প্রথম পর্বের পর থেকে: আর হে শোন, দুই বিরা পান আনিস, সুপারি আছে। দেরি করিস না।
কাজেম বিষণ্ন মনে বাজারের পথে রওয়ানা দিলো।
বাজার করে ফেরার পথে পুলের ধারে পূর্বপাড়ার জসীমের সাথে দেখা, কী রে দোস্ত, ঈদ মোবারক!
– হুম ঈদ মোবারক।
-কিতারে আজকে মোরগ কিতা?
-না রে গোশত তেমন পাইছি না।
জসীম মনে মনে ভাবতে লাগল, অথচ এই গ্রামে কমপক্ষে ৩০/৪০টা গরু কুরবানি হলো, অথচ অনেকে দুই টুকরাও পায় না। জসীম বদদোয়া , আল্লাহ গো গ্রামের ফ্রীজ ট্রীজ সব নষ্ট হোক।
ভাবনা ছেড়ে কাজেমকে জিজ্ঞেস করে, কাল অসুখ ছিল জুম্মায় যাইতা পারছি না। শুনলাম মসজিদ নাকি আরো বড় করা হইবে?
-হ্যা, আর এটা দরকারই। শুক্রবারে জায়গা হয় না। গ্রামের স্বপ্নমাঝি দিতে পারে ২ লাখ, আর তিনি একটা প্রস্তাব রাখছেন সবাই মিলে এমপিকে ধরার, ধরলে কিছু পাওয়া যাইবো।
-ভাল, দেখা যাক পুরাতন ঐতিহ্যবাহী মসজদিটির ভালভাবে সংস্করণ হয় কিনা। আজ বিকালে ফাইনাল খেলা রে, পূর্ব পাড়া ব্রাজিল, আর তোদের পশ্চিম পাড়া জার্মানি। শালা তুই তো আর্জেন্টা। খেলা হবে, যাইস মাঠে।
-খেলা হবে, যাই রে।
কাজেম তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি চলে আসে, জামালের মা ফ্রীজে গোশত রাখতে গিয়ে হাতে প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছে। কাজেমের সামনে দিয়ে ডাক্তার গেলে টিঠিট করে।
এদিকে সুমন কাজেমদের বাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিল। তার মা তাকে পাঠিয়ে দিয়েছে অল্প গোশত দিয়ে। পরক্ষণে কাজেমের হাতে পল্ট্রি মোরগ নিয়ে বাড়িতে উপস্থিত। সুমন কী বলবে বুঝতে পারলো না। বিষণ্ন হয়ে বলে, কাজেম! মা ডাকছে তোকে, আয়, এ্যাই আয় না রে! কাজেম তার মায়ের হাতে মোরগ দিয়ে সুমনের সাথে পুরান বাড়ির সরু রাস্তায় মিলিয়ে যায়।
তারা দুজন হাটছে, কথা নাই। সুমনের মনের আকাশে ভাবনার মেঘ জমেছে। আনমনে ভাবতে লাগলো, আচ্ছা ঈদে গ্রামে অনেক ঢোল পিটানি, অমুক বিদেশি আটান্নব্বই দিয়া একটা আনছে যেন ভাঙা ঘর, তমুক মেম্বারে আনছে লাখ টাকা দিয়া আনছে। এই উজানপুরে গ্রামে অমুক তমুক শামুক বেটারা যে এত কুরবানি দিলো, এতসব মণের মণ গোশত গেল কই? সবই কি ফ্রীজে গেলো?
সুমনের ভাবতে ভাবতে মাথায় ঝিম ধরে গেল। সুমনকে কাজেম ধাক্কা দিয়ে ভাবনার সাগর থেকে তুলে আনলো।
চল, খেয়ে মাঠে যেতে হবে। গরম খেলা হবে রে। জার্মানি -ব্রাজিল।
ছেলে বুড়োরা দলবেধে যাচ্ছে খেলা দেখতে। আশা করি খেলায় কোনো গন্ডগোল হবে না, খেলায় সভাপতি স্বপ্নমাঝি। উনি থাকবেন আর ঝামেলা হবে, এটা হতে পারে না।
নায়েব আলী বুড়ো দাঁতের ফাঁকের গোশত খোচাতে খোচাতে একটা আকিজ বিড়ি ধরায়। খেলার মাঠের হৈচৈ ভেসে আসে সুমনদের বাড়িতে।
তারা দুজন পেট ভরে খেল, সকালের সেই সূর্যটা কাজেমকে দেখে উঠানে আনাগোনা করছে, কাজেম অবশ্য ফলো করছিলো। কাজেম সুমনের পড়ার টেবিলে বইয়ের ভেতর একখানা চিঠি রেখে বললো, রাতে পড়বি, চল খেলা দেখতে যাই এখন!
খেলার মাঠে গোল শব্দটা উচ্চারিত হলো, কোনদিকে গোল হলো তা ভাবতে পারছে না তারা দুজনেই।
রাত প্রায় ১০টায় সুমন কাজেমের চিঠি হাতে নিয়ে বসলো, চিঠি পড়ছে আবছা আলোতে-
প্রিয় সুমন,
আমি গতরাতে একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছি,
স্বপ্নটা এরকম:
উজানপুর গ্রামে প্রায় ৪০টা গরু কুরবানি হয়েছিল, মসজিদ কমিটি গ্রামের মুরুব্বী এবং এদের মধ্যে অন্যতম স্বপ্নমাঝি মিলে অন্যরকম একটা উদ্যোগ নেয়, গ্রামে যারা কুরবানি দিবে তাদের তালিকা, আর যারা কুরবানি দিবে না তাদের তালিকা করা হয়েছিল। পরে কুরবানির ৩ ভাগের একভাগ নিজের জন্য, আর এক ভাগ ফকির মিসকিনদের জন্য রেখে এক ভাগ মসজিদে পাঠানো হলো। ৪০ জনের দেয়া গোশত একত্র করে স্বপ্নমাঝির উদ্যোগে যারা কুরবানি দেয়নি তাদেরকে বিলিয়ে দিতে হবে, কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হলো গ্রামের সর্বত্র সঠিক মাপে গোশত বিতরণ করতে। একটি পরিবারও বাদ যায়নি। সমানভাবে গোশত পেল তারা
অনেক হুজুর মন্তব্য করেছিল যে যারা সুদের টাকায় কুরবানি দিচ্ছে তাদের গোশত মিশানো হবে না, পরে স্বপ্নমাঝি এর সাময়িক সমাধান দিয়ে কাজটি সম্পাদন করলেন।
সুমন কাজেমের চিঠিতে স্বপ্নের আইডিয়া পড়ে অবাক হলো, সেই সাথে কষ্টও পেল। কিন্তু সুমন ভাবছে, গ্রামে গোষ্টিভিত্তি গোশত বিতরণ হচ্ছে, এতে তো কোনো ঝামেলা হচ্ছে না, কিন্তু অনেকে গোশত পাচ্ছে না তেমন বেশি। এরকম হওয়া কি সম্ভব! এসব ভাবতে ভাবতে সুমন ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলো।
এই গল্পটি আমাদের এলাকায় গোষ্ঠীভিত্তিক সম্প্রদায়ের এক প্রথা সম্পর্কে রচনা। এ অবস্থা থেকে এই সম্প্রদায় বেড়িয়ে আসবে কিনা জানি না।