- গল্প : বেঈমান
আমি শুভ্র, বয়স ২২, ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি,৮৪ কেজি। BMA তে আর্মি ট্রেনিংএ আছি। কোটা সুবিধা থাকায় সহজেই চান্স পেয়েছি। কিন্তু নিয়ম আর ছাড় দেয় কাকে? কি? ভাবছেন যে আমি আর্মি হতে চাওয়া ছেলেদের জন্যে লিখতে বসেছি? নাহ! আমার গল্প আমার কষ্টের, আমার সেই বেঈমান স্ত্রীর। যাই হোক, তো ; একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যেতে হবে, আর্মি ক্যাম্পে আমার ট্রেনার আমার ওজন কমানোর জন্য কড়া নির্দেশ দেন ৮০ টি পুশ আপ কভার দিতে হবে! আমার পক্ষে ১০ টি পুশ আপ দেয়াই দায়! সেখানে ৮০ টি?!! আমার ট্রেনিং সিজন বাড়ানো হলো, বাকি সবকিছু আটকে দিয়ে আমাকে শুধু তাবুর সামনে ৮০ টি পুশ আপ কভার করতে বলা হলো। যেদিন ৮০ টি কভার হবে, সেদিন থেকে আমার নরমাল ট্রেনিং সিজন শুরু হবে, ট্রেনার স্যার এভাবেই সিস্টেম সাজিয়েছেন। আমার মতো আরও ৬ জন হতভাগা ছিলো। একটু একটু করে পুশ আপের অগ্রগতি হয়। ১৪শ দিনে আমি একটানা ২০টি দিতে সক্ষম হই, ট্রেনার স্যার হাতের কাউন্টার অফ করে বললেন,” দেখো শুভ্র, যত দেরি হবে কভার করতে, ততই কিন্তু তোমার সিজন লম্বা হয়ে যাবে ১-১ দিন করে।” কথা বলার জো নেই আমার। স্যার জিজ্ঞেস করলেন “প্রেমিকা আছে?” উত্তর দিলাম “স্যার আমি ম্যারিড “..(ডিফেন্সএ চান্স পাওয়ার পরই পারিবারিক ভাবেই সব সেড়ে ফেলা হয়,মেয়ের সাথে আগে ৩ বছর থেকেই সম্পর্ক).. কথা শুনে স্যার হয়তো আমার অগ্রগতির কথা ভেবেই বললেন,”একটানা প্রতি ২০ টি পুশ আপের জন্যে তুমি রাতে ১ মিনিট করে ফোন করতে পারবে” কতটা যে খুশির কথা ছিলো বলে বোঝাবার সাধ্য নেই, নরমালি প্রতি থার্সডে নাইটে স্পেশাল ডিনারের পর ৩
মিনিট কথা বলা যায় বাড়িতে, সেখানে এখন হয়তো প্রতি রাতেই ১ মিনিট কথা বলার ভাগ্য হলো। এভাবেই চলতে থাকে, এই কল দেয়ার চান্সে কেবল আমার স্ত্রী নীলার সাথে কথা বলতাম।নরমাল ট্রেনিং সিজনের এন্ট্রি না,,নীলাই এখন আমার পুশআপের উদ্দেশ্য হয়ে উঠলো। স্বামী হয়ে অনেক দায়িত্বশীল বোধ করি কিন্তু পূরণ করতে পারি না,একসাথে না থাকায় এভাবে নিজেকে প্রায়ই স্বামী হিসেবে ছোট মনে হতো।তাই কথা বলায় অনেক গুরুত্ব দিতাম।এভাবেই চলতে থাকে,,২/১ দিনে ২০ টার সাথে ২/৩ টি করে পুশ আপ যোগ করা যায় অনেক কষ্টে! এভাবে ৩ রাত ১ মিনিট করে কথা বললাম, ভাবলাম, ১ মিনিট এভাবে আর কত! পাশাপাশি বাড়ির অন্যদের সাথেও তো কথা বলা উচিত, ভাবলাম প্রতি রাতে কথা না বলে, মিনিট জমা করে ১ রাতে অনেক কথা হবে, সেই রাতেই ফোনে বলে দিলাম যে এখন স্যার আর ফোন দিবেন না, আমি জানাই নি যে পুশ আপের বিনিময়ে আমাকে এটা দেয়া হচ্ছে, বলেছিলাম আমার স্যার বেশি দয়ালু তাই আমাদের কথা বলার সুযোগ দেন..এদিকে প্রতিদিন কষ্ট করে করে আমি মিনিট জমাতে থাকি, সবুরে মেওয়া ফলে বলে নিজেকে আটকে রাখি, দেড় মাস হয়ে এলো, খুব কষ্টে ৪৫-৫০ টা হয় এখন, ট্রেনার স্যার আমাকে নরমাল ট্রেনিং সিজনে এন্ট্রি দিয়ে দিয়েছেন, হাতে আমার সময় ৫৭ মিনিট, (৪০ টা আয়ত্তে আসার পর ৪০টার জন্য ২ মিনিট) এতদিন কেবল থার্সডে করেই কথা হয়েছে। স্যার আমাকে আরও ৩ মিনিট বাড়িয়ে ১ ঘন্টা করে দিলেন!BMA তে দিন আসলো সিজনাল ক্যাম্প ফায়ার প্রোগ্রামের..এই প্রোগ্রামের পর ছুটি দেয় ৩ দিন..প্রোগ্রামের আগে আর বাসায় ফোন দিলাম না যেহেতু বাড়িতে যাচ্ছিই কিছু বাদে, প্রোগ্রাম শেষে বাড়ি এলাম, এসে আর কান্ড দেখে কে?! রোড এক্সিডেন্টে নীলা লাইফ সাপোর্টে! শুধু তাই না, মেমোরি লস্ড! আমার এই নীলা! কতদিনের সম্পর্ক! কত মুহূর্ত, দুজন দুজনকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে আগে থেকেই বন্ধনে জড়িয়ে রাখার পর কি এ-ই দেখার ছিল? কে বলেছিল এই হতভাগা স্বামীর আগমনে গিফট কিনে আনতে? যার জন্য এত অঘটন! হতভাগা শব্দ টা যে এখনই শুরু তা-ই বোঝার ছিল। ৩ দিনে এই হতভাগা করবে কি?! কতটাই সঙ্গ দেবে?! আর কিভাবেই বা অমানুষের মতো ৩ দিন বাদে একে একা ফেলে চলে যাবে?! ডাক্তার মুখ ফুটে কিছু বলেও উঠতে পারেন না,,৩ দিন শেষ হয়ে এলো,বুধবার; বেঈমান টাকে রেখে রওনা দিলাম, হ্যাঁ, নীলা বেঈমান, এত ভালোবাসা, কত কষ্টের সেই ১ মিনিট গুলো, এত এত কষ্টের ৫৭ মিনিট এখন কার জন্যে! সেই সবকিছু অর্থহীন করে দিয়েই আজ নীলা বেঈমান! বেঈমানী করে আজ আমায় অচেনা বানিয়ে দিল, বেঈমানী করে আজ আমার থেকে চিরতরে দূরে সরে যাওয়ার ফন্দি আঁটছে সেই বিছানায় শুয়ে, নির্বাক চাহনি তার! এত সব কষ্ট চোখে মনে নিয়ে ক্যাম্পে ফেরত এলাম। প্রবেশ করতেই ট্রেনার স্যার বললেন,” শুভ্র সাহেব, সাহেবান এর খবর কি? অফারের কথা মাথায় আছে তো? ৮০ টা কমপ্লিট করে সিরিয়াসলি আগাতে থাকো ছেলে, তোমায় নরমাল সিজনেও এন্ট্রি দিয়েছি, বেস্ট অফ লাক”
স্যারের মুখের দিকে অপদার্থের মতো তাকিয়ে রইলাম, নরমাল সিজনের কথা যেন মাথায় এলই না, মাথায় শুধু ঢুকলো ২টা শব্দ – “সাহেবান” আর “অফার”… এই ২ টা জিনিসকেই এতদিন এখানে বড় করে দেখেছি আর এখন এই দুটোই বড় অর্থহীন। পরদিন, থার্সডে! কল দিলাম বাড়িতে, কেন যেন একেকটা হাতুড়ির বাড়ি পড়ার মতো করে হার্টবিট চলছে, মা ফোন তুললেন, কোনো কথা নেই, কান্না শুনেই বুঝতে আর বাকি রইল না ঘটনা কি! নোনতা জল চোখ গড়িয়ে ঠোঁটে এসে পড়ল, হাত পা কাপতে শুরু করল, কোনো রকমে ফোনটা সিরিয়ালে থাকা সোলজার কে দিয়ে তাবুতে চলে এলাম। নীলা, একটা বেঈমানের নাম, যেই বেঈমান জড় বেশ নিয়েই আমায় তিলে তিলে মারার মতো করে কাহিনী করে গেল! এত্তই বড় বেঈমান, যে শেষ চেহারা দেখার সুযোগ মাত্রও দিলো না, এত্ত বড় বেঈমান, যার সাথে ১ মিনিট জমিয়ে জমিয়ে কথা বলার জন্য দিনের পর দিনের সেই কষ্ট টাকে অর্থহীন করে দিয়ে উধাও হয়ে গেলো! শেষ চেহারা দেখাতেও নারাজ!
পরবর্তী রাতে, চাঁদ উঠেছে, তাবুর সামনে বসে আছি, ট্রেনার স্যার তার তাবুর ভেতর থেকে ডাকলেন, আজ তিনি বাইরেও আসলেন না, টাইমার টাও অন করলেন না, মুচকি হেসে হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে মাথা নেড়ে বললেন বাইরে এসে যেন মনের মতো করে কথা বলি, কিন্তু আজ আর কি? রক্ত ঠান্ডা হয়ে এলো, আঙ্গুল আজ নাম্বার টাও ডায়াল করতে চাইছে না, দাঁড়িয়ে থেকে ওই আকাশের চাঁদের দিকে মুখ দিয়ে ফোন টা ওরকমই কানে তুলে ধরলাম। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়তে লাগলো। ফোনের ওপারের ও যে বেঈমানী করে পালিয়েছে, কথা বলবো কার সাথে! কার খবর নেব? কি খবর নেব? মৃত নীলা;নীলা বেঈমান?!
ভালোবাসায় কষ্ট পাওয়ার পর নিজেকে কিভাবে সামলে নিবেন ??
কাউকে ভালোবসার আগে ইগনোর কীভাবে করতে হয় শিখে নেও কারন সব ভালোবাসা সত্য হয় না কেউ অভিনয় করার জন্য ও...