নাসিরুদ্দিন হোজ্জা ছিলেন পারস্য ও তুরস্কের একজন জনপ্রিয় রসিক ও দার্শনিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর গাধার গল্পগুলো সারা পৃথিবী জুড়েই অত্যন্ত জনপ্রিয়। তুরস্ক থেকে মধ্যপ্রাচ্য, সমগ্র আরব জাহান, এমনকি সুদূর চীন থেকে শুরু করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান তথা আমাদের এই উপমহাদেশেও তাঁর কৌতুকপূর্ণ হাসির গল্পগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিশেষ করে তাঁর গৃহপালিত গাধা নিয়ে প্রচলিত গল্পগুলো অত্যন্ত মজার, কৌতুকপূর্ণ এবং খুবই হাসির। তাঁর গাধা নিয়ে প্রচলিত কৌতুকপূর্ণ গল্পগুলির মধ্যে থেকে তিনটি খুব মজার এবং হাসির গল্প বলছিঃ
গাধার কথা :
একবার নাসিরুদ্দিন হোজ্জার দূরসম্পর্কের এক আত্মীয় তাঁর কাছে একদিনের জন্য গাধাটি ধার চাইতে এলেন। গাধা নিয়ে তিনি নাকি অনেক দূরের এক এলাকা থেকে ভারী কিছু মালামাল বহন করে আনবেন। একথা শুনে নাসিরুদ্দিন হোজ্জা তৎক্ষণাৎ বলে বসলেন— “গাধা তো বাসায় নেই, সে এক জায়গায় বেড়াতে গেছে।” হোজ্জার এই কথা শুনে ঐ লোক তো হতভম্ব হয়ে গেলো। সাথে সাথে ঐ লোক বললেন— “গাধা আবার কোথায় বেড়াতে যায়?” হোজ্জা দ্রুত বলে উঠলেন— “গাধা তার বাপের বাড়ি বেড়াতে গেছে।” ঠিক তখনই বাড়ির ভেতর থেকে গাধাটি ডেকে উঠলো। গাধার ডাক শুনে হতভম্ব লোকটি তখন আশ্চর্য হয়ে বললেন— “ঐ যে গাধাটা আপনার বাড়ির ভেতর ডাকছে!” তখন নাসিরুদ্দিন হোজ্জা লোকটাকে বিদ্রুপ করে বললেন— “যে মানুষ আমার কথা বিশ্বাস না করে আমার গাধার কথা বিশ্বাস করে, তাকে আমি গাধা ধার দেই না।
গাধার উচিত শিক্ষা :
একসময় নাসিরুদ্দিন হোজ্জা ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। মালামাল নিয়ে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যেতেন। একদিন গাধার পিঠে এক বস্তা লবণ চাপিয়ে তিনি এক বাণিজ্য কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে নদীর ওপর ছিল নড়বড়ে এক কাঠের সাঁকো। সেই কাঠের সাঁকোর দুইপাশে ছিলোনা কোন রেলিং। গাধা সেই কাঠের সাঁকোর ওপর ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ধপাস করে পানিতে পড়ে গেলো। গাধার পিঠে যে এক বস্তা লবণ ছিলো, অর্ধেকেরও বেশি লবণ সেই পানিতে মিশে গলে গেলো। এতে গাধার পিঠের লবণের বোঝা অনেক হালকা হলো। গাধা খুব আরাম করে বাণিজ্য কেন্দ্রে পৌঁছে গেলো।
পরেরবার সেই একই জায়গায় এসে গাধা আবার পানিতে পড়ে গেল। এবার গাধার পিঠে ছিল তুলার বস্তা। তুলা পানিতে ভিজে বেদম ভারী হয়ে গেলো। পানি থেকে উঠে ভেজা তুলার বস্তা টানতে টানতে গাধার জান বের হয়ে গেলো। কিছুদূর গিয়ে গাধা জিহ্বা বের করে জোরে জোরে হাঁফাতে লাগলো। নাসিরুদ্দিন হোজ্জা গাধার কান টেনে ধরে বললেন— “পানিতে পড়ে তোর অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। সব বস্তাকেই লবণের বস্তা মনে করেছিস? আজ তোর উচিত শিক্ষা হয়েছে।”
গাধা চোরাচালান :
একসময় হোজ্জা নাসিরউদ্দিন চোরাচালানের সাথেও জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। তুরস্ক থেকে পারস্য আর পারস্য থেকে তুরস্ক তিনি চোরাচালান করতেন। কিন্তু তিনি কী চোরাচালান করতেন, তা কেউ বলতে পারতো না। তিনি গাধা নিয়ে তুরস্ক থেকে পারস্য যেতেন, আবার পারস্য থেকে তুরস্ক আসতেন। গাধার পিঠে তিনি বসতেন; আর তার পেছনে গাধার পিঠে থাকতো দুই আঁটি খড়, যা গাধার খাদ্য। আর কিছু থাকতো না। তুরস্ক ও পারস্য সীমান্তে তাঁকে ব্যাপকভাবে তল্লাশি করা হতো, কিন্তু কেউ তার কাছে কোনোদিন কোনোকিছু পায়নি। এভাবে নির্বিঘ্নে তিনি দীর্ঘদিন চোরাচালান করে অনেক অর্থবিত্তের মালিক হয়ে গেলেন। ধনী হওয়ার পর একসময় তিনি চোরাচালান ছেড়ে দিলেন।
তারপর একদিন তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে একদিন সীমান্তের এক সাবেক নিরাপত্তা কর্মকর্তার সাথে দেখা। তিনি নাসিরুদ্দিন হোজ্জাকে বললেন, এখন তো আমাকে বলতে আপনার সমস্যা নেই। এখন তো আর আপনি চোরাচালান করেন না, আর আমিও অবসর গ্রহণ করেছি, এখন বলুন তো, আসলে আপনি কী চোরাচালান করতেন? হোজ্জা হেসে বললেন— সেটাই তো হচ্ছে মজা, কেউ কখনো বুঝতে পারেনি যে, আমি আসলে চোরাচালান করতাম—”গাধা!”