এই বিশাল মুক্ত আকাশের নিচে বাস করা প্রতিটি মানুষই বেঁচে থাকে কোনো না কোনো এক আশার আলো নিয়ে। তার কাছের মানুষের পাশে থাকার প্রত্যাশা নিয়ে, তাদেরকে ভালোবাসার প্রত্যাশা নিয়ে, বেঁচে থাকে কাছের মানুষের ভালোবাসা পাবার আশায়। কিন্তু যার জীবনে এই আশাটুকুই নেই সেই মানুষটি পৃথিবীতে বেঁচে থেকেও মৃতের মত নিশ্চল হয়ে যায়! তার চাওয়া-পাওয়া বলতে কিছুই আর থাকে না এই পৃথিবীর বুকে! তেমনি এক অসহায় আমি! বেঁচে থেকেও আজ আমি মৃত! প্রিয়জন হারানোর বেদনা আমাকে কাঁদায় প্রতিনিয়ত !
আমি এক নিঃস্ব! বরিশাল জেলার রহমতপুর ইউনিয়নের একটি গ্রামে আমার জন্ম। তার কয়েকবছর পর যখন আমার বাবা মারা যান, তখন আমার ভাইটির বয়স মাত্র দেড় বছর! আমার মায়ের তখন খুব অসুখ থাকে। আমার মায়ের চিকিৎসার যাবতীয় খরচ আমার মামা বহন করেন। এর কিছুদিন পরে আমার মাও আমাদের দুই ভাইয়ের মায়া ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য চলে যান ওপারে! আমরা হয়ে যাই এতিম!
আমরা দুই ভাই হয়ে যাই একেবারে একা! বাবা-মায়ের জমানো টাকা শেষ হয়ে যায়; তারপর মামা আমাদের কিছু টাকা দেন চলতে। আমরা ছোট মানুষ, কোথায় যাব; কী করবো তার কোনো উপায় না দেখে তখন আমার মামা আমাদের দুই ভাইকে তার বাসায় নিয়ে যায়। আমরাও যাই মামার বাসায়। মামার বাসায় ভালোই কাটছিলো দিন। ছোট ভাইটা বড় হচ্ছিলো, মামা আমাকে মাঝে মাঝে তার সাথে দোকানে নিয়ে যেত। আমার ছোট ভাইটার জন্য নানারকম খেলনা নিয়ে আসতো; খাবার নিয়ে আসতো । মামা আমাদের বুঝতে দিতে চাইতেন না যে আমাদের বাবা মা মারা গেছেন। আমার মামা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। ভালোই কাটছিলো আমাদের দিন।
কিন্তু ধীরে ধীরে আমার মামির আচরণ আমাদের দুই ভাইয়ের প্রতি খুব বাজে হতে লাগলো। মামার অগোচরে মামি আমাদের উপর নানারকম মানসিক অত্যাচার শুরু করতে লাগলো। আমার ছোট্ট অবুঝ ভাই তুহিনকে প্রতিনিয়ত চোখ রাঙাতে শুরু করলো। তুই তুই করে বলতো। আমি তুহিনকে কিছু খাওয়াতে গেলেই বলা শুরু করতো-” তোরা দুই ভাইতো সাংঘাতিক ভয়ংকর। নিজের বাপ-মাকে খেয়ে এখন আইছিস আমাদের খাইতে! কোনো কাজ-কর্ম নাই; সারাদিন খালি খাই আর খাই! ওই, তোরা এত খাস ক্যান? আর খাস ভালা কথা; ইট কামওতো করোস না। তোগো মা-বাপ মইরা আমারে সারাজীবনের জন্যে ডুবাইয়া গেলো! আল্লাহ জানে আমি এগুলান থেকে মুক্তি করে পামু! কবে জানি এইগুলান ওগো বাপ-মায়ের মত আমাগোও মাইরা ফালায়!”
মামির মুখে এ কথাগুলো শুনে খুব করে মনে করিয়ে দিত আমায় আমরা যে আসলেই এতিম! এতটা সুখ আমাদের জন্য নয়। মামির কথাগুলো শুনে আমার ছোট্ট ভাই তুহিনের মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ে যেত। চিৎকার করে মা মা বলে ডাকতো আর কান্না করতো! তুহিন কান্না করলে মামি আরো রেগে যেয়ে উল্টা পাল্টা বলতো। আমার মামা খুব ভালো মানুষ । দ্বন্দ একদম পছন্দ করতেন না। এসব কথা মামাকে বললে মামা রেগে গিয়ে মামির সাথে দ্বন্দ লাগালে তাদের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হবে, তাই আর মামাকে বলিনি। আর আমি ভেবেছিলাম মামি আমার ছোট্ট ভাইটির জন্য হয়তোবা বদলে যাবে। কিন্তু না, আমার মামি বদলায়নি! তার আচরণ দিন দিন আরো বেশি খারাপ হতে থাকে।
তাই তুহিনের কথা চিন্তা করতে থাকি আমি। ওকে বড় করতে হলে, লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করতে হলে, এখানে আর থাকা যাবে না। আমি ভাবলাম প্রয়োজনে কাজ করে খাব; তবুও এখানে আর নয় ।
হঠাৎ একদিন না বলে বাসা থেকে বের হয়ে যাই। দুধের শিশু তুহিনকে নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরি। কোনো রাস্তা খুঁজে না পেয়ে আমার চাচার বাসায় যাই। চাচা আমাদের দেখেই আমাদের বলতে যে এখন কেন আসছো? তোমাদের মামার বাসায় এতদিন থাকছো সেখানে যাও। তাদের বাসায় থাকতে দিতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। তারপর আমি তাকে বলি যে আমি একটা কাজ পেয়েছি। সেখানকার কিছু টাকা তাদেরকে থাকার জন্য দেবো বলি। তারপর অনেক আকুতি করার পর চাচা-চাচি আমাদের থাকতে দিলেন। অবশেষে আমি বলি যে আমি কাজ করে টাকা দেব থাকা-খাওয়ার জন্য। তবুও যেন আমাদের থাকতে দেয়। আমার ভাইটিকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করবো এটাই ছিলো আমার মূল লক্ষ্য।
আমাদের গ্রামেই একটি রুটি বানানোর কারখানা ছিলো। সেই কারখানায় আমি কাজে লেগে যাই। তুহিন সারাদিন আমার চাচাতো ভাইদের সাথে বাড়িতে থাকতো ঠিকই, কিন্তু আমার চাচি আমার ভাইটিকে তাদের সাথে মিশতে দিত না। কথা বলতে দিত না। নানাভাবে তুহিনকে কথা শোনাতো। তুহিন যে বাচ্চা এটুকু বুঝেও না বোঝার মত করত।
আর আমি থাকতাম কারখানায় ঠিকই; কিন্তু আমার মনটা পড়ে থাকতো তুহিনের কাছে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে তুহিনের সাথে ভালোই সময় কাটাতাম, তুহিনকে ঘুম পাড়ানোর সময় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে কাঁদতাম আর মনে মনে বলতাম-“আর কয়েকটাদিন তুহিন। আর একটু সহ্য কর ভাই কঠিন এই অবহেলা। দেখবি তোর ভাইটা তোর জন্য সবকিছু ঠিক করে ফেলেছে। তোকে একদিন মানুষের মত মানুষ করে তুলেছে। বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবে তোর এই ভাইটা, দেখে নিস তুই! বাবা-মা নেই তো কি হয়েছে? আমিই তোর বাবা-মা। তোকে একদিন আমি অনেক বড় করে তুলবো। কেউ আর সেদিন তোকে অবহেলা করবে না তুহিন ! সবাই তোকে কাছে টানতে চাইবে! সবাই তোকে ভালোবাসবে!”
কোনোদিন টাকা দিতে দেরি হলে চাচা-চাচি গ্রামের অশ্লীল ভাষায় গালাগাল শুরু করে দিত। মুখ বুজে তুহিনের জন্য সব সহ্য করে নিতাম। এভাবেই যাচ্ছিলো আমাদের দুইভাইয়ের জীবন! কিন্তু যার ভাগ্য খারাপ সে কী কখনো ভালো থাকতে পারে। পারে না। তখন বিনা মেঘেই বজ্রপাত হয়ে দুর্ভাগা মানুষগুলোর অস্তিত্বগুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। আমার জীবনেও তার ব্যতিক্রম কিছুই ঘটলো না। জীবনের আকাশে শুরু হলো বজ্রপাত!
আমি কারখানায় কাজ করছিলাম। হঠাৎ কেউ একজন এসে আমাকে বললো তোমার ছোট ভাই তুহিন তো পানিতে পড়ছে! জ্ঞান নাই! জলদি বাড়ি চলো!’ আমি এ কথা শুনে পাগলের মত দৌড়ে বাড়ি যাই। কিন্তু আমি বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত আমার তুহিন আমার জন্য একটু অপেক্ষাও করেনি! আমাকে একা ফেলে সার্থপরের মত চিরদিনের জন্য চলে গেলো বাবা-মায়ের কাছে। আমি বাড়ির উঠানে ওর লাশটাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকি।
এতিমের মত শুয়ে ছিলো আমার ছোট ভাইটা। এবং বাবা-মা মারা যাবার পর এই প্রথম আমি আমার ভাইয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখলাম, তাও লাশ হয়ে। এতিম ভাইটাকে রেখে আসলাম বাবা-মায়ের বুকে। ভাইটা আমার ভালো থাকিস! ভালো থাকার জন্যই হয়তো বাবা-মায়ের কাছে চলে গিয়েছিস! এতিম করে গেলি তোর এই ভাইটাকে ।
এতিমখানায় থাকা ছেলেমেয়েরাই কী কেবল এই পৃথিবীতে এতিম? শুধুমাত্র এতিমখানায় থাকা এতিমদের প্রতিই আমরা আমাদের সহানুভূতি ও আবেগ প্রকাশ করবো?
না!!!
আপনার আমার আশেপাশে বড় হওয়া বাবা-মা হারানো অসহায় ছেলে মেয়েগুলোও কিন্তু এতিম। যাদেরকে আমরা অবহেলায় দূর দূর করে তাড়িয়ে দেই। অসহায় এই মানুষগুলোর সাথে আমরা খারাপ ব্যবহার করি। কিন্তু কেন করি? ভেবেছি কি কখনো? হয়তো বা পরিবারের চাপে; নয়তো বা কাজের চাপে এই মানুষগুলোকে আমরা কাছে টানি না। কিন্তু তাদেরকে আমরা একটু কাছে টানলেই হয়তো তারা ভালোভাবে বেঁচে থাকতে অনুপ্রেরণা পায়।
ভালোভাবে বাঁচতে পারে। আর আমি চাই আমরা প্রত্যেকেই এই অসহায় মানুষদের পাশে একটু সহানুভূতি নিয়ে দাঁড়াতে। কারণ কাল হয়তো বা আমার আপনার সন্তানও এমন এতিম হয়ে যেতে পারে! তখন তাদেরও হয়তো বা এমন অবস্থা হতে পারে। তাই আমি চাই না। আর কোন শিশু যেন আমাদের মাঝে অসহায় হয়ে বেঁচে থাকুক! আমি চাই না যে আর কোন এতিম আমাদের মাঝে ভালোবাসার অভাবে হৃদয়ে তীব্র বেদনা নিয়ে বড় হোক! আর তা তখনই সম্ভব যখন আমি আপনি এই এতিম অসহায় ছেলে মেয়েদের পাশে ভালোবাসার ছায়া হয়ে দাঁড়াতে।
আমাদের প্রত্যেকেরই আত্মীয় স্বজনের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যারা খুব অল্প বয়সে বাবা-মাকে হারান। অভিভাবক বা পরিবারের স্বচ্ছলতার অভাবে কারণে ওই এতিম মানুষগুলোর কঠিন বাস্তবতার সম্মুখিন হতে হয়। ঠিক ওই মুহূর্তে আপনার উচিৎ ওই অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে তাদের জীবনটা সহজ করে দিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দ্বারে পৌঁছে দেয়া। আর আপনার কাছে এইটুকুই আমার চাওয়া। ধন্যবাদ,,,,,,,,,