবে সফলও হয়। সমঝোতা হিসেবে অ্যান্টনি প্রতিদ্বন্দ্বী অক্টাভিয়াসের (সম্রাট অগাস্টাস হিসেবে পরিচিত) বিধবা বোন অক্টাভিয়াকে বিয়ে করেন (এর কিছু দিন আগে তার আগের স্ত্রী ফুলভিয়া মারা গিয়েছিল)। সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী হওয়া সত্ত্বেও অক্টাভিয়ার দুর্ভাগ্য, তার কন্যা সন্তান হয় (পুত্র হলে অবশ্য ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত)।
যা-ই হোক, পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে তিনি বুঝতে পারলেন, অক্টাভিয়াসের সাথে তার সম্প্রীতি টীকবে না। তাই বিকল্প ভাবতে থাকলেন। এ সময় ক্লিওপেট্রাও চুপচাপ বসে ছিলেন না। তিনিও আরেকটি খেলায় মেতে উঠেছিলেন। তিনি রোমের আরেকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হেরোডকে বশ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে সফল হননি। এ দিকে ক্লিওপেট্রার জন্য অ্যান্টনির মন উতলা হয়ে ওঠে। তাই তিনি মিসরে কিওপেট্রার সান্নিধ্যে চলে আসেন।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৬ সালে তারা বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। এটি ছিল একটি চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনা। ইতোমধ্যে জন্ম নেয়া কিওপেট্রার দুই জমজ সন্তানকে একটি ছেলে ও একটি মেয়েকে অ্যান্টনি স্বীকৃতি দেন। এটা এক দিকে অক্টাভিয়াস ও তার বোন অক্টাভিয়ার জন্য ছিল একটি অত্যন্ত অসম্মানজনক আঘাত। আবার রোমান আইন অনুযায়ী এই বিয়ে ছিল অবৈধ। তাই পুরো রোম অক্টাভিয়াসের সাথে একজোট হয়। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে অ্যান্টনিকে দমন করতে অগ্রসর হয়। অক্টাভিয়াস-অ্যান্টনি যুদ্ধ অপরিহার্য হয়ে ওঠে। অ্যান্টনিও ৩১ সালে অক্টাভিয়াকে চূড়ান্তভাবে তালাক দেন। তবে ক্লিওপেট্রাকে খুশি করতে এবং সেই সাথে আলেকজান্দ্রিয়াকে কেন্দ্র করে নতুন সাম্রাজ্য গড়ার দিকেও অ্যান্টনি নজর দেন। ৩৪ সালে তিনি মিসর, সাইপ্রাস, ক্রিট, সিরিয়ার শাসনমতা ক্লিওপেট্রাকে দান করলেও বেশিদিন এই ক্ষমতা ভোগ করতে পারেননি তিনি।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২-৩১ সালে অ্যান্টনি-ক্লিও পেট্রা প্রতিকূলতার মধ্যেও গ্রিসে অবস্থান করেন। এ দিকে অক্টাভিয়ান অ্যান্টনিকে হারিয়ে রোমের নিরঙ্কুশ মতা পেতে সর্বাত্মক প্রয়াস শুরু করেন। অক্টাভিয়ান খ্রিষ্টপূর্ব ৩১ সালে চূড়ান্ত অভিযান চালনা করেন। গ্রিসের দক্ষিন উপকূলে অনুষ্ঠিত হয় এই যুদ্ধ। অ্যান্টনি ছিলেন স্থলযুদ্ধে পারদর্শী। কিন্তু ক্লিওপেট্রার পরামর্শেই তিনি নাকি নৌযুদ্ধে নেমেছিলেন। নৌযুদ্ধের অত্যন্ত সন্ধিণে কিওপেট্রা হঠাৎ করেই তার বাহিনী প্রত্যাহার করে নেন। কেন তিনি এই বাহিনী সরিয়ে নিয়েছিলেন, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে এর ফলে যুদ্ধে অ্যান্টনি পরাজিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসেন। এই যুদ্ধের মাধ্যমে অক্টাভিয়ান রোমের সম্রাট হন। আর অ্যান্টনির সব ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। সেই সাথে ক্লিওপেট্রার কাছেও মূল্যহীন হয়ে পড়েন অ্যান্টনি। ক্লিওপেট্রাও নতুন চাল শুরু করেন। এবার তার সব পরিকল্পনা রচিত হতে থাকে অক্টাভিয়াসকে কেন্দ্র করে। বন্দী করতে চাইলেন তার মায়াজালে। কিন্তু এখানেই তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটি করেন। পরিণতিতে তিনি জীবন পর্যন্ত খোয়ান।
তিনি বুঝতে পারলেন, অক্টাভিয়াসকে হাত করতে হলে অ্যান্টনিকে বাদ দিতে হবে। অথচ অ্যান্টনিকে হত্যা করার বা মিসর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার কোনো ক্ষমতা তখন তার নেই। তাই সে যাতে আত্মহত্যা করতে উদ্বুদ্ধ হয়, তিনি সেই পথ বের করলেন। ভাবলেন, এতে অনায়াসেই তিনি তার স্বার্থ হাসিল করতে সক্ষম হবেন। তাই এক দিন নিজের সুরতি মন্দিরে অবস্থান নিয়ে প্রচার করে দেন, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর খবর পেয়ে অ্যান্টনিও বেঁচে থাকার সব ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেন। তিনি তার তরবারি নিজের বুকে বিদ্ধ করেন। কিন্তু পরণেই তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি ভুল শুনেছেন বা তাকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে তার পরপারের ডাক চলে এসেছে। তবে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে কিওপেট্রার কাছে নেয়া হলে তিনি তার কোলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
১০ মাস পরে বিজয়ী অক্টাভিয়াস আলেক্সান্দ্রিয়ায় আসেন। এ সময় ক্লিওপেট্রা অক্টাভিয়াসকে সম্মোহিত করতে চাইলেন।এর আগেও দুই দু’বার শক্তিশালী সম্রাটকে নিজের মায়াজালে মোহিত করলেও তৃতীয়বার পুরোপুরি ব্যর্থ হলেন। তবে অক্টাভিয়াস চাইছিলেন, যেভাবেই হোক ক্লিওপেট্রাকে জীবিত ধরতে হবে। তাই তিনি তাকে নানা আশ্বাস দিচ্ছিলেন। অক্টাভিয়াস নিজেও জানতেন, তিনি যদি কিওপেট্রার চোখের দিকে তাকান, সাথে সাথে তার সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাই তিনি ক্লিওপেট্রার সাথে কথা বলার সময় চোখ নামিয়ে রেখেছিলেন মেঝের দিকে ক্লিওপেট্রাও বুঝতে পারলেন এইবার রোমান সম্রাটকে বশ করা যাবে না। তার মনে হলো অক্টাভিয়াস বুঝি তাকে লাঞ্ছিত করবে। হয়তো মিসর বা রোমের রাজপথে যুদ্ধলব্ধ সামগ্রী হিসেবে তাকে ও তার সন্তানদের লোহার শিকল পরিয়ে প্রদর্শন করবে। এটা মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি।
অপমানের আশঙ্কায় তিনি ভেঙে পড়েন। এই অপমানের চেয়ে মৃত্যুই তার কাছে শ্রেয় মনে হলো। তাই তদানীন্তন রাজকীয় প্রথা হিসেবে বিষধর মিশরীয় গোখরার(অ্যাস্প্ নামের এই সাপ হয় মাত্র কয়েক ইঞ্চি লম্বা, অথচ তাদের বিষ মারাত্মক। ডুমুরের ঝুড়িতে করে বিশেষ ব্যবস্থায় আনা হয়েছিল সাপ দু’টি) ছোবলে আত্মহত্যা করেন। সে সময়ে মিসরে মনে করা হতো সাপের কামড়ে মারা যাওয়া মানুষ অমরত্ব লাভ করে। তাই ক্লিওপেট্রা ওই পথই বেছে নিলেন।
দিনটি ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৩০ সালের ৩০ আগস্ট। অবশ্য কারো কারো মতে তিনি হেমলক, ওলফ্সবেন, আফিম মিশ্রত বিষাক্ত মলম( যার মারণক্ষমতা আগেই পরীক্ষা করে নেওয়া হয়েছিল তার দাসীদের উপর) দিয়ে আত্নহত্যা করেছিলেন। কেউবা আবার মনে করেন আত্নহত্যা নয় বরং খুন করা হয়েছিল ক্লিওপেট্রাকে। তা যাই হোক, প্রচন্ড উচ্চাভিলাষ আর লালসার ফলশ্রুতিতেই যে এই করুন পরিণতি, তা অস্বীকারের জো নেই। অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা দু’জনকেই রোমে সমাহিত করা হয়।
ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর পর ফারাও হন তাঁর ছেলে সিজারিয়ান। কিন্তু সে অল্প কয়েকদিনের জন্য। তাঁকে হত্যা করে মিসরের শাসনভার নেন জুলিয়াস সিজার অক্টাভিয়ানাস। মিসরে শুরু হয় রোমান শাসন। ইতিহাসের এটুকু মোটামুটি সবারই জানা।এতকিছুর পরেও রহস্য যেন পিঁছুই ছাড়ছেনা ক্লিওপেট্রার। যে প্রাসাদে প্রাণ দিয়েছিলেন তিনি তা নিয়েও আছে রহস্যের দেয়াল। হঠাৎই কোথায় হারিয়ে গেল ক্লিওপেট্রার প্রাসাদ?তবে কি কালের গর্ভে হারিয়ে গেল ক্লিওপেট্রার স্মৃতি বিজরিত সাম্রাজ্য?
••• ক্লিওপেট্রার প্রাসাদ ও আলেকজান্দ্রিয়া নগরী —
গত শতকের শেষভাগে সে সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে বিস্তারিত জানিয়েছিলেন ফরাসি পুরাতত্ত্ববিদ ফ্রাঙ্ক গদিও। “দি ইনডিপেনডেন্টের কাছে তার দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, গ্রিক ঐতিহাসিক স্ত্রাবোর লেখায় তিনি পড়েছিলেন ক্লিওপেট্রার প্রাসাদ ছিল মিসরের অ্যান্তিরহোদোস দ্বীপে। এই দ্বীপের অস্তিত্ব তখনো আধুনিক দুনিয়া জানে না। খুঁজতে গিয়ে ফ্রাঙ্ক আবিষ্কার করলেন‚ খ্রিস্ট্রীয় ষষ্ঠ শতকে এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প এবং সুনামিতে ক্লিওপেট্রার প্রাসাদসহ এই দ্বীপটিকে গ্রাস করে নিয়েছে ভূমধ্যসাগর।
আলেকজান্দ্রিয়া শহরের উপকূলেই ছিল এই দ্বীপ। ওই ভূমিকম্পে তলিয়ে যায় আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত বাতিঘরও। যা ছিল প্রাচীন বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে একটি।
১৯৯১ সালের ২৩ জানুয়ারি ভূমধ্যসাগরের গভীরে পাওয়া গেল ক্লিওপেট্রার প্রাসাদের অস্তিত্ব। কার্বন ডেটিং পরীক্ষা করে বলা হলো‚ এই প্রাসাদ তৈরি হয়েছিল রানির জন্মেরও ৩০০ বছর আগে। দেখা গেল পানির অতলে ঘুমিয়ে আছে প্রাচীন নগরী, লাল রঙের মিসরীয় গ্র্যানাইটে তৈরি দেবী আইসিসের মূর্তি‚ ক্লিওপেট্রার পরিবারের সদস্যদের মূর্তি‚ প্রচুর অলঙ্কার‚ বাসনপত্র এবং স্ফিংক্সের দুটি মূর্তি।
সাগরের নিচে প্রায় এক হাজার ৪০০ বছরের বালি আর কাদা মাখা ইতিহাসের অমূল্য দলিলাদির বেশ কিছু নিদর্শনও তুলে আনা হয়েছিল জনসমক্ষে। কিন্তু প্রতিকূলতার জন্য বেশির ভাগই রয়ে গেছে পানির নিচে। ফ্রাঙ্ক গদিও জানান, ওই এলাকার সাগরের নিচে স্রোতের প্রকৃতিও অনেকটা অচেনা। তীব্রস্রোতের জন্য উদ্ধার অভিযান চালানোও অনেক বেশি বিপজ্জনক।রোমান বাহিনীর কাছে ধরা দেবেন না বলে আত্মহত্যা করেছিলেন রানী ক্লিওপেট্রা। তাঁর স্মৃতি ঘেরা ইতিহাসও বোধহয় পুরোটা ধরা দিতে চায় না আধুনিক মানুষের কাছে।
- (তথ্যসূত্র- অনলাইন)