চুল পড়া বন্ধ করার পাঁচটি সহজ ঘরোয়া উপায়:
বর্তমানে চুল পড়ার সমস্যা নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যেই দৃশ্যমান। মূলতঃ প্রাকৃতিক পরিবর্তন, আবহাওয়া ও আধুনিকতা এসবের জন্যে দায়ী। তবে চুল পড়ার কিছু কিছু প্রাকৃতিক কারণ থাকলেও শারীরিক কিছু সমস্যাও এর কারণ হতে পারে। যেমন হরমোনাল ইমব্যালেন্স, থাইরয়েড, শরীরে পুষ্টির অভাব কিংবা মাথায় রক্ত চলাচল সঠিক ভাবে না হওয়া। চুল পড়াটা একসময় খুব বড় আকার ধারণ করতে পারে। এক্ষেত্রে কখনো মাথায় টাক পড়ে যাওয়ার মতন সমস্যাও দেখা যায়। অত্যধিক চুল পড়ার ফলে পুরুষদের অধিক ক্ষেত্রে মাথার তালুর চুল কমতে দেখা যায়, মহিলাদের ক্ষেত্রে চুলের দৈর্ঘ্য পাতলা হয়ে যায় কিংবা সিঁথি ফাঁকা হয়ে যায়। তবে চুল পড়ার সমস্যা কেবল যে বড়দেরই হয় তা নয়, শিশুদের ক্ষেত্রেও এটি লক্ষ্য করা যায়। প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ টি চুল পড়লে সেটি স্বাভাবিক। কিন্তু এটির পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে সেটিকে চুল পড়ার সমস্যা হিসেবে ধরা হয়। মূলত বালিশের কভারে কিংবা স্নানের তোয়ালেতে যদি চুলের আধিক্য লক্ষ্য করা যায় তবে সে ক্ষেত্রে চুলের পরিচর্যার দিকে নজর দিতে হবে এবং এই পরিমাণ যদি অত্যধিক বৃদ্ধি পায় সে ক্ষেত্রে ডাক্তার দেখাতে হবে। কারণ, কেবলমাত্র বাহ্যিক কারণেই চুলের ক্ষতি হয় না, এর জন্য অন্তর্নিহিত কিছু কারণও থাকতে পারে। এক নজরে জেনে নিন চুল পড়ার কারণ গুলি এবং মিলিয়ে নিন কোন সমস্যাটি আপনার রয়েছে।
চুল পড়ার কারণ:
অত্যধিক চুল পড়ার পিছনে বেশ কিছু কারণ লক্ষণীয়। জেনে নিন চুল পড়ার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ :
১) চুল পড়ার অন্যতম কারণ হল বংশগত। যদি কোন পুরুষ কিংবা মহিলার একটি নির্দিষ্ট বয়সের পরেই চুল পড়ার সমস্যা লক্ষ্য করা যায় এবং তাদের বংশে সেই বিষয়টি ক্রমান্বয়ে দেখা যায়, তবে সেটিকে বংশগত রোগ হিসেবে ধরা হয়।
২) অনেক সময় সন্তান জন্ম দেওয়ার পরে মহিলাদের চুল পড়ার সমস্যা দেখা যায়। এক্ষেত্রে শরীরে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে এরূপ সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। এই সমস্যা অত্যধিক বৃদ্ধি পেলে প্রয়োজনে ডাক্তারের সাহায্য নিতে হয়।
৩) চুল পড়ার সমস্যার ক্ষেত্রে কিছু কিছু শারীরিক সমস্যা ও কারণ হয়ে থাকে। যেমন কোনরকম অসুস্থতা কিংবা অপারেশনের পরে চুল পড়ার সমস্যা বাড়ে। এক্ষেত্রে চুল যে পরিমাণ ঝরে যায় তার সাথে পাল্লা দিয়ে চুলের বৃদ্ধি ঘটে না। তবে শরীর সুস্থ হয়ে উঠলে এই সমস্যাটির সমাধান হতে পারে।
৪) শরীরে হঠাৎ হরমোনের পরিবর্তনের কারণে চুল ওঠার সমস্যা দেখা দিতে পারে। মূলতঃ গর্ভাবস্থা, প্রসব বা মাসিক বন্ধ হওয়ার পর কিংবা অত্যধিক জন্মনিয়ন্ত্রণ বরি খেলে চুল ওঠার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৫) থাইরয়েড, অ্যালোপিয়া কিংবা মাথার তালুতে দাদ এর মতন রোগ দেখা দিলে সে ক্ষেত্রে চুল ঝরার সমস্যা বৃদ্ধি পেতে পারে। মূলতঃ মাথার ত্বক সংক্রমিত হলেই এই সমস্যা লক্ষ্য করা যায়।
৬) ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, বাত, হৃদপিন্ডের সমস্যা কিংবা মানসিক চাপের কারণে কোন ওষুধ দীর্ঘদিন খেলেও চুল পড়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৭) অত্যধিক চিন্তা কিংবা হঠাৎ কোন মানসিক আঘাত পেলে কিংবা ওজন বৃদ্ধির মত সমস্যাগুলি দেখা দিলে চুল পড়ার সমস্যা বেড়ে যায়। তবে, এগুলির ক্ষেত্রে কেবল যে মাথার চুল ঝরার সমস্যা বেড়ে যায় তা নয়, শরীরের সর্বত্রই যেমন ভ্রু, চোখের পাতা, শরীরের লোম সব জায়গাতেই চুল পাতলা হতে থাকে। এর প্রধান কারণ হল হেয়ার ফলিকলের ওপর এক ধরনের অপুষ্টির অভাব যার ফলে চুল ধীরে ধীরে পাতলা হতে থাকে।
চুল পড়ার লক্ষণ:
চুল পড়ার সমস্যা অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেলে বেশ কয়েকটি উপসর্গ আমাদের চোখে পড়ে। তাই এটিকে কেবলমাত্র সাধারণ সমস্যা না বলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে তুলে ধরা উচিত। এক নজরে জেনে নিন এই উপসর্গগুলি আপনার দেখা দিয়েছে কিনা :
১) মাথার সামনের দিকে এবং তালুতে চুলের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। মাথার পিছনের অংশের থেকে চুল আঁচড়ানোর সময় এই অংশের তালু চিরুনি দ্বারা অধিক আঘাত পাচ্ছে।
২) মাথার মাঝখানে কালো কালো দাগ কিংবা দাদের মত মাথার ত্বকে কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
৩) চুল পড়ার পরিমাণ আগের তুলনায় আরো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
৪) মাথার চুলের পাশাপাশি ভুরুর চুল কিংবা চোখের পাতা সর্বত্রই অধিক চুল পড়ার সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
৫) মাথার ত্বকে অধিক শুষ্কতা এবং খুশকির সমস্যা বেড়ে গিয়েছে।
এই সমস্যা গুলি যদি অধিক মাত্রায় লক্ষ্য করা যায় সে ক্ষেত্রে চুলের যত্ন অতি মাত্রায় প্রয়োজন। তবে এক্ষেত্রে কেবলমাত্র ঘরোয়া উপায় অবলম্বন না করে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করতে হবে। কেননা চুল পড়ার কারণ অনেক রকমের হয়, তাই চুল পড়া বন্ধ করতে সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।
চুল পড়া বন্ধ করতে পাঁচটি ঘরোয়া উপায়:
চুল পড়া যেমন একটি গুরুতর সমস্যা তেমনই এই সমস্যার সমাধান আমাদের হাতের কাছেই রয়েছে। বিষয়টিকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে ভাবি না বলেই চুল পড়ার সমস্যা আমাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে ওঠে। আসুন জেনে নিন কিভাবে আপনার রান্না ঘরে থাকা সামগ্রী দিয়েই হারিয়ে যাওয়া চুল আবার ফিরিয়ে আনতে পারবেন? অর্থাৎ সহজেই চুল পড়া বন্ধ করতে পারবেন।
১) নারকেলের দুধ দিয়েই করুন চুলের যত্ন:
চুল পরিচর্যার জন্য অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল নারকেলের দুধ। এটি চুলের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য অন্যতম উপাদান। এর মধ্যে কোন রাসায়নিক উপাদান না থাকার কারণে এটি চুলকে তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি দিয়ে থাকে।
২) ডিমের মাস্ক দিয়ে চুলের যত্ন করুন :
চুলের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটাতে অন্যতম একটি উপাদান হল ডিম। এটি চুলের রুক্ষতা দূর করে চুলকে মসৃণ করে তোলে। ডিমের সাদা অংশটি তৈলাক্ত চুলের জন্যে উপযোগী এবং ডিমের কুসুম অর্থাৎ হলুদ অংশটি শুষ্ক চুলের জন্য উপযোগী। ডিমের মধ্যে চুলের প্রয়োজনীয় প্রোটিন যেমন বায়োটিন, ভিটামিন এ এবং ভিটামিন ডি উপস্থিত থাকায় চুলকে সুস্থ করে তুলতে সহায়তা করে। এছাড়াও চুল স্বাস্থ্যকর এবং চকচকে করে তোলে। চুলকে সঠিক ভাবে পরিচর্যায় ডিমের ব্যবহার অপরিহার্য। ডিম চুলের খাদ্য হিসেবে পরিচিত। চুলের সমস্ত রকম পুষ্টির ঘাটতি ডিম পূরণ করে থাকে। যে কারণে চুল কে শক্তিশালী করে তোলার জন্য চুলে ডিমের মাস্ক ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩) চুলের যত্নে পেঁয়াজের রস :
চুলের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটাতে অন্যতম উপাদান হল পেঁয়াজের রস। পেঁয়াজের রসের মত অন্য কোন উপাদান এত দ্রুত চুল পরিচর্যায় সহায়তা করতে পারে না। পেঁয়াজের রসে থাকা উপাদান চুলকে আরো ঘন করে তোলে। এছাড়াও এরমধ্যে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপাদান থাকায় এটি চুলকে আরো পুষ্টি যোগায়। পেঁয়াজে উপস্থিত সালফার চুলের ভাঙ্গন রোধ করে। এছাড়াও চুলের সংক্রমণ রোধ করে চুলকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। পেঁয়াজের রসের মধ্যে উপস্থিত শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমূহ চুলের অকালপক্কতা রোধ করে। এটির নিয়মিত ব্যবহারে নতুন চুল খুব শীঘ্রই লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও গবেষণায় লক্ষ্য করা গেছে পেঁয়াজের রসের মধ্যে ক্যান্সার প্রতিরোধক ক্ষমতা রয়েছে। এছাড়াও এটি চুলের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে এবং খুশকি পরিষ্কার করে মাথার স্ক্যাল্পে রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে তোলে।
৪) চুল পড়া কমাতে জবা ফুল :
চুল পড়া রোধের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল জবাফুল। এটি চুলের দ্রুত বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। জবা গাছের পাতা এবং ফুল দুটিই চুলের পুষ্টি জোগানোর মুখ্য উপাদান। জবাকে মূলতঃ চুলের যত্নের ফুল হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়। এটি চুলের সমস্যা, খুশকি, শুষ্কতা, ধুলোবালি থেকে চুলকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখে। এছাড়াও চুলকে ঘন এবং শক্তিশালী করে তুলতে জবা ফুল বেশ উপযোগী। চুলের বৃদ্ধির জন্য জবা গাছের ফুল এবং পাতা তেল, কন্ডিশনার, শ্যাম্পু বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেহেতু এটি একটি প্রাকৃতিক উপাদান তাই যেকোন ভাবে এটি চুলে ব্যবহার করা নিরাপদ। চুল বৃদ্ধির জন্য এটিতে উপযুক্ত পরিমাণে সমস্ত উপাদান গুলি রয়েছে। এটি খুব কম সময়ে চুলকে দ্রুত বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। এর মধ্যে ভিটামিন সি এবং অ্যামিনো এসিডের প্রচুর পরিমাণে উপস্থিতির কারণেই এটি চুলের যেকোন ধরনের ক্ষতির সাথে খুব দ্রুত লড়াই করতে পারে। জবা ফুল চুলকে মসৃণ এবং শক্তিশালী করে তুলতে সহায়তা করে এবং চুলের ভাঙ্গন রোধ করে।
৫) চুল পড়া রোধে মেথির ব্যবহার :
চুল পড়া রোধ করে চুলের বৃদ্ধির জন্য মেথি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি সহজেই পাওয়া যায়। কমবেশি সকলের রান্নাঘরেই এই উপাদানটি উপস্থিত থাকে। এটি চুলের দ্রুত বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। খুব শীঘ্র নতুন চুল গজাতে চাইলে কিংবা চুলের বৃদ্ধি করাতে চাইলে মেথি একটি উপযোগী উপাদান। এটি ব্যবহারের ফলে মাথার ত্বকে চুলের দ্রুত বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। চুলের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন মেথিতে উপস্থিত থাকে যা মাথার ত্বকের রক্ত চলাচলকে ত্বরান্বিত করে। এছাড়াও মেথিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি এবং আয়রন ও পটাশিয়াম। যা চুলের বৃদ্ধি ঘটায় ও অকালপক্কতা রোধ করতে সাহায্য করে এবং চুলকে মসৃণ এবং ঘন করে তোলে।