সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। স্থানীয়দের কাছে নারিকেল জিঞ্জিরা নামে পরিচিত। সমুদ্রের শো শো শব্দ। ঢেউ পা ভিজেয়ে দিল। দূরে কিছু মাছ ধরার ট্রলার বাঁধা। বন্ধুদের সাথে গতকাল সন্ধ্যায় এসেছি। ৩/৪ দিন থাকব এরপর ঢাকা ফিরব। সেমিস্টার পরীক্ষা শেষ হয়েছে কয়েকদিন হল। কয়েকদিন দিন পরই ইন্টার্নশিপ। এরই ফাঁকে বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করলাম নারিকেল জিঞ্জিরায় আসব। ভোর ছয়টা বেজে কুড়ি মিনিট। বন্ধুরা সব ঘুমে। আমার আবার খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে সজাগ হওয়ার অভ্যাস। সূর্য ধীরে ধীরে উদিতমান এবং তার তেজী দীপ্ত আলো ধীরে ধীরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বিসৃত হচ্ছে।সমুদ্রের ঢেউ দ্বীপের পাথরে আছড়ে পড়ছে।
-“এই আদিব! কি রে?” পিছে ঘুরলাম দেখলাম সাদিফ এদিকেই আসছে।
-“কিরে এত জলদি উঠে গেলি?”
-“আরে বলিস না, এত মশা! সারা রাত তো কামড়ই খেলাম, এমনে কি ঘুমানো যায়?” সাদিফের কণ্ঠে বিরক্তির স্বর।
-“ম্যানেজারকে বলিসনি কয়েলের কথা?”
-“ মানে?” সাদিফের বিস্ময় প্রকাশ।
-“আমরা তো কয়েল চেয়ে নিয়েছিলাম”। বলে মৃদু হাসলাম।
সাদিফ আর কিছুই বলল না। চুপ করে রইল। কি জানি মনে মনে কি খুচুড়ি পাকাচ্ছে।
-“চল হোটেলে যাই, দেখি সবাই উঠেছে কিনা!” বলেই সাদিফ আর আমি হাঁটা দিলাম।
আমাদের হোটেল টা একদম সাদাসিধে। একটা দারুন ব্যাপার আছে। কি তা?
দারুন ব্যাপারটি হল তা সমুদ্রের সাথেই। মানে? মানে একদম সোজা।
হোটেল থেকে বেরিয়ে ১০ কদম হাঁটলেই সমুদ্র, মানে হোটেলের সাথেই সমুদ্র।
হোটেলে ফিরে দেখি রাফি আর বাবর হোটেলের বাইরে চেয়ারে বসে আছে।
-“কিরে কখন উঠলি?” মৃদু হাসি মুখে দুজনকেই আমার জিজ্ঞেস।
-“এই তো মাত্র উঠলাম”। রাফি বলল।
-“চল, ডাইনিং এ চল। নাস্তা করে আসি। ভালোই ক্ষুদা পেয়েছে।
-“আচ্ছা চল” বলেই রাফি, বাবর আর সাদিফ উঠে দাঁড়ায়। সাথে আমিও। হ্যাঁ আমরা চার বন্ধু এসেছি নারিকেল জিঞ্জিরায়, মানে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে।
নাস্তা করে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে বেলা ১১টার দিকে আমরা সাইকেলের দোকানের সামনে এসে হাজির হই। সেন্ট মার্টিন আগেও এসেছি আমরা। ভার্সিটি থেকে। তাই কোথায় কি আছে আমাদের সবই জানা। সাইকেল ভাড়া নিলাম। এরপর শুরু আমাদের দ্বীপে সাইক্লিং করা। পুরো দ্বিপ সাইকেল করে ঘুরে বেড়ালাম। দ্বিপের একদম শেষ মাথায় একটা ডাবের দোকান। আমার খুব ডাব খেতে ইচ্ছে হল। এদিকে আকাশের অবস্থাও ভালো না। কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। এখনি বুঝি ঝুম বৃষ্টি নামবে। রাফি, বাবর আর সাদিফকে জিজ্ঞেস করলাম ডাব খাবে কিনা। ওরা কেউই রাজি হল না। ওরা সাইকেল নিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। আমি আসছি বলে সাইকেল এক পাশে সাইড করে দোকানের বাইরে বেঞ্ছে বসে পড়লাম। মামা কে বললাম একটা ডাব কাটতে।
ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে গেল। মেঘলা আকাশ। এখনি বুঝি ঝুম বৃষ্টি নামবে।
-“মামা ডাব কত?”
মিষ্টি গলায় পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল। পিছনে ঘুরলাম। নীল সেলোয়ার কামিজ পড়া এক মেয়ে।
-“৭০ টাকা!”
-“৬০ টাকায় দিয়ে দেন”।
-“কোনটা কাটব?”
-“এই যে এটা কাটেন”।
-“বসতে পারি?”
-“জ্বি, আমাকে বলছেন?” অপ্রস্তুত স্বরে বললাম। “বসুন না”।
-“ধন্যবাদ”।
উত্তরে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম।
-“আপনাকে আমি দেখেছি আজ সকালে”। মেয়েটি বলল।
– “আমাকে?” অবাক হলাম মেয়েটির কথায়।
-“ হ্যাঁ, ব্লু শার্ট রাইট?”
-“হ্যাঁ কিন্তু আপনি?”
– “কিভাবে জানলাম? আমি আপনার আশে পাশেই ছিলাম। একটু দূরে, তাই আপনি খেয়াল করেন নি। পুরো বিচে শুধু আপনি আর আমিই ছিলাম”।
-“দুঃখিত, আমি খেয়াল করিনি”।
-“ঠিক আছে, আপনি সমুদ্রের ধারে পাথরের উপর বসে সমুদ্রের অদূরের ঢেউয়ের সাথে হারিয়ে গিয়েছিলেন”।
-“বাহ আপনি বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। গল্প কবিতা লিখেন বুঝি?” আমার জিজ্ঞেস।
-“টুকটাক লিখি তবে বেশির ভাগ সময় কাটে বই পড়ে”।
-“বাহ, একজন লেখিকার সাথে আমার পরিচয় হল”।
-“এভাবে বলে লজ্জা দিবেন না”। মেয়েটির মুখে হাসি।
-“না না”। আমিও হেসে ফেলি।
-“আপনি লেখা লেখি করেন?” মেয়েটির আগ্রহ প্রকাশ।
-“ না, আসলে পড়ার অনেক প্রেশার থাকে তাই ওভাবে সময় হয়ে উঠে না। তবে ইমদাদুল হক মিলনের লেখা ভালো লাগে”।
-“তাই? আমারও ইমদাদুল হকের লেখা অনেক ভালো লাগে। আমার প্রিয় লেখক”। মেয়েটি বলল।
হঠাৎ মেঘের প্রচন্ড গর্জন সাথে বাতাস বইছে।
-“বৃষ্টি আসবে হয়ত”। উদ্বিগ্নের সাথে আমি বললাম।
– “ভালই হবে”। মেয়েটি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল।
উত্তাল সমুদ্র ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে।
-“আপনি বৃষ্টি পছন্দ করেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
-“হ্যাঁ, প্রচন্ড। আপনি করেন না?”
-“ হ্যাঁ করি”।
মেয়েটি আমার দিকে তাকাল। মায়াবী চোখ। চেহারার মধ্যেই একটা মায়া আছে।
বাতাস বন্ধ হয়ে বৃষ্টি পড়া শুরু হল। প্রথমে ধীরে ধীরে এরপর পুরো দমে। আমি আর মেয়েটি দোকানের ভিতরে ঢুকে বসলাম।
-“আপনার নাম জানা হলো না”।
-“নীলা”, নীলা আমার নাম”। আপনার নাম?
-“ আদিব”।
বাইরে বৃষ্টি। প্রচন্ড মেঘের গর্জন। নীলা বাইরের বৃষ্টি উপভোগ করছে। আর আমি পলকহীন চোখে নীলাকে দেখছি। হঠাৎ নীলা আমার দিকে তাকালে আমি দৃষ্টি সরিয়ে নেই।
-“তো, ফ্রেন্ডদের সাথে এসেছেন নিশ্চয়ই?” নীলার জিজ্ঞেস।
– “হ্যাঁ, আপনি?”
– “আমিও আমার ফ্রেন্ডদের সাথে এসেছি”। বলেই নীলা আবার বাইরে তাকাল।
-“পড়াশুনা করছেন? নাকি চাকরি?” আমার প্রশ্ন শুনে নীলার আনমনা ভাব কেটে গেল। আমার দিকে তাকাল আবার।
-“ফাস্ট ইয়ার, ট্রিপল ই নিয়ে পড়ছি”। নীলার উত্তর।
-“ওহ! কোন ভার্সিটি ?”
– “বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি”।
-“বলেন কি! বাইউস্টে?” বিস্মিত কণ্ঠে বললাম।
-“আপনি আমার ভার্সিটি চিনেন?” নীলার বিস্ময় প্রকাশ।
-“কেন চিনব না, তুমি তো আমার ডিপার্টমেন্টে দেখছি। আমি ফাস্ট ব্যাচ, ট্রিপল ই। সরি, তুমি করেই বলে ফেললাম”।
– “আল্লাহ!! কি বলেন? আপনি বাইউস্টে পড়েন!!”
-“হ্যাঁ”।
-“কোন ইয়ার?”
-“ফাইনাল ইয়ার।
দুজনের মুখে হাসি। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ডাব ওয়ালা ডাব কেটে নীলার হাতে দিল।
-“ডাব খাবেন?”
-“না, তুমি খাও, আমি খেয়েছি”।
যত দেখছি ওকে ততই মুগ্ধ হচ্ছি। ডাবের পানি খেয়ে নীলা উঠে দাঁড়ায়। বৃষ্টিও বন্ধ হয়ে এসেছে।
-“আমি তাহলে উঠি”।
-“চল তোমাকে এগিয়ে দেই, কোন হোটেলে উঠেছ?”
-“হোটেলের নামটা ঠিক মনে পড়ছে না, এই তো উত্তর দিকেই, চলুন”।
-“আচ্ছা চল”।
নীলার সাথে হাটতে হাটতে হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। খুব আলিশান হোটেল। খুব পয়সাওয়ালারা এই হোটেলে উঠে। রুমের ভাড়া পার ডে অনেক বেশি।
-“হোটেলের নিচে ক্যান্টিন আছে। চলুন কফি খাব”। নীলার প্রস্তাব।
-“ না না এখন না”।
– “তাহলে বিকেলে?” নীলার জিজ্ঞেস।
-“দুপুরে খেয়ে ঘুমাতে পারি যদি বিকেলে উঠতে…”
-“ আচ্ছা সন্ধ্যায়?”
– “আচ্ছা ঠিক আছে”।
-“ কথা দিচ্ছেন তো, হারিয়ে যাবেন না তো?”
হারিয়ে যাওয়ার কথা শুনে নীলার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মৃদু হেসে বললাম –“তোমার নাম্বারটা?”
নীলা হাসলো । “০১৭১ …” । নাম্বারটা সেভ করলাম।
-“ আচ্ছা আসি”। নীলা হেসে বিদায় জানালো আমাকে। নীলা চলে গেল, আমি আমার গন্তব্যে চলমান। নীলা চলে গেলেও নীলার মায়ার রেশ এখনো হৃদয়ে ছুঁয়ে আছে। কেমন যেন অদ্ভুত এক মায়া আছে মেয়েটার মধ্যে। নীলার প্রতি অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে। এই অদ্ভুত অনুভুতির উৎপত্তির কারণ জানা নেই তবে এমন এমন অনুভুতি আগে কখনো হয়নি। কই মনি তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, ওর প্রতি তো এমন অনুভূতি হৃদয়ের গহীনে আঘাত করেনি! তবে কি আমি নীলাকে ভালোবেসে ফেললাম। এত দ্রুত? নীলাকে আমি চিনিও না। একটু আগেই ওর সাথে আমার পরিচয়। এত অল্প পরিচয়ে ভালবাসার অনুভুতি? না আর ভাবতে পারছি না।
সাইকেল দোকানে জমা দিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে পথ ধরলাম। এখানে একটা স্কুল আছে। ছুটির ঘণ্টা বাজল। সবাই হৈ হৈ রৈ রৈ করে স্কুল গেট দিয়ে বের হচ্ছে। ফেলে আসা স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। কুমিল্লা জিলা স্কুলের সময়টা দারুন ছিল।
হোটেলে ফিরে রাফির সাথে দেখা।
-“কিরে কোথায় ছিলি এতক্ষন?”
-“আরে বলিস না, বৃষ্টিতে আটকে গিয়েছিলাম। একটা দোকানে বসে ছিলাম।
-“ওহ”।
-“খেয়েছিস তোরা?” রাফিকে আমার জিজ্ঞেস।
-“হ্যাঁ”।
-“ঠিক আছে”। বলে হোটেলের ডাইনিং এর দিকে পা বাড়াই। দুপুরের খাবার খেয়ে রুমে চলে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেই। কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি। এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এল। ঘুম ভেঙ্গে দেখি অন্ধকার রুম। বুঝতে পারলাম সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বের হওয়ার সময় অবশ্য বন্ধুদের খোঁজ করেছিলাম। ওরা কেউই রুমে ছিল না। কই গিয়েছে কে জানে?
আলিশান সেই হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ভুলে গেলা? এখানেই তো নীলা উঠেছে। নীলাকে একটা ফোন করা যাক। এমনও তো হতে পারে রুমে নেই।
-“হ্যালো, নীলা!”
ফোনের ওপাশ থেকে মিষ্টি একটা কণ্ঠ শুনতে পেলাম – “কে?”
-“আমি আদিব বলছি, আজকে সন্ধ্যায় দেখা করার কথা ছিল”।
-“ওহ আচ্ছা, আপনি কি এসেছেন?”
-“হ্যাঁ, হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি”।
-“আপনি ভিতরে আসুন, আমি নিচে নামছি”।
নীলার কথা মত হোটেলের ভিতরে প্রবেশ করলাম। আলিশান এবং বেশ বড় হোটেল। নীলা নিচে নেমে এল।
-“আসুন আমার সঙ্গে”। বলেই আমাকে নিয়ে সোজা ক্যান্টিনের দিকে চলে গেল। দক্ষিনের একটা টেবিল ফাঁকা ছিল। আমরা ওখানেই বসলাম। নীলা ২ কাপ কফি অর্ডার দিল। ছোট্ট ক্যান্টিন। পূর্ব দিকের ওয়ালে বেশ বড় একটা ঘড়ি। ৭টা বাজে।
-“কফি বেশি খান নাকি চা?” নীলার জিজ্ঞেস।
-“আমি প্রচুর কফি খাই”। আমি বললাম।
-“সত্যি? মিলে গেল। আমিও প্রচুর কফি খাই। এক কথায় বললে সেরকম কফি খোর”।
নীলার কথা শুনে হেসে ফেললাম। নীলাও মুচকি হাসল।
-“তুমি অনেক সুন্দর করে কথা বল”।
নীলা উত্তরে কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
-“কি হল, কি দেখছ এমন করে? আমার জিজ্ঞেস।
-“আপনি খুব সিম্পল একটা মানুষ, স্পষ্টবাদী, মনে যা আসে বলে দেন”।
-“কেন তুমি এরকম মানুষ পছন্দ কর না?” নীলাকে আমার জিজ্ঞেস।
উত্তরে আবারও নীলা কিছুই বলল না। মুচকি হাসল।
মেয়েটা যতটা মায়াবী ততটাই রহস্যময়ী। চোখ, চোখের ভ্রু, কথা বলার ধরন, হাসি সাহিত্যের ভাষায় বলতে গেলে অকল্পনীয় সুন্দর। আমি কি নীলার প্রেমে পড়ে গেলাম?
-“কি ভাবছেন?”
-“না কিছু না”।
-“কিছু তো একটা ভাবছেন, কি খুচুড়ি পাকাচ্ছেন বলেন?”
নীলার কথায় মুচকি হেসে বললাম- “ না কিছুই ভাবছি না”।
ওয়েটার এসে ২ কাপ কফি টেবিলে রেখে গেল।
-“নিন, কফি নিন”।
-“পাহাড় পছন্দ করো নাকি সমুদ্র?” আমার জিজ্ঞেস।
-“সমুদ্র। তা নাহলে এখানে আসতামই না। আপনি কি পছন্দ করেন?”
-“সমুদ্র”। তোমার মতই।
নীলা হেসে ফেলে। “আপনার পছন্দের রং নীল তাই না?”
নীলার কথা শুনে চমকে উঠলাম। “তুমি কি করে জানলা?”
-“আপনি নীল শার্ট পড়ে আছেন তাই ভাবলাম প্রিয় রং নীল হয়তো”।
মেয়েটার চিন্তা শক্তি দেখে আমি মুগ্ধ হলাম।
-“ তোমার প্রিয় রং কি?”
-“ আমার প্রিয় রং?” নীলা বলল।
– “হুম”।
-“ঐ আকাশটা দেখছেন? ঐ আকাশের রং ই আমার খুব পছন্দ। আমার না খুব আকাশ পছন্দ”।
-“আমার জীবনটা আকাশের মতই কিন্তু একটু পার্থক্য আছে”। আমি বললাম।
-“কি পার্থক্য?”
-“আমার আকাশে শুধু কালো মেঘরা ভীড় জমায়। প্রচন্ড মেঘের গর্জন হয়। বৃষ্টি হয়। কিন্তু…. কখনো রোদ উঠে না”।
-“বুঝলাম না”। নীলা অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
-“কাল সকালে তোমার সাথে দেখা হবে। ঠিক ৭টায়। বিচে। যেখানে তুমি আমাকে দেখেছিলে ঠিক সেখানটায়”। বলে উঠে দাঁড়াই।
-“ আচ্ছা”।
-“আসি”। বলেই আমি ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে হোটেলের সীমানা পেরিয়ে নিজের পথ ধরি।
মনটা কেমন যেন হয়ে আছে। সত্যি তো। আমার মনটা আকাশের মত অনেকটা। আমার আকাশে শুধু কালো মেঘরা ভীড় জমায়। প্রচন্ড মেঘের গর্জন হয়। বৃষ্টি হয়। কিন্তু…. কখনো রোদ উঠে না”। কেন উঠে না? সে না হয় আরেকদিন বলব।
পরদিন। সকাল ৭টা। সমুদ্রের ধারে পাথরের উপর বসে আছি। ঢেউয়ের শো শো শব্দ। সেন্ট মার্টিনের ঢেউ কক্সবাজারের ঢেউয়ের মত উত্তাল নয়। দূরে মাছ ধরার কিছু ট্রলার বাঁধা। হঠাৎ আকাশে কিছু পাখি দেখতে পেলাম। পূর্ব দিকে সূর্য অনেক আগেই উঠে গেছে। কিন্তু আমার জীবনে সূর্য উঠে না কেন? এখনো সঠিক মানুষটার অপেক্ষায় আছি। কি যা তা বলছি। রুপাই আমার জীবনের সঠিক মানুষটা ছিল। রুপা? রুপা কে? রুপা আমার জীবনের এক সমাপ্ত গল্পের নাম। যে আমার জীবন থেকে চলে গিয়েছে ঠিকই কিন্তু তার স্মৃতি আমার জীবন থেকে চলে যায় নি বরং প্রায়ই কাঁদায়। এক ব্লাড ক্যান্সার নামক ভয়ার্ত দানব রুপাকে আমার থেকে কেড়ে নিল।
হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন আমার চোখ ধরল। অন্ধকার হয়ে আসলো চারপাশ।
-“কে? কে আপনি?”
-“ আমার আকাশে শুধু কালো মেঘরা ভীড় জমায়। প্রচন্ড মেঘের গর্জন হয়। বৃষ্টি হয়। কিন্তু…. কখনো রোদ উঠে না”।
কণ্ঠ আর কোমল হাতের স্পর্শে বুঝলাম নীলা।
-“নীলা!”
নীলা হেসে বলল- “হ্যাঁ, আমি। আমাকে কেমন লাগছে?”
হালকা আকাশি রঙের টাঙ্গাইলের সুতির শাড়ি। নিশ্চয়ই সকাল বেলা গোসল করেছে। খুবই ফ্রেশ লাগছে নীলাকে। যেন এই মাত্র ফুটে উঠা এক পদ্ম ফুল। ঘন চুল। মাথার পিছনে চুল গুলো গোছা করে ক্লিপ দিয়ে আটকানো। ঠোটে হালকা লাল খয়েরি রঙের লিপস্টিক। খুব মিষ্টি একটা পারফিউমের ঘ্রান পাচ্ছি।
-“রূপকথার রাজকুমারীদের মত লাগছে তোমাকে। অপূর্ব”। মুগ্ধ চোখে নীলার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
নীলা তো লজ্জায় মুচকি হেসে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
-“বস না?” নীলাকে বললাম।
নীলা ঠিক আমার পাশের পাথরটার উপর বসল।
-“গুড মর্নিং”।
-“গুড মর্নিং”। নীলার মুখে হাসি। “আমি আপনাকে তুমি করে বলতে পারি?”
-“খুব দ্রুত আমাকে আপন করে নিলে। এই সাজ কি আমার জন্য?” নীলাকে আমার জিজ্ঞেস।
-“যদি বলি হ্যাঁ”।
-“কেন? আমার জন্য কেন?”
নীলা নিচের দিকে তাকিয়ে বলল –“ যদি বলি মানুষটাকে আমি চাই আজীবনের জন্য, আমি কি ভুল করব?”
নীলার এই কথা শুনে ভাষা হারিয়ে ফেললাম। চেয়ে আছি নীলার দিকে। আমি তাহলে সত্যি নীলাকে ভালোবেসে ফেলেছি? কি অদ্ভুত এক অনুভুতি কাজ করছে ওর প্রতি। মন চাইছে নীলাকে জাপ্টে ধরে বলি আমিও তোমাকে ভালোবাসি।
-“এর উত্তর তুমি বাইউস্টে পাবা”।
-“বাইউস্ট মানে?” নীলার কৌতূহল প্রকাশ।
-“আমাদের ভার্সিটি! ক্যাম্পাসে এর উত্তর দিব। আগামী ২৮ জুন আমি ক্যাম্পাসে যাব। আসবা তো?”
-“আসতে যে আমাকে হবেই”। নীলা বলল।
-“তোমার ফেসবুক আইডিটা দাও”। নীলাকে বললাম।
-“নীলা চৌধুরী”।
-“পেয়েছি”। ফ্রেন্ড রিকয়েস্ট পাঠালাম নীলাকে। ও সাথে সাথে একসেপ্ট করল।
-“আমি আজকে চলে যাব”। আমি বললাম।
-“কোথায়?” নীলার জিজ্ঞেস।
-“কুমিল্লা। পরশু থেকে তো ভার্সিটি খোলা”।
-“হ্যাঁ। আমি কাল যাব”। নীলা বলল।
-“কাল গিয়ে পরশু ক্লাস করতে পারবা? টায়ার্ড লাগবে না?”
-“তুমি আমার জন্য এত্ত চিন্তা করছ কেন?” নীলা জিজ্ঞেস করল।
-“চিন্তা করব না?”
-“কেন চিন্তা করবা?”
নীলার কথায় কি বলব বুঝতে পারছি না।
-“দেখ তোমার ক্লাস করতে কষ্ট হতে পারে তাই বলছি “।
-“সোজা বাংলায় বলে ফেল না তুমিও আমায় ভালোবাসো”।
-“বললাম তো ভার্সিটি আসো, বলব”।
-“কেন? এখন বল। আমি এখন জানতে চাই”। নীলা বলল।
-“আমি আসি”। বলে উঠে যাচ্ছিলাম। নীলা আমার হাত ধরে ফেলে।
-“আদিব। আমি তোমাকে নিয়ে সিরিয়াস। প্লিজ এমন করো না আমার সাথে। প্লিজ আদিব। আচ্ছা আমি বলছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি। সত্যি অনেক ভালোবাসি”।
-“সত্যি অনেক ভালোবাসো?” আমার জিজ্ঞেস।
নীলা আমার দিকে তাকিয়ে রইল। “আমি মিথ্যে বলছি?”
-“তুমি কখনো মিথ্যে বলতে পার?” মৃদু হেসে বললাম।
-“বলতেও পারি”।
-“আমার নীলা কখনো মিথ্যা বলতে পারে?” নীলার হাতটা ধরলাম। নীলা আমার দিকে তাকাল। সমুদের শো শো শব্দ। ঢেউ পা ভিজেয়ে দিল।
২৮ জুন ২০১৯। বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনলজি। বৃহস্পতিবার। ক্যাম্পাস ১। বর্ষাকাল। আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। মাঝারি আকারের ক্যান্টিন। ক্যাম্পাস ২ থেকে বিবিএ আর সিভিলের কিছু জুনিয়র এসে বসেছে। ক্যান্টিনটি সেনাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। আজকে লাঞ্ছের মেন্যু ডিম খিচুড়ি। সেই ডিম খিচুড়ি নিয়েই বসে আছি। নীলা আসবে বলেছিল। বলেছিল একসাথে আজকে লাঞ্চ করবে। কিন্তু এক্সট্রা ক্লাস পড়ে গিয়েছে। হামিম স্যার নিচ্ছেন ক্লাসটা। আমার মন একটু খারাপ। একসাথে লাঞ্ছ করা তো দূরে থাক আজকে একসাথে যাওয়াই হবে না। একটু পরেই ভার্সিটি বাস ছাড়বে। দ্রুত খেয়ে নেই। হঠাৎ ফোন ভাইব্রেট করে উঠল। মেসেজ এসেছে মোবাইলে। গ্রামীন ফোন থেকে কোন অফারের মেসেজ। আবার অনেক সময় নীলাও ক্লাসে থাকলে এভাবে মেসেজ দেয়। আচ্ছা খাওাটা শেষ করে মেসেজটা দেখব।
খাওয়া শেষ করে ফ্রেশ হয়ে বাসে উঠে বসে আছি। সাদা বাস। বাস নাম্বার ১। বাইউস্টের প্রথম বাস। কত স্মৃতি এই বাসে। বাম দিকের লাস্টের ৩ সিট আগের এই সিটটাতেই প্রায়ই আমি বসি।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে অন করলাম। মেসেজ অপশানে গিয়ে দেখলাম একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। তাতে লিখা –“কেমন আছো?”
নাম্বারটা খুব পরিচিত পরিচিত লাগল। কে আমাকে মেসেজ দিল। আমার কোন ফ্রেন্ড? কে হতে পারে? ভাবতে ভাবতেই বাস স্টার্ট দিয়ে ছুটে চলল কুমিল্লা শহরের গন্তব্যে। আমি কানে হেডফোন লাগিয়ে আরজিত সিং এর গান শুনতে শুনতে বাইরের দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ আবার একটা মেসেজে ফোন ভাইব্রেট করল। আবার ঐ অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ তাতে লেখা – “এত জলদি আমাকে ভুলে যেতে পারলে?”
কে হতে পারে? কেউ কি আমার সাথে মজা করছে? আমার মনে হয় মজাই করছে। বাস কান্দিরপাড় এসে থামলে। একে একে সবাই বাস থেকে নামছে। অনেক জ্যাম কান্দিরপাড়ে। সবার নামার পর বাস থেকে নামলাম।
রাত ৮ টা বেজে ২০ মিনিট। কাল বায়ো-মেডিকেল এক্সাম। গভীর মনোযোগে যখন বইয়ের পাতায় ডুবে ছিলাম তখনি ডোর বেল বেজে উঠল। দরজা খুললাম। একটা অপরিচিত ছোট্ট ছেলে।
-“কাকে চাই?”
-“আপনি আদিব?”
-“হ্যাঁ, কেন?”
-“আপনার জন্য”।
-“আমার জন্য?” অবাক হলাম। একটা শপিং ব্যাগ আমার হাতে তুলে দিল ছেলেটি।
-“কে দিয়েছে?”
-“একটা আপু”।
-“কোন আপু? নাম কি?”
-“নাম তো জানি না”।
-“আচ্ছা তুমি যাও”।
দরজা আটকিয়ে রুমে চলে আসলাম। শপিং ব্যাগের মুখ স্ট্যাপলার দিয়ে আটকানো। মুখ খুললাম। কালো রঙের একটা শার্ট। তখনি ফোন আবার ভাইব্রেট করে উঠল। মেসেজ চেক করলাম। তাতে লেখা – “সারপ্রাইজ গিফট কেমন লাগল?”
আমি উত্তরে লিখলাম –“কে আপনি?”
-“তোমার খুব কাছের কেউ”।
আমি আবার মেসেজ এ লিখলাম – “কে? আর আমাকে গিফট পাঠানোর মানে কি?”
-“রবিবার শার্টটা পড়ে ভার্সিটি আসবা”।
-“আপনার কথা আমি শুনব কেন? আপনি আমার কে হন?”
-“আমি তোমার রক্তের সাথে মিশে আছি”। এটা পড়ার সাথে সাথে একটু অবাক হলাম। ঐ নাম্বারে কল দিলাম। প্রথমবার কল কেটে দিল। দ্বিতীয়বার সুইচ অফ পেলাম।
রবিবার। বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনলজি ক্যাম্পাস।
বিশাল লাইব্রেরি রুম। বুক শেলফে প্রচুর বই। জুনিয়ররা পড়ায় মগ্ন। কেউ বা চুপি চুপি আড্ডা দিচ্ছে। আমি আর নীলা লাইব্রেরির বাইরে বসে আছি। আমি সেই কালো শার্ট পড়েই এসেছি। কে হতে পারে? আমার পরিচিত কেউ? কোন ফ্রেন্ড? কেউ আমার সাথে মজা করছে না তো?
-“কি হল তুমি আজ এত্ত চুপ চাপ?” নীলার জিজ্ঞেস।
-“না কিছু না এমনি। ক্লাস টেস্ট কেমন হল?”
-“ভালোই”।
হঠাৎ ক্যান্টিনের ওদিক থেকে শোরগোল শুনা গেল। আমি আর নীলা উঠে লাইব্রেরির পিছন দিক দিয়ে ক্যান্টিনের দিকে যেতেই দেখলাম সিএসসির জুনিয়রদের একটা ভীড়। সবাই ভয়ার্ত মাখা বিস্ময় কিংবা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। ভীড় ঠেলে সামনে এসে যা দেখলাম তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
-“কি খবর আদিব? কেমন আছো?”
এ আমি কি দেখছি। স্বপ্ন দেখছি না তো।
-“তুমি?”
-“হ্যাঁ আমি, আমি রূপা, আমি জীবিত”।
আমি তখন বিস্ময়ের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। একটা মরা মানুষ কিভাবে জীবিত হতে পারে?
-“আদিব ও কে?”
-“তুমি নিশ্চয়ই আদিবের গার্লফ্রেন্ড!”
– “হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে?”
-“সেটা আদিবকেই জিজ্ঞেস কর? কি আদিব? আমি তোমার কি হই?”
আমি সত্যি বুঝতে পারছিনা আমি কি করব। নীলাকে কি উত্তর দেব। আমার হারিয়ে যাওয়া অতীত এভাবে ফিরে আসবে আমি কল্পনাও করিনি।
-“এই রুপা তুই আয় তো, ক্যান্টিনে আয়। বসে ঠাণ্ডা মাথায় সব শুনব তোর কাছ থেকে। সাবিহা রুপাকে টেনে ক্যান্টিনে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় বার বার রুপা আমার দিকে তাকাচ্ছিল।
-“মেয়েটা কে আদিব? সত্যি করে বলো ? চুপ করে থাকবে না? প্লিজ! বল মেয়েটা কে?”
-“নীলা আমি তোমাকে কি বলবো, বললে তুমি বিশ্বাস করবে না”।
-“আমি বিশ্বাস করব তুমি বলো”। প্লিজ! বলো”।
-“মেয়েটার নাম রুপা”।
-“তারপর বল, আমি জানি ওর নাম রুপা”।
-“ও মারা গিয়েছিল শুনেছিলাম কিন্তু এখন তো দেখছি জীবিত।
-“মানে? আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে মানলাম রং ইনফরমেশান পেয়েছিলা কিন্তু মেয়েটার সাথে তোমার সম্পর্ক কি?”
-“ সম্পর্ক ছিল”।
-“সম্পর্ক ছিল নয়, সম্পর্ক এখনো আছে”। ট্রিপল ই ক্লাসরুম নাম্বার ৬ এ রুপার প্রবেশ।
-“আপনি বলবেন আর আমি বিশ্বাস করব? বাহ!
-“এই ছবিটা দেখ”। রুপা তার ফোন থেকে আমাদের অতীতের একটা ছবি নীলাকে দেখায়।
নীলা চুপ হয়ে যায়।
-“আমি আসি”। বলেই নীলা দ্রুত ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে যায়। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
রুপা ছল ছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। আমিও রুপাকে জড়িয়ে ধরি। এক বিন্দু অশ্রু চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে। তখনই শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি। আকাশ পাতাল এক করে মেঘের কি গর্জন! আমাদের এই মুহূর্ত টুকু নীলা আড়াল থেকে দেখেছিল আমি জানতাম না।
নীলা হারিয়ে গেছে। অজানার কোন দেশে। যেখানে গেলে কেউ আর ফিরে আসে না। একটা বদ্ধ ঘরে নীলার বসবাস এখন। অন্ধকার ঘর। কোন আলো বাতাস নেই। নীলা অনেক দূরে হারিয়ে গেছে। আচ্ছা আমার কি? আমি তো রুপাকে ফিরে পেয়েছি। জানি না। আমার আকাশে এখন সূর্য উঠে, মেঘেরা খেলা করে কিন্তু নীলা নামক চাঁদ আমার আকাশে দেখা যায় না। নীলা হারিয়ে গেছে। অনেক দূরে। অজানায়। অজানায় নীলা।
(সমাপ্ত)