- আমার ছেলেবেলা, বর্তমান ও অন্যান্য
দিনটি ছিলো আরো আট দশটা সাধারণ দিনের মতোই।বন্ধুকে কল দিয়ে বললাম,”আরেফিন এলাকায় আয়।”
আরেফিন বললো, “এখন কেনো শালা?”
ইমারজেন্সী বলাতে চলে এলো।প্রায় ৩০ মিনিট মাদ্রাসা রোডে দাড়িয়ে থাকার পর এলো সে। রিকশায় উঠলাম দুজন। বললাম, “মামা গলাকাটা চলো।”
আরেফিন আমার ছোটবেলার বন্ধু।তাদের এলাকায় নিজেদের পুরোনো আমলের একতলা বাড়ি আছে।একবার এক স্কুল ফ্রেন্ড কে এলাকা ঘোরাতে নিয়ে এসেছিলাম।ওদের বাড়ি দেখে সে বলে উঠলো,”বন্ধু,তোদের এলাকায় দেখি ব্রিটিশ আমলের বাড়ি।”
আরেফিন দের বাসায় অনেক বছর আমরা ভাড়া থেকেছিলাম।ওদের নিজেদের বাড়ি হলেও বেশ টানাপোড়েনের সংসার ছিলো তবে খুশির অভাব ছিলো না।ওদের বাড়ির ছাদ আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা গুলোর মধ্যে একটি। আমাদের দুজনের ইতিহাস বলতে গেলে ছোটবেলার সোনালী সময়ের ইতিহাস। মারবেল,লাটিম,ঘুড়ি উড়ানো,বাড়ির সামনে মাছ চাষ করতাম, ঈদ কার্ড লটারির দোকান দিতাম। দুরন্ত ছিলাম বেশ। সে খুব জেদী ছিলো। আমার একটা বিশেষ গুণ ছিলো। আমি হাবাগোবা ছোটবেলা থেকেই কিন্তু আমার পরিচিত ও কাছের মানুষগুলো আমাকে খুব বিশ্বাস ও ভরসা করতো। ওদের বাড়ির আশেপাশে তখন বিল ছিলো। আমাদের এলাকার নাম এখনও বিল বলা হয় যদিও বিলের ছিটেফোটাও নেই।চারিদিকে দালান কোঠায় ছেয়ে গেছে। আরেফিনদের বাসার পেছনে একটা কদম গাছ আর সামনে বরই আর পেয়ারাগাছ ছিলো।প্রতি সিজনেই টাটকা পেয়ারা খেতাম ছাদে বসে বসে।
আরেফিনদের বাসায় গ্যাসবিল শোধ না করায় লাইন কেটে দেয়ার পর আমরা অন্য বাসায় চলে যাই।তবুও ওই ছাদের টানে বারবার চলে যেতাম। ওর আপু আর মা আমাকে খুব আদর করতো। তারপর সময় এর অভাবে দুরত্ব বেড়ে যায়।একসময় দুজন দুজনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে গেলাম নিজেদের অজান্তে। তখন হাইস্কুলে পড়াকালীন রক্ত বেশ গরম ছিলো।আমি হাবাগোবা হলেও এসব মারামারি তে খুব এক্সপার্ট ছিলাম।আর আমার সব সময় কার সহযোগী আমার বিপরীতে তখন। স্কুলে যাওয়ার পথে সে আমার শত্রুপক্ষকে দুর্বলতা দেখিয়ে প্রথম আঘাত করে।সেদিন স্কুলে গিয়ে ব্যাগ আছাড় মেরে আবার বেরিয়ে চলে আসি।তখন আমার একজন ভালোবাসার মানুষও ছিলো। সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো।ফিরে এসে আমার বাকি সাগরেদ দের ডেকে আরেফীনকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসি।আরেফীনের মা ও সাথে চলে আসে।আমার কান্ড দেখে সে হতবাক হয়ে যায়। সে বিশ্বাস ও করতে পারছিলো না আমরা এভাবে একজন আরেকজনের বিপরীতে এভাবে দাড়াবো। হালকা হাতাহাতির পর তার মা তাকে নিয়ে গেলো। ভাবলাম বিকেলে তার গ্যাং সুদ্ধ ধরে কেলাবো। বিকেলে গেলাম টহল নিয়ে কাউকে না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিলো সবাই। আমি, বল্টু আর প্রাণের প্রিয় মেহেদি(পরবর্তীতে আসবে এর কাহিনী) তিনজন ছিলাম শুধু আলাদা।
হঠাৎ তার দলবল ঘেরাও করলো আমাদের মাঠে নিয়ে গেলো আমাকে আলাদা করে ফেললো যেহেতু আমি তাদের গুরু ছিলাম।প্রায় ১৫/২০ জন মিলে আমার উপর সুনামি চালালো।এদিকে মেহেদী আর বল্টু কে নিয়ে আরো ৩০/৪০ জন মিলে মেরে ফাটিয়ে দিলো।প্রায় ৫০ এর বেশি জড়ো হলো ওরা।এদিকে রাস্তায় মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। আমার ব্যাক আপ চলে আসলো ১০ মিনিট পর।পাবলিকের সামনেই আমার সেই প্রিয় বন্ধু আর তাদের দলের নাটের গুরুকে কড়া মাইর দেয়া হলো। আমি চলে গেলাম।বাসায় ঝামেলা হলো। প্রেশার দূর করতে অনেক দূরে আরো একটি সুন্দর গ্রাম মিজমিজির বিলের মাঝে আমার কিশোর বাহিনী নিয়ে খেলতে চলে গেলাম। বাড়ি ফিরে শুনি আমার সেই বন্ধুকে এলাকার খেলার মাঠে আমার আরেক বন্ধু আমাকে মেরেছে তার ক্ষোভ মেটাতে ধরে মেরে গিয়েছে।যথারীতি এর দায় আমার উপরেই পড়লো।মাথামোটা বল্টু কিছু না বুঝে ভয়ে আমার নাম বলে দিলো।
এদিকে আমার সেই বন্ধু যে এই কান্ড ঘটিয়েছে সেও কমিশনারের কাছে বিচারে গিয়ে আমার নাম বলে দিলো। আমি উভয় সংকটে পড়ে গেলাম।যাই হোক সে যাত্রায় নিজেকে বাচিয়ে নিলাম।কিন্তু আমার সেই কিশোর বাহিনীর মাঝেই কিছু বিষাক্ত সাপ লুকিয়ে ছিলো।যারা আমাকে আমার জীবনের সবচেয়ে কলংকজনক দায় চাপিয়ে দেয়।যেই অভিশাপ আমি আজও বয়ে বেড়াই। সবার কাছে সব হারিয়ে আমার সাথে আবার আরেফিনের যোগাযোগ হয়।সব ভুলে সেও আমাকে আপন করে নেয়।কোনো অভিযোগ নেই, নেই আমারও।আছে শুধু কিছু বিষাক্ত বন্ধুরূপী সাপের প্রতি ক্ষোভ।
আজ আমরা যাচ্ছি একটা বিশেষ কাজে।যদিও কাজটা আমার।কিন্তু আমার কাজ মানে তো তার কাজ।
মোটরচালিত রিকশা বটতলার রাস্তা পার করে অন্ধকার আর আলোর পথ ধরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।
চলবে…..