বন্ধুরা এটা তখনকার কথা, যখন এদেশে ব্রিটিশরা শাসন করতেছিল। সেসময় এদেশে রাজগাঁও নামে একটা অঞ্চল ছিল। এই অঞ্চল ছিল সবুজে ঘেরা খুবই সুন্দর। এখানে তখনও ব্রিটিশরা শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি বা তাদের কোন দোসরও এখানে শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি।
এখানকার মানুষ সবাই সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতো। হিন্দু, মুসমান সবাই ভাই ভাইয়ের ছিল। কারো কোনো বিপদ হলে সবাই একসাথে তা মোকাবেলা করতো। কেউ কারো সাথে প্রতারণা, কিংবা ঠকানো বা চিটারি করে নি। সবাই এমনভাবে থাকতো যেন, সবাই মিলে একই পরিবারে বিচরণ করতেছে। কারণ, তাদের মধ্যে একজোটে থাকার একটা বন্ধন ছিল।
আর এই বন্ধনের জোরেই কোনো বিদেশি শক্তি তাদের অঞ্চলের দখল নিতে পারে নি। ব্রিটিশের এদেশীয় দোসরেরা কয়েকবার চেষ্টা করেও এই অঞ্চলের দখল নিতে পারে নি। এমনই এক দোসর হলো পাশের অঞ্চলের জমিদার সিন্ধার। এই জমিদার কলকাতা থেকে দারুণ সব কায়দা-কানুন শিখে এসেছে। সেখানে সে ব্রিটিশদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছে – কি করে ভাগ করতে হয়, তারপরে শাসন করতে হয়।
তাই সে জমিদার আশেপাশের সকল অঞ্চলের দখল নিতে পেরেছে। কিন্তু এই রাজগাঁও অঞ্চলের দখল এখনো নিতে পারে নি। বার বার চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হয়। কারণ, এই অঞ্চলের লোকজন সবাই একজোট। সে যেহেতু বারবার ব্যর্থ হয়েছে, তাই এবার সে নতুন একটা ফন্দি আঁটে। সেই ফন্দি অনুযায়ী সে কাজে নেমে পড়ে।
সে তার বাহিনীকে বলে এক টুকরা গরুর গোস্ত ওই রাজগাঁও এর মন্দিরে দিয়ে আসতে। আর এক টুকরো শুকরের মাংস মসজিদের ভিতরে দিয়ে আসতে। এসব কাজ সে চুপি চুপি করতে বলে। কেউ যেন টের না পায়, এমনভাবে কাজ করতে।
তার দলবল রাতের বেলা চুপিসারে এক টুকরা গরুর মাংস মন্দিরের দেবীর সামনের পুজার আসনে রেখে দেয়। আর চুপি চুপি কেটে পড়ে। এবার তারা এক টুকরো শুকরের মাংস মসজিদে নিয়ে যায়। কিন্তু, মসজিদে কিছু লোক থাকায়, তারা চিন্তায় পড়ে যায়।
একজনের মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। সে নফল নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে প্রবেশ করে। সে নামাজের বাহানায় একেবারে মসজিদের ইমামের জায়গার পিছনে, যেখানে মুয়াজ্জিন নামাজ পড়ে সেখানে চলে যায়। আর নামাজের অভিনয় করতে থাকে। কারণ, সে তো হিন্দু। নামাজে কি করতে হয়, তা সে প্রায় দেখেছে। কিন্তু কি সূরা, কি তাসবিহ পড়তে হয় তা সে জানে না।
আর তাই সে নামাজ পড়ার মতো অভিনয় করতে থাকে। সিজদায় যাওয়ার সময় হঠাৎ সে মাংসের টুকরোটা ইমামের জায়নামাজের সামনে ফেলে দেয়। আর নামাজ শেষ করার বাহানায় বাইরে চলে আসে।
ফজরের সময় মসজিদের মুসল্লিদের মধ্যে তীব্র আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে সকালে পূজায় আসা সকল হিন্দুদের মদ্ধেও তীব্র আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে এই আন্দোলন দাঙ্গাতে রূপান্তরিত হয়। হিন্দু, মুসলিমের দাঙ্গা।
এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জমিদার সিন্ধার হিন্দুদের পুরহিতকে উসকিয়ে দিয়ে আগুনে আরও ঘি ঢেলে দেয়। জমিদার হিন্দুদেরকে বলে, “তোমরা যদি আমাকে তোমাদের প্রতিনিধিত্ব করতে দাও, তবে ওই মুসলমানের বাচ্চাদের টুটি ছিঁড়ে ফেলে দেব। আমার হিন্দু ভাইদের তারা অসম্মান করে! আমার ধর্মকে তারা অপমান করে!”
এদিকে মুসলমানদের কাছে এসে বলে, “ছি ছি! আমার ধর্মের লোকেরা এটা করতে পারলো? আমি তাদের ধর্মীয় ভাই মানি না! তাদের আমি কাল্লা কেটে ফেলব। তোমরা যদি আমাকে তোমাদের প্রতিনিধি কর, তবে আমি তোমাদের সুবিচার পাইয়ে দিব। আর ওই বদমাইশ হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ফেলব!”
এভাবে কখনো এদের তো কখনো ওদেরকে এসব কথা বলতেই লাগলো। এক পর্যায়ে রাজগাঁও অঞ্চলের সবাই জমিদার সিন্ধারকে তাদের অঞ্চলের প্রতিনিধি করে দিলো। প্রতিনিধি হওয়ার পর সে মুসলমানদের ইমাম সাহেবকে এই জঘন্য কাজ করার জন্য শাস্তি হিসেবে হিন্দুদের সামনে চুপি চুপি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে হিন্দুদের প্রিয়পাত্র হলো। আর পুরোহিতকে চুপি চুপি মুসলমানদের সামনে মেরে ফেলে মুসলমানদের কাছে প্রিয়পাত্র হলো। মুসলমানরা জানলো ইমাম সাহেব নিরুদ্দেশ। আর হিন্দুরা জানলো পুরহিত নিরুদ্দেশ।
তবে অনেক পরে, ওই অঞ্চলের সব লোক বুঝতে পেরেছিল, আসল ব্যাপার কি! কিন্তু ততক্ষনে তা অনেক দেড়ি হয়ে গেছে।
তাদের মধ্যকার বন্ধন ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে, তারা জমিদারের দাসত্ব করেছিল অনেক কাল ধরে!