ছেলের বয়স ১৮ কি ১৯ হবে । বাবা মারা গেছেন, মা কলেজের টিচার। বাসায় এক কাজের লোক ছাড়া অন্য কেউ নেই । মা সকালে চলে যান, আসেন বিকেলে । তারপর তাঁর বিশ্রাম, খাওয়া-দাওয়া । কলেজের খাতা দেখা সবকিছু নিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ত । ছেলের দিকে নজর দেবার সময় খুব কম । কলেজে যাচ্ছে ছেলে, টিচারের কাছে পড়াশোনা করছে, এতটুকুই দায়িত্ব পালন করছে সে । কিন্তু ছেলে কতটুকু মানসিকভবে নিঃসঙ্গ সেটুকু ভেবে দেখবার সময় পায়নি মা । বাবার জন্য মন খারাপ করে থাকে সে সবসময় । এক সময় বিষন্নতায় গিটার শেখাঁর চেষ্টা করে ছেলে । পড়াশোনার মাঝে গিটার নিয়ে ব্যস্ত থাকে । তবুও মন খারাপ কিছুতেই যায় না । দেখতে সে খুবই সুন্দর । কলেজে একটা মেয়ে তাকে ফোন করে বলে তোমার সাথে মাঝে মাঝে গল্প করবো । কিন্তু ছেলেটা ফোন রেখে দেয় । এতে মেয়েটা অপমানিত হয় । মেয়েটিও ওকে একদিন অপমান করার জন্য সুযোগ খুঁজে ।
অন্য একদিন ছেলেটা কলেজে গেছে । ওই মেয়েটা তাঁর কয়েক বান্ধবী নিয়ে বসেছিল । আগেই ঠিক করাছিল ছেলেটা যখন যাবে তখন সবাই জোরে হাসবে । তাই করলো । এতে ছেলেটা ভীষণ অপমানিত হলো । এমনটি প্রায়ই করতো ওরা । মাকে সে একদিন ঘটনার কিছু বলে বললো, এ কলেজে সে আর পড়বে না । মা শত ব্যস্ততার মধ্যে ভালোভাবে কিছু নাশুনেই বললো, এটা ভালো কলেজ, এখানেই তোমাকে পড়তে হবে । যে যাই দুষ্টুমি করুক তুমি এখানেই পড়বে । ছেলেটার মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল । কলেজ টাইম কলেজ না করে অন্যান্য বন্ধুদের সাথে মিশতে শুরু করলো এবং গিটার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো । পাড়ার দু’একজনকে সে গিটার শেখাতে শুরু করলো এক সময় । সে এভাবে অনেক টাকাও উপার্জন করতে শুরু করলো । আস্তে আস্তে আরও অনেক ছেলের সাথে পরিচয় হলো । পড়াশোনা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল । মা বুঝতেই পারেননি ছেলে কলেজে যাচ্ছে না । ছেলে বিভিন্ন আড্ডায় পড়ে গেল । তারপর দুষ্টুমি করে গাজা খাওয়া, ড্রাগস নেওয়া শুরু হলো । ধীরে ধীরে হয়ে গেল মাদকাসক্ত ।
মা বুঝতে পেরে খুব বকাবকি করলো একদিন । কিন্তু মা যখনই কাজে যান, পরিচিত লোকজন ওকে ড্রাগস এনে দেয় । সে ড্রাগস নেয় । মাঝে মাঝে গিটার বাজায় । কিন্তু এক সময় এমন হলো, ব্যপারটা অনেকের কাছে জানাজানি হয়ে গেল । তখন ছাত্রছাত্রী আসা বন্ধ হয়ে গেল । মা সব বুঝতে পেরে ওকে ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দিলেন । ছেলে কথা দিল । আর কোনদিন ড্রাগস নিবে না । কিছুটা ভালো হলো সে । কিন্তু মাকে দেওয়া কথা রাখতে পারলো না । আবার নেশা শুরু করলো । মা কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছে না । একদিন অনেক বকাবকি করলো, বিভিন্নভাবে বোঝালো । লজ্জায় কাউকে বলতেও পারে না মা । এরই মধ্যে ছেলের শারীরিক অবস্থা মারাত্নক অবনতি ঘটছে । এর তিনদিন পর মা কলেজ থেকে এসে দেখে তাঁর বাসায় অনেক ভিড় । মা খুব ভয় পেয়ে গেলেন । তাড়াতাড়ি ঘরে এসে দেখেন ছেলের পাশে সবাই দাঁড়ানো এবং চাদর দিয়ে তাঁর ছেলে ঢাকা । মা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন । কাছেই দাঁড়ানো কলেজের সেই মেয়েটি । সকালেই ও খবর পেয়েছিল এই করুণ মৃত্যুর । কেন যেন না এসে থাকতে পারেনি । মনে মনে অনুশোচনায় সে কাঁদতে লগলো ।
আজ হয়তো তাঁর জন্যই ছেলেটার এ অবস্থা হয়েছে । সে যদি বান্ধবীদের নিয়ে এভাবে ওকে প্রতিদিন অপমান করার প্লান না করতো তাহলে হয়তো তাঁর পড়াশোনার কোন ক্ষতি হতো না । সে রীতিমতো কলেজে যেত । এভাবে ড্রাগের সাথেও জড়িত হতো না । তাই নিজের কর্মে নিজে এবং তাঁর তিনজন বান্ধবী অনুশোচনায় জ্বলতে লাগলো ।
ছেলেটার মাকে দেখে ওদের মন আরও খারাপ হয়ে গেল । অসহায় বিধবা মা । কার কাছে কিভাবে বলবেন, হয়তো এটাই ভাবতেন, লজ্জাও পেতেন সমাজের কাছে বলতে যে, ছেলে তাঁর কথা শুনছে না । জ্ঞান ফেরার পর মা চিৎকার করে কাদছে । আমার ছেলেকে কে ফিরিয়ে দেবে ?
আমি কাকে বলবো ? আমার মত মায়েরা কাকে গিয়ে নালিশ জানবে । কতো মায়েদেরই চাকরি করে সংসার চালাতে হয় । ব্যস্ত থাকতে হয় । কোথায় সে বলবে তাঁর ছেলের ভূল পথে যাবার কথা । কে তাদের এ ব্যাপারে সাহায্য করবে ? আমি একজন হতভাগিনি মা । লক্ষ লক্ষ মায়ের পক্ষ থেকে বলছি, আজ ঘর ভর্তি মায়ের কথা বলছি । আমাদের দেশে “মায়ের অভিযোগ” নামে একটি দিবস হোক’ যে দিবসে মা তাঁর সন্তানের কথা বলবে যা সে সমাজে বলতে পারছে না লজ্জায় । ভয়ে ধরিয়ে দিতে পারছে না তাদের, যারা তাদের ছেলের ক্ষতি করছে ।
টিনএজদের বলছি – বাবা-মা বাইরে চাকুরী বা ব্যবসা করেন, যার সুফল সন্তানই ভোগ করে । ব্যস্ত বাবা মা তোমাদের প্রতি কিছুটা সতর্কহীনতার কারণে খারাপ প্রভাবে নিজেরা প্রভাবিত হওয়া ঠিক না । নিজেদের সুন্দর গতিপথকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করো না । এবয়সেই তোমাদের নিজ ব্যক্তিত্ব গঠন করা উচিৎ । বুঝা উচিৎ ভালো ও মন্দ কী ?