দুই ঘন্টা যাবৎ হাঁটছি । সূর্য যেন আমার দিকে তাকিয়ে করা তাপ দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি সূর্যের অনেক বড় ক্ষতি করেছি ।তার মধ্যে খালি পায়ে হাটছি যেন পা আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। আবার পেটের মধ্যে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে ।আজ এই দিনটা আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন যাবে । এর মধ্যে কিছু খারাপ হয়ে গেছে। যে মেসে থাকি সেখানে তিন মাসের ভাড়া বকেয়া হয়ে গেছে। আজ শেষ তারিখ ভাড়া পরিশোধ করার ।ম্যানেজার বলেছে যে আজকের মধ্যে টাকা না দিলে আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীর নাম ভুলিয়ে দেবে। আমি তো এক গোষ্ঠীর নামই জানিনা আর কোথায় চৌদ্দ গোষ্ঠী ।
যাই হোক সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে মেস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। টাকা না নিয়ে মেসে যাওয়া অসম্ভব ।রামধোলাই দিবে ।সকালে বেরিয়ে হাঁটা শুরু করি ।যদি থাকার কোন ব্যবস্থা হয়। হাঁটতে-হাঁটতে গুলিস্তানে এসে পড়ি ।প্রচন্ড ক্ষুধা লাগে। তাই একটা হোটেলে ঢুকি দুইটা পরোটা আর ভাজি অর্ডার দেই। হঠাৎ দেখলাম মানিব্যাগ নাই।মানিব্যাগে ছিলই ২০ টাকা ।মানিব্যাগ না পাওয়ায় আর নাস্তা খাওয়া হল না। হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় হোটেলের লোকেরা আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল যেন খাবার অর্ডার করে আবার না করে দেওয়া যেন মহাপাপ। মনে হচ্ছিল আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। তাড়াতাড়ি হোটেল থেকে বের হলাম ।
মোবাইল বের করে দেখলাম সাড়ে নয়টা বাজে ।আবার হাটা শুরু করলাম। হঠাৎ খালার কথা মনে পড়ল। খালার কাছ থেকে টাকা পাওয়া যেতে পারে। ভাবলাম খালাকে ফোন করে টাকার কথা জিজ্ঞাসা করি। পকেটে হাত দিলাম মোবাইল নিতে ।ওমা মোবাইল গায়েব ।এবার অসহায়ের মতো হাঁটা শুরু করছি আশেপাশের সব মানুষই ব্যস্ত। শুধু আমি ব্যস্তহীন ভাবে হাঁটছি। একটুপর দেখলাম একজন লোক পানের দোকান থেকে পান কিনে টাকা দেওয়ার জন্য মহা খুশিতে মানিব্যাগ বের করলো ।মনে হয় এই প্রথম মানিব্যাগ কিনেছে। আর মানিব্যাগ বের করার সময় নিজেকে দামি কেউ ভাবছে।
যখন মানিব্যাগ বের করল তখন আমি অবাক হয়ে এক দৃষ্টিতে লোকটার মানিব্যাগের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মানিব্যাগটা পুরো আমার মানিব্যাগটার মত। আমি লোকটাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে মানিব্যাগটা কি তার নাকি ।লোকটা বলল যে সে নাকি একটু আগে একজনের কাছ থেকে ৫০ টাকা দিয়ে মানিব্যাগটা কিনেছে। আমাকে জিজ্ঞেস করল ভাই সস্তা ভালো একটা জিনিস পেলাম তাই না। আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম ।আজব জায়গায় এই গুলিস্থান। প্রথমে মানিব্যাগ চুরি তারপর মোবাইল । একটু পর হয়তো আমিও চুরি হয়ে যাব ।কিন্তু তা হলো না কারণ আমার কাছে আরেকটা বস্তু ছিল চুরি হওয়ার মতো ।
আর তা হলো জুতা ।ভেবেছিলাম পানি খেয়ে ক্ষুধাটাকে কিছুক্ষণ দমিয়ে রাখা যাক। এখন তো এক গ্লাস পানির দাম দুই টাকা। তাই বাধ্য হয়ে মসজিদে ঢুকলাম পানি খেতে। পানি খেয়ে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় দেখি জুতা নেই। তারপর দুই ঘন্টা যাবৎ হাঁটছি খালি পায়ে কড়া রোদের মধ্যে।
হাঁটতে হাঁটতে শনিরআখড়া এসে পড়েছি। খালার বাসা শনির আখড়াতেই। ২ বছর আগে খালার বাসায় এসেছিলা।ম বাসাটা ঠিক কোথায় মনে পড়ছে না ।মনে হচ্ছে ওই আকাশী রঙের আটতলা বাড়িটি হতে পারে ।খালা চার তলায় থাকতো ।দারোয়ানের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম খালা এখনও এই বাসায় থাকে ।তবে এখন সে বাসায় নেই সে তার মেয়ে অর্থাৎ নীলার শ্বশুর বাড়িতে গিয়েছে নীলাকে আনতে ।বাসায় আসতে আসতে রাত হবে।
যখনই টাকার প্রয়োজন হতো খালার কাছে আসতাম। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে নীলাই বুঝতে পারত যে আমার টাকার প্রয়োজন। আর তখন ও আমাকে টাকা দিত। গতবার যখন এসেছিলাম তখন নীলার বিয়ে ছিল। বিয়ের উপহার হিসেবে আমি নীলার জন্য ১২০০ টাকা দিয়ে একটি শাড়ি কিনে নিয়ে যাই। শাড়িটি দেখে খালা যেমন আমাকে গাল মন্দ করে তার থেকে আরও বেশি করে নীলা।শাড়িটির রঙ ছিল কালো ।আর কালো রং নীলা পছন্দ করত না।নীলা অবশ্য শাড়ির রঙ কালো তার জন্য আমাকে বকেঁনি তা আমি জানি। আমি ওর জন্য কেন টাকা খরচ করে শাড়ি আনলাম তার জন্য ।আরও একটি কারণ আছে। আর আমার কাছে মনে হয় সেই কারণটাই বড়। তাহলো নীলা আমাকে পছন্দ করতো ।
আমি বুঝেও তা না বুঝার ভান করতাম ।কারন আমার মতো ৬-৭ হাজার টাকা বেতন পাওয়া মানুষের কাছে কাউকে পছন্দ করা আর না করা সমান কথা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পছন্দের জিনিস কে জোর করে অপছন্দ বানানো উপকারী হয়ে উঠে ।যাই হোক সেদিন শাড়ির রঙের কথা বলে আমার উপর যত অভিমান আর রাগ ছিল সব ঝেরে ফেলে নীলা ।সেদিন খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে বাস ভাড়া দেওয়ার সময় লক্ষ্য করি শার্টের পকেটে ১৫০০ টাকা। আমি জানি নীলাই এ কাজ করেছে ।কোন ফাঁকে হয়তো আমার শার্টের পকেটে ১৫০০ টাকা রেখে দেয়। কারণ নীলা জানত শাড়ি কেনার ফলে সামনের মাসে চলতে আমি বড় হিমশিম খাব।
দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম এখন বিকাল চারটা বেজে গেছে। খালা আসতে এখনো অনেক দেরি হবে মনে হয়। এর মধ্যে দারোয়ানের কাছ থেকে ৫ টাকা ধার নিয়ে চা খেলাম। বাড়ির সামনে বসার জায়গাটিতে বসে ভাবছিলাম আজকে মেসের ভাড়া যোগাড় করতে না পারলে এখানেই রাতটা কাটাবো। এত বড় বসার জায়গায় বসে না থেকে শুয়ে পড়ারই ভালো ।তাই ক্লান্ত শরীরে হেলে পড়লাম।
কখন যে রাত হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। এখনো চোখ জুড়ে ঘুম খেলা করছে। অনেক রাত হয়ে গেছে মনে হয় ।গাঢ় অন্ধকার চারদিকে ।খালা আসছে কিনা জানতে গিয়ে দেখি দারোয়ান বাবু গভীর ঘুম দিয়েছে। যদি খালা এই দৃশ্যটি দেখে তবে দারোয়ানের ওপর দিয়ে পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী ঝড় বয়ে যেত। তবে বেচারাকে এখন ঘুম থেকে জাগাতে কোনো ইচ্ছে হচ্ছে না আমার।
আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। এখন মেসে ফিরে গিয়ে কোন লাভ হবে না। বাড়িওয়ালা ঢুকতেও দিবে না। আমি কেবল একা হাঁটছিলাম না আমার সাথে দূরে চাঁদ টাও যাচ্ছিল। হঠাৎ করে কি মনে করে পকেটে হাত গেল। পকেট থেকে হাত বের করে দেখি পাঁচশত টাকার ৯-১০ টা নোট। দূরের চাঁদটি একটা হাসি দিল। মনে হয় চাঁদ টাও আমার মত বুঝতে পেড়েছে টাকাটা আমার পকেটে কে রেখে গেছে।