আমাদের বাড়ির পেছনে ছোট একটা খাল আছে। খালের পাড়ে কতগুলো কুল গাছ আছে। কুলের লোভে হোক আর একটু নিরিবিলি খোলা হাওয়ার লোভে হোক আমার শৈশবের খেলাধূলা আর কৈশোরকালের অনেক সময়ের স্বাক্ষী এই খাল। খালের পাশে আছে আবাদি জমি। বাড়ির আসে পাশে কাকা,কাকি সম্মোধীয় প্রতিবেশিরা এখানে চাষবাস করে। স্কুলের পর সময় পেলেই ঐ খালের ধারে চলে যেতাম যখন কিশোর ছিলাম। যতটা সময় বাড়িতে কেটেছে আমার অনেক বিকালের সঙ্গী এ খাল। এদিকে মানুষের আনোগোনা টা ও কম। নিশ্চিন্তে ভাবনায় ডুবে থাকা যায়। যাক সেদিন ও একই রকম ভাবনায় ডুবে থাকার মত একটা দিন ছিল।যদিও তখন কিশোর বয়স থেকে বয়সটা এগিয়ে ই ছিল। সে দিনটা ছিল ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ও কখন ভাবনায় ডুবে গেলাম টেরই পেলাম না। হঠাৎ এক মহিলার কন্ঠ শুনে ভাবনায় ছেদ পড়লো । আমাদের প্রতিবেশি তিনি খুব বিরক্ত হয়ে আমাকে বললেন ঢাকায় যেতে গিয়ে তিনি অর্ধেক পথ থেকে ফিরে এলেন। সারাদিন বাসে ছিলেন। পরে যেতে না পেরে ফিরলেন। তখন প্রায় সন্ধ্যা হবে হবে করছে। সূর্য ডুব দিচ্ছে। আমি বললাম কেন যেতে পারলেন না? কি হয়েছে? মানুষজন কি বলছে কিছু বলতে পারবেন না? তিনি বললেন তাইতো তোমাকে বলছি কি হয়েছে কিছু জানো? আমি বললাম নাতো জানিনা। তারপর উনি বললেন মানুষ খালি বলাবলি করছে অনেক মানুষ নাকি ঢাকা মারা গেছে। তাই বাস গাড়ি আজ যাবেনা। আমি কয়েক ঘন্টা বাসে থেকে শেষে ফিরে আসলাম। আমি বললাম মানুষ মারা গেছে? কি বলেন? উনি বললো হ্যাঁ আর্মিরা নাকি যুদ্ধ লাগছে। আমি কাল বিলম্ব না করে বাড়িতে দৌড়ালাম। এসে দেখি বিদ্যুৎ নাই। সবসময়কার গতানুগতিক চিত্র আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকা। যাক একখানা রেডিও ছিল ঘরে। সেটাই ছাড়লাম। তেমন কিছুই জানতে পারলাম না। আস্তে আস্তে যখন রাত বাড়তে থাকলো তখন একটু আধটু করে জানতে পারলাম পিলখানায় নাকি বিদ্রোহ হয়েছে। তখনো জানতে পারিনি। কারা বিদ্রোহ করেছে আর কারাই বা বিদ্রোহের স্বীকার হয়েছে। যাক পরের দিন দুপুর ২ টা বাজে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য জাতির উদ্দেশ্যে। এদিকে বিকালের দিকে আস্তে আস্তে কোন কোন মন্ত্রী পিলখানায় প্রটোকল টল নিয়ে ঢুকছেন শুনলাম। কোন প্রেস, ক্যামেরা সাংবাদিকের প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না । যাক তারপর ও কেউ কেউ কিছু বাইরের ফুটেজ নিচ্ছেন। দু’ একজন মন্ত্রীর প্রবেশ আর বার হবার চিত্র ধারণ করেছেন। আর এইটুকু দিয়েই সাধারণ মানুষকে শান্তনা দিয়ে রেখেছেন নামি দামি থেকে শুরু করে ছোট খাট টিভি চ্যানেল গুলো ও। আর দুপুর ২ টায় দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রচার করতে থাকলো পুরো টিভি রেডিও থেকে শুরু করে এফ এম রেডিও পর্যন্ত। যাই হোক পুরো জাতির একটাই প্রশ্ন কি হয়েছে পিলখানায়? সে প্রশ্নের উত্তর আজো থেমে আছে। কেউ জানতে পারেনি। শুধু যেটা জেনেছে আর আমি যা জেনেছি । বিদ্রোহের পরের দিনের পর থেকে সেনা সদস্যদের গণ কবর থেকে কটা লাশ তোলা হল, সবজির ক্ষেতে গণকবর,নর্দমায় খালে কত লাশ ভেসে গেছে, যে আঙ্গিনা সেনা সদস্যদের পদচারনায় মুখরিত হত সেখানে জুতা,ট্যাগ পোশাকের পোড়া অংশ দেখে বোঝা যায়নি ঠিক কতজন কে পোড়ানো হয়েছে। এক কথায় বলা যায় চতুর্দিকে শুধু সেনা সদস্যদের লাশ আর লাশ। পত্রিকার পাতাগুলো আস্তে আস্তে গল্পের ঝুলি খুলে ধরলো। কোন কোন সেনা সদস্য কতটা দক্ষ ছিলেন। কতটা ত্যাগ করেছেন। টিভির রিপোর্টার, পত্রিকার পাতা সব ব্যস্ত ছিল সে কদিন একটি খবরে। এই অসহ্য মাত্রাহীন যন্ত্রণাময় খবর যাদের জন্য তৈরি হল তারা কারা? কে সে ষড়যন্ত্রকারী? কে করেছে? কে করিয়েছে?
সেদিনের কৌতূহলের পেছনে এত ভয়ংকর খবর অপেক্ষা করছে জানতে পারলে কখনো বাড়ি ফিরতাম না, ভাবনাগুলো ভাংতাম না। কখনো জানতে চাইতাম না কি হয়েছে?
সময় কত দ্রুত চলে যায়। সেদিনের সে সূর্য এতগুলো তরতাজা প্রাণ নিয়ে ডুবে যাবে সে সূর্য যাকে আমি ডুবে যেতে দেখেছি। কে জানত? কেউ কি জানত না? নাকি জানত? কে জানত? কে সে?