আমরা তখন পুরাণ ঢাকায় থাকি। আম্মা সারাদিন সংসার আর পড়াশোনা শেষে দুপুরে একটু ঘুমান। সেই সুযোগে আমি পুরো লক্ষ্মী বাজার ঘুরে বেড়াই। সেন্ট গ্রেগরী স্কুলের পাশে মস্ত এক পুকুর। অনেক পুড়ানো, সিড়িগুলো ভাঙা ভাঙা। পুরো এলাকাটায় অদ্ভুত এক নির্জনতা।
একদিন ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। ঝাঁ ঝাঁ দুপুরবেলা। কি মনে করে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসে আছি। দেখি অপূর্ব সুন্দর শাড়ি পরা কে একজন একলা ঘাটে বসে আছে । আমি অপলক চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। মানুষ এতো সুন্দর হয়? এমন সময় উনি হাতছানি দিয়ে আমাকে কাছে ডাকলো। আমি আস্তে আস্তে উনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি হাত ইশারায় আমাকে বসতে বললো। আমি কি মনে করে এক ছুটে পালিয়ে এলাম।
কিন্তু কৌতুহলের কারনে আড়াল থেকে উনাকে দেখছিলাম। উনি এক ভাবে বসে আছেন। হঠাৎ হঠাৎ কেউ পুকুরে আসলেও উনি কিছু বলছেন না। একসময় কি মনে হওয়াতে আমি বাসায় চলে আসলাম। এরপর প্রায় প্রতিদিন পুকুরের ধারে যেতে লাগলাম। গেলেই দেখি উনি বসে আছেন।
উনার শাড়ি যেন সদ্য ভাজ ভাঙা। কপালে সিঁদুর এর টিপ। হাত ভর্তি চুড়ি। উনাকে এতো সুন্দর লাগে আমি শুধু তাকিয়ে থাকি। আবার একদিন উনি আমাকে ইশারায় পাশে বসতে বললেন। এবার আর লজ্জা পেলামনা। উল্টো উনার পাশে বসে নিজেকে ধন্য ভাবছি। মনে মনে ভাবছি ইশ আমি এত্তো সুন্দর একজনের পাশে বসেছি?
একদিন উনি আমার সাথে কথা বললেন –
– তোমার নাম কি ময়না? বাসা কোথায়?
আমি বললাম – আদৃতা।
-ভারি মিষ্টি নাম। আর তুমিও নামের মতোই মিষ্টি।
আর সেদিন থেকেই আমার গল্পের ঝুড়ি খুলে গেলো। আমি গল্প করি আর উনি শোনেন।
একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম – তোমার নাম কি গো?
উনি হেসে বললেন – জয়িতা।
নামটা আআমার খুব পছন্দ হোলো। আমি খুশি হয়ে বললাম।
— কি মজা আমি আদৃতা তুমি জয়িতা। আমি অনেক আদরের তো,তাই আমার নাম আদৃতা। তুমি কি জয় করেছো যে তোমার নাম জয়িতা..!!
উনার মুখটা একটু ম্লান হয়ে গেলো। বললেন ।
– আমি দুঃখ কে জয় করেছি। তাই আমার নাম জয়িতা। আচ্ছা তুমি আমার কথা কাউকে বলো?
আমি মাথা নেড়ে বললাম – নাতো কাউকে বলিনি।
— কাউকে বলোনা আমার কথা। কেমন ?
– আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু আমি তোমাকে কি বলে ডাকবো?
– আমাকে তুমি মা বলবে। না থাক পিসিমা বলো। পিসির সাথে মা তো থাকলোই তাইনা…!!
উনি একদিন আমাকে একটা জিনিষ খেতে দেন। কাঁচা সুপারি। এতো স্বাদ,যে কি বলবো। আমি একদিন উনার গায়ের গন্ধ শুঁকেছিলাম। অনেকটা বাসী ফুলের মতো গন্ধ। একদিন আমি দুপুরে চুপিচুপি বাসা থেকে বের হচ্ছি। আর ছোট ফুপি আমার পিছু নিলেন। দুপুরের পর আমাকে ডাকলে নাকি পাওয়া যায়না। প্রতিদিন এতো কোথায় যাই। দেখার জন্য উনি আমার পিছুপিছু পুকুরঘাট পর্যন্ত এলেন।
আর তারপর এক চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালেন। আমি ফুপির চিৎকারে পুকুরঘাট থেকে দৌড়ে ফুপির কাছে চলে আসি। পরে হই হট্টগোল। সবাই ফুপিকে ধরাধরি করে বাসায় নিয়ে আসে। জ্ঞান ফেরার পর ফুপি যা বলেন। তা হোলো, উনি আমার পিছুপিছু পুকুরঘাটে এসে দেখেন। আমি নাকি পুকুরপাড়ে একা একা হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছি। আর মাঝ পুকুরের পানিতে ঠিক আমার সরাসরি অনেকটা সামনে সিঁদুর পরা এক মেয়ের লাশ পানিতে ভেসে আছে।
পরে ব্যাপার টা নিয়ে অনেক হইচই হয়। অনেকেই নাকি এই পুকুরে অনেক কিছু দেখেছে। সবাই আমাকে একসাথে জিজ্ঞেস করা শুরু করে।
আমি কি কিছু দেখেছি? কি দেখেছি? দেখতে কেমন হেন তেন। কিছু দেখে ভয় পেয়েছি কি না?
সবার প্রশ্নের ঠ্যালায়, আমি ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে যেটুকু পাড়ি বলি। তবে আমার কথার সাথে সবার বর্ণনাই প্রায় কাছাকাছি মিলে যায়। সিঁদুর পড়া এক মেয়ে। পুকুরঘাটে বসে থাকে। বা শুয়ে থাকে পানিতে। আমাকে এরপর থেকে কড়া পাহারায় রাখা হয়। হুজুর ডেকে ঝাঁড়ফুক। গলায় তাবিজ। হাতে তাবিজ। কিন্তু দুপুর হলেই আমার ভেতরে খুব ছটফট লাগতো। ভাবতাম একটু যাই। একটু যাই। উনি নিশ্চয়ই আমার জন্য অনেক মন খারাপ করেছেন। এর কিছুদিন পরেই পারিবারিক কারণে আমাদের বাড়িটা ছেড়ে দিতে হয়।
আর আমার আব্বু খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলেন। বহুদিন আগে পাতলা খান লেনে ঘোষ বাড়িতে এক বৌ ছিলো। জয়িতা নাম। সন্তান হতোনা বলে তাকে অনেক অত্যাচার করা হয়। শেষ পর্যন্ত অত্যাচার সইতে না পেড়ে উনি পুকুরে ডুবে আত্বহত্যা করেন। উনার সেই কথাটা আমার স্পষ্ট এখনো কানে বাজে।
— দুঃখ কে জয় করেছিতো? তাই জয়িতা।
আজো উনার সেই সিঁদুর পড়া অপূর্ব মিষ্টি মুখটা মনে গেঁথে আছে। আজো ঘুঘু ডাকা দুপুরে যখন খুব একলা লাগে। মনে হয় যাই। মন খুলে কথার ঝুড়ি উপুড় করে ঢেলে আসি। দু”চার বছর পর একবার ওখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। দেখি পুকুর টা ভরাট হয়ে গেছে।
এখন আর লক্ষ্মীবাজারের পাতলা খান লেন বললে কেউ চেনেনা। এখন গলির মাথায়ই বহুতল মার্কেট। কে এস পি। বি এস পি। আজকাল পিৎজা বার্গার খাওয়া বাচ্চাগুলো হয়তো বুঝবেই না। কি বর্ণীল ছিলো এই এলাকায় আমাদের ছেলেবেলা। ঘুড়ি উৎসব। শবেবরাত এ পটকা। দুইটাকার ঘুঘনি। তাজিয়া মিছিল। সিনেমার নায়িকাদের মুখ আঁকা রিক্সা। বোতলের বদলে হাওয়াই মিঠাই।
কিছু স্মৃতি আসলে ভোলা যায়না। এখনো খালি রিক্সা দেখলে ডেকে বলতে ইচ্ছে করে –
– এই রিক্সা যাবেন….!!
— কোথায়…
— ছেলেবেলায়….!!