আজ সকাল থেকেই অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। আগের দিনে শীতকালে শুধু শীতই পড়তো, এখন বৃষ্টিও পড়ে। আকাশের মন ভালো নেই বোধ হয়। কিভাবে ভালো করা যায় তার মন? এসব আষাঢ়ে ভাবনা ফাহিমকে বিমোহিত করতে থাকে।
নানুরবাড়ি ফরিদপুরে সে বেড়াতে এসেছে বেশ কয়েকদিন হলো। করোনার কারণে লকডাউন পড়ে যায় বিধায় সেখানে সে আটকা পড়ে যায়। গাড়ি চলাচল শুরু হলেই নিজবাড়ি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে ভেবে রেখেছে।
বৃষ্টি পড়া বন্ধ হলে ফাহিমের ছোটমামা রাসেল মিয়া তার পাশে এসে বসে আর বলে,
– ফাহিম, মন ভালো নেই বোধ হয় তোমার।
– হ্যাঁ মামা। একটু খারাপ লাগছে। আজ প্রায় এক সপ্তাহ হতে চলেছে বাসায় যেতে পারছিনা। কখন লকডাউন উঠিয়ে নিবে তারও কোন ঠিক ঠিকানা নেই।
– হুম, বুঝেছি। আচ্ছা একটা কাজ করা যায়.. করবা?
– হুম মামা বলেন,
– আজ রাতে আমি মোল্লার দোকানে ক্যারম খেলতে যাব। তুমি যাবে? ভালো লাগবে তোমার।
– হ্যাঁ যাওয়া যায় তো। চলেন..
– ঠিক আছে। রাতের খাবার শেষে তাহলে রওনা দিচ্ছি আমরা।
– ঠিক আছে মামা।
রাতের খাবার শেষ করে ক্যারমে বেট ধরার জন্য অল্প কিছু টাকা নিলেন রাসেল মিয়া, সাথে ফাহিমও গেল বাজারে। প্রথম দিকে খুব ভালো খেললেও ধীরে ধীরে বাজিতে হারতে থাকেন রাসেল মিয়া। শেষে ফাহিমের পকেট থেকেও কিছু টাকা নিয়ে বেট ধরে খেলতে থাকেন তিনি। আবারও সেই হার-জিতের খেলা। এই পাল্লায় পড়ে কখন যে রাতের ১২টা বেজে গেলো কারও খেয়াল নেই। শীতকালে রাত ১২টা মানে মধ্যরাত।
হঠাৎ ফাহিমের খেয়াল আসে সময়ের দিকে। মামাকে বলে খেলা বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়, তার মামা রাজি হয়না। বাজির নেশা বড্ড বাজে। এদিকে ঘুমে নেতিয়ে পড়ছিলো সে, তাই একাই ঘরের দিকে রওনা দিলো ফাহিম।
গ্রামের রাস্তায় স্ট্রিটলাইট নেই। টর্চটাই পথচলার একমাত্র সঙ্গী। ফাহিম হাঁটতে থাকে ঘরের দিকে। এমন সময় কে যেন আবছা গলায় ডাক দেয় তার নাম ধরে। – ফাহিম..
ফাহিম বুঝতে পারেনা কার ডাক। এদিক ওদিক চোখ পাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেরে আবারও হাঁটতে থাকে গন্তব্যের দিকে।
একটু পর আবারও ডাক আসে। – ফাহিম..
ফাহিম আবারও দাঁড়ায়। আশে পাশে কাউকে দেখতে পায়না। পাত্তা না দিয়ে সে গন্তব্যের দিকে চলতে থাকে।
– ফাহিম… সামনে যেওনা… সামনে যেওনা…
এবার থমকে দাঁড়ায় ফাহিম। টর্চ দিয়ে ভালো করে চেক করে দেখে; কাউকেই দেখতে পায়না। সেও আওয়াজ দেয়, – কে বলছেন?
– আমাকে তুমি দেখতে পাবেনা। আমি তোমার মতোও না। কিন্তু নিষেধ করছি সামনে যেওনা।
– কে আপনি?
আর কোন জবাব আসেনা। সে আবারও জিজ্ঞেস করে, – কে আপনি?
ওপাশ থেকে কোন জবাব আসেনা।
ফাহিম আবারও চলতে থাকে গন্তব্যে। একটু পর সে বুঝতে পারে, সে আর সামনে আগাতে পারছেনা। পেছন থেকে কেউ একজন তাকে আটকে রাখছে। হতভম্ব হয়ে সে দাঁড়িয়ে যায়। উৎস খুঁজতে থাকে কিভাবে সে আটকে আছে। এমন সময় কয়েকটা বুড়োলোক আচমকা তার সামনে চলে আসে। উচ্চতায় তারা একেকটা বৃক্ষের ন্যায়। তাদের দাঁড়িগুলো সাদা ঘোড়ার লেজের ন্যায় ঘন আর লম্বা। চোখ থেকে যেন জাহান্নামের আগুন বেরিয়ে পড়ছে। মাথায় একটিও চুল নেই। পরনে বোরখার ন্যায় কালো কাপড় আর গুপ্তাঙ্গ ঢাকা ছিলোনা। ভয়ঙ্কর অবয়বে দাঁড়িয়ে অচেনা ভাষায় তারা কিচিরমিচির করতে থাকে। ফাহিমকে ছোঁয়ার জন্য তারা হাত বাড়ায়। কিন্তু পারেনা। ততক্ষণে ফাহিমের বাকশক্তি হারিয়ে যায়। অজ্ঞান হওয়ার আগে সে শুধু কয়েকটা কথা শুনতে পায়,
“তঁর নানার লাঁগানো এঁই বঁটগাছটার জ্বীঁনগুলা হাঁজির ছিঁলো বঁইলা আঁজ বাঁইচা গেঁছিস। তঁকে নিতাঁম আঁইছিঁলাম, আঁইজ আঁমাদের ফিঁরা যাঁইতে হঁইতেছে।”
এই ঘটনার পর ফাহিম বেশ অসুস্থ হয়ে যায়। কয়েকটাদিন কালোজ্বরে ভুগে সে। একমাসের মাথায় এসে মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠে। তখন আবারও তার ছোটমামা রাসেল মিয়া তার পাশে আসে।
– ফাহিম, এখন কেমন লাগছে?
– এই তো মামা ভালো আছি আগের চেয়ে।
– ফাহিম, তুমি হয়তো আজ এই দুনিয়ায় থাকতেনা আর। যে জ্বীনেরা তোমাকে পেয়েছিলো, তারা শয়তান পুজারী ছিলো। পূর্ণিমার রাতে তারা যুবক পুরুষের বলি দিয়ে শয়তানের পুজা করে। তোমার নানা আমাদের বংশ রক্ষার স্বার্থে একটা বটগাছ লাগিয়ে সেখানে কয়েকটা শক্তিশালী জ্বীন পালন করেছিলেন। আজ সে উছিলায় তুমি বেঁচে গেছে।
– মামা, তাহলে এটা জেনেও কেন তুমি আমাকে সেদিন ক্যারম খেলা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলে?
– সেদিন যে পূর্ণিমার রাত ছিলো, আমার জানা ছিলোনা মামা। আমাকে ক্ষমা করে দিও তুমি।
– আচ্ছা মামা সমস্যা নেই। কিন্তু নানা এতকিছু জানতেন কিভাবে?
– তুমি হওয়ার আগেই তোমার নানা ইহলোক ত্যাগ করেন। আর কেউ না জানলেও আমি আর তোমার নানি জানতাম, তোমার নানা ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক। এমনকি তোমার বড়মামাও জানতোনা যে, আমাদের বাবা দরবেশের আড়ালে একজন তন্ত্রসাধক।
মৃত্যুর আগে তোমার নানার নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমরা আজ পর্যন্ত সেই বটগাছটায় কুড়াল লাগাইনি।