আবার আসিবো ফিরে(কবিবর জীবনানন্দ দাশের নিকট ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক)

১.
আজকের রাতটা হতে পারতো হাসানের জীবনের সবথেকে আনন্দের রাত। গত আটটা বছর যেই স্বপ্নের পেছনে সে পাগলের মত ছুটেছে, যার জন্যে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিজের ল্যাবরেটরীতে পড়ে থেকে দিন-রাত এক করে গবেষণা চালিয়ে গেছে, সময় দিতে পারে নি তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকেও, তার সেই স্বপ্ন আজ তার হাতের মুঠোয়! অন্য সবার মত একটা সময় তারও মনে হতে শুরু করেছিলো যে একটা অসম্ভব এবং অবাস্তব ভাবনাকে সম্ভব করার বৃথা চেষ্টা করে অহেতুক সময় নষ্ট করে চলেছে সে। এইতো সেদিনও সে তার স্ত্রীকে বলছিলো, “জীবনের এই আটটা বছর কি আমি স্রেফ বেগার খেটে গেলাম? এভাবে নষ্ট করলাম জীবনের আটটা বছর?!”
কিন্তু না! বৃথা যায় নি হাসানের আট বছরের পরিশ্রম, বৃথা যায় নি তার গবেষণা। এত বছরের গবেষণার ফলাফল সে আজ ঘণ্টাখানেক আগেই পেয়েছে। আজ এই পৃথিবীতে তার চাইতে বেশি খুশি দ্বিতীয় আর কারো হওয়ার কথা না। তার এত বড় একটা গবেষণা যে সফল হয়েছে! একজন বিজ্ঞানীর জীবনে এর চেয়ে আনন্দের আর কী-ই বা হতে পারে?
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই পৃথিবীতে আজকের রাতটাতে হাসানের চাইতে দুঃখী হয়ত আর কেউ নেই। কারণ মাত্র কিছুক্ষণ আগেই সে ভয়াবহ রকমের একটা ধাক্কা খেয়েছে!
অন্যান্য দিনের মত আজও হাসান তার ল্যাবে সেই সকাল থেকেই টানা কাজ করে যাচ্ছিলো। কাজ করতে করতেই এক পর্যায়ে বিস্ফারিত চোখে সে দেখে, তার তৈরি করা ডিভাইসটি মৃদু গুঞ্জন তুলে চালু হচ্ছে! ডিভাইসটি কতটুকু কাজে দেবে তা সে জানে না, কিন্তু চালু যে হচ্ছে এ-ই বা কম কী?! এই আনন্দের সংবাদটা সবার আগে নিজের স্ত্রীকে জানাবে বলে স্ত্রীকে বারবার ফোন করছিলো সে। কিন্তু তার স্ত্রী ফোন তুলছিলো না। তাই আর দেরি না করে সে তৎক্ষণাৎ রওনা দিয়ে দিয়েছিলো তার বাড়ির উদ্দেশ্যে।
বাড়িতে পৌঁছে সে দেখে বাড়ির দরজাটা হা করে খোলা। কিছুটা অবাক-ই হলো সে। রাত বাজে পৌনে বারোটা, এত রাতে দরজা খোলা কেন থাকবে? খোলা দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো হাসান। ভেতরে ঢুকতেই সে শুনতে পেলো দু’টো কণ্ঠ- একটা নারীকণ্ঠ আর একটা পুরুষকণ্ঠ। নারী কণ্ঠটা যে তার স্ত্রীর, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু পুরুষ কণ্ঠটা কার? বোঝা যাচ্ছে না। তারা দু’জন কী বিষয়ে কথা বলছে সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। হাসানের মনটা হঠাৎ করেই অস্থির হয়ে উঠলো। দু’জনের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে বেডরুমের দিক থেকে। হাসান পা বাড়ালো বেডরুমের দিকে।
বেডরুমের দরজার কাছে পৌঁছে দরজাটা সামান্য ফাক করে ভেতরে উকি দিলো হাসান। তারপর সে যা দেখলো, তাতে নিজের প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণায় গা রি রি করে উঠলো তার! দরজার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে হাসানের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আছে একটি লোক। দরজার দিকে পিঠ করে থাকায় লোকটির চেহারা দেখতে পাচ্ছে না সে। দেখতে পাচ্ছে না তার স্ত্রীর চেহারাও, কারণ তার স্ত্রী লোকটির বুকে মুখ গুজে কাঁদছে।
সেই দৃশ্য দেখার পর সেখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয় নি হাসানের পক্ষে। সে তৎক্ষণাৎ সরে এসেছিলো সেখান থেকে। এখন এই মুহুর্তে সে দাঁড়িয়ে আছে তার বাড়ির বাইরে, ড্রয়িং রুমের জানালা থেকে খানিকটা দূরে। সেখান থেকে খোলা জানালাটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সে।
“এটা তুমি কী করলে মিলি? কেনই বা করলে? আমার ভালোবাসা কি কম হয়ে যাচ্ছিলো তোমার জন্যে?!” অসহায় ভঙ্গিতে আপনমনে বিড়বিড় করে হাসান বলল, “এটা ঠিক যে তোমাকে সময় দিতে পারতাম না। কিন্তু তাই বলে তুমি এভাবে অন্য একজনের সঙ্গে…… ছিহ!”
মাটিতে একদলা থুতু ফেললো হাসান। নাহ! মিলি এবং তার ঐ প্রেমিককে সে ছেড়ে দেবে না। উচিত শাস্তি দেবে সে তাদের দু’জনকেই! শাস্তির ব্যবস্থা সে করেও এসেছে বাসা থেকে বেরিয়ে আসার আগেই। যদিও মিলির প্রেমিককে শাস্তি দেবার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেও নিজের স্ত্রী মিলিকে শাস্তি দেবার ব্যাপারে সে এখনো দ্বিধাগ্রস্ত। কিন্তু শাস্তির যেই ব্যবস্থা সে করে রেখে এসেছে, তাতে যে দু’জনকেই একই সঙ্গে শাস্তি পেতে হবে!
“কী ব্যাপার? গ্যাসের গন্ধ আসছে কোথা থেকে?!” বাসার ভেতর থেকে ভেসে এলো মিলির অজ্ঞাতনামা প্রেমিকের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর।
“তাইতো! একটু দাড়াও, আমি কিচেনে গিয়ে দেখে আসছি সিলিন্ডারের লাইন লিক হলো কিনা!” মিলিও বলল উত্তেজিত কণ্ঠে।
না, আর কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নয়। শাস্তি দু’জনকেই পেতে হবে। মিলির প্রেমিককে শাস্তি পেতে হবে একজন বিবাহিতা মহিলাকে প্রেমের জালে ফাঁসানোর জন্য। আর মিলিকে শাস্তি পেতে হবে নিজের স্বামীর সঙ্গে এই জঘণ্য প্রতারণা করার জন্য। হাসান দ্রুত তার প্যান্টের দুই পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে একটা কিছুর খোঁজে পকেট হাতড়াতে লাগলো।
“অ্যাই শুনছো?! সবকয়টা সিলিন্ডার থেকে গ্যাস লিক হচ্ছে!” রান্নাঘর থেকে ভেসে এলো মিলির উত্তেজিত স্বরের চিৎকার, “দরজা, জানালা সব খুলে দাও জলদি!”
বাসায় সবসময়ই অন্তত দু’টো বাড়তি গ্যাস সিলিন্ডার এনে রাখা থাকে। হাসান যেহেতু তার গবেষণার কাজে ব্যস্ত থাকে, তাই দেড়-দুই মাস পরপর গ্যাস শেষ হয়ে গেলে নতুন সিলিন্ডার আনার ঝামেলা এড়াতেই এমনটা করা। আর সেটাই আজ হাসানের সবচেয়ে বড় অস্ত্র! হাসান বাসার সবকটা জানালা বন্ধ করে দিয়ে শুধুমাত্র ড্রয়িং ছোট জানালাটা খোলা রেখে তিনটা সিলিন্ডারেরই মুখ খুলে দিয়ে এসেছে। এত পরিমাণ গ্যাস এত অল্প সময় এত ছোট জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না।
কয়েক মুহুর্ত পকেট হাতড়েই যা খুঁজছিলো তা পেয়ে গেলো হাসান। দ্রুত হাতে নিজের লাইটারটা পকেটের ভেতর থেকে বের করে আনলো সে। তারপর আর এক মুহুর্তও দেরি না করে লাইটারটা জ্বালিয়ে ছুড়ে মারলো ড্রয়িং রুমের জানালা বরাবর। সঙ্গে সঙ্গে ঘটলো প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ। দাউদাউ করে জ্বলতে লাগলো আগুন। আর ভেতর থেকে ভেসে আসতে লাগলো মিলি এবং তার প্রেমিকের আর্তচিৎকার!

২.
হাসানের বাড়িটা শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে বিরান একটা জায়গায়। তার স্ত্রী মিলি শহরের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ একদমই পছন্দ করে না। তাই নয় বছর আগে বিয়ের ক’দিন পরই শহর থেকে দূরে নিরিবিলি ঐ জায়গাটায় মিলির জন্যে ঐ বাড়িটা কিনেছিলো হাসান।
তবে জায়গাটা বিরান হলেও সেখানে মানুষজনের ভিড় জমে উঠতে খুব বেশি সময় লাগে নি। হয়ত আগুনের লেলিহান শিখা বহু দূর থেকেও দেখতে পেয়েছে তারা। তাই কী হয়েছে তা দেখতে ছুটে এসেছে। হাসান যখনই দেখলো যে একজন দু’জন করে ধীরে ধীরে প্রচুর মানুষের ভিড় জমে উঠছে, সে ঠিক করল এখানে আর দাঁড়াবে না। না, ধরা পড়বার ভয়ে নয়। মানুষজনের প্রশ্নবাণের ভয়ে। ঐ মুহুর্তে এত লোকের হাজারো প্রশ্নের জবাব দেয়ার মত মানসিক অবস্থায় ছিলো না সে। তাই যেই ভাবা সেই কাজ। ওখান থেকে সে সোজা চলে এসেছে তার জন্যে যে জায়গাটা সবচাইতে নিরাপদ সেখানে, তার ল্যাবরেটরীতে।
হাসান ভেবেছিলো, স্ত্রীর ওপর এই ভয়ানক প্রতিশোধটা নেবার পর তার মনের অস্থিরতা কিছুটা হলেও কমবে। কিন্তু না, তার সেই অস্থিরতা যেন হাজারগুণে বেড়ে গেছে! শত হলেও মিলিকে তো সে ভালোবাসতো। তিন বছর প্রেম করার পর সে বিয়ে করেছিলো মিলিকে। হ্যাঁ, মিলি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। চরম অন্যায় করেছে মিলি তার সাথে। কিন্তু তাই বলে সে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে প্রাণে মেরে ফেললো?!
হাসান বারবার নিজের মনকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, সে যা করেছে একদম ঠিক করেছে। তার স্ত্রী তার ভালোবাসার যেই প্রতিদান দিয়েছে, তার জন্যে তার এটাই প্রাপ্য! কিন্তু তার মন যেন কিছুতেই মানছে না, বরং আরো বেশি অস্থির হয়ে উঠছে!
এরই মধ্যে চার-পাঁচ ঘণ্টা পাড় হয়ে গেছে। বাইরে হয়ত ইতোমধ্যেই ভোরের আলোও ফুটতে শুরু করেছে। কিন্তু হাসানের মন থেকে তার স্ত্রীর চিন্তা কিছুতেই যাচ্ছে না।
“এটা… এটা… এটা আমি কী করলাম?! মিলিকে আমি একটা সুযোগ তো অন্তত দিতে পারতাম!” অস্থিরভাবে নিজের ল্যাবরেটরীর ভেতরে পায়চারি করতে করতে হাসান বিড়বিড় করলো, “তা না করে ওকে এভাবে… এভাবে প্রাণে মেরে ফেললাম? ওর সাথে… ওর সাথে শেষবারের মত একবার কথাও বললাম না?!”
হাসানের মাথা পুরো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে! স্ত্রী হত্যার অপরাধবোধ থেকে সে কিছুতেই বেরোতে পারছে না। তাই অস্থিরভাবে ল্যাবের ভেতরে পায়চারি করতেই থাকলো সে। পায়চারি করতে করতে হঠাৎ করেই তার চোখ গিয়ে পড়লো টেবিলের ওপর রাখা সেই ডিভাইসটার ওপর।
টাইম ডিভাইস! এই শতাব্দীর সবথেকে বড় আবিষ্কার! আর নিঃসন্দেহে এই আবিষ্কারের সমস্ত কৃতীত্বের দাবীদার হাসান নিজে। হাসান তার জীবনের আটটা বছর উজাড় করে দিয়েছে তার এই আবিষ্কারের পেছনে। তবে এই মুহুর্তে সেসব নিয়ে কিছু ভাবছে না সে। তার মাথায় এখন অন্য চিন্তা। ডিভাইসটার ওপর চোখ পড়তেই একটা বুদ্ধি খেলে গেছে হাসানের মাথায়।
হাসান ছুটে গেলো টাইম ডিভাইসটার কাছে। ডিভাইসটার নিচে ডানপাশে একটা লাল বোতাম চেপে দিলো সে, সঙ্গে সঙ্গে মৃদু গুঞ্জন তুলে চালু হলো ডিভাইসটা। দুই থেকে তিন সেকেন্ডের মাথায় ওপরের স্ক্রীনটাতে আলো ফুটে উঠলো। স্ক্রীণে লেখা ভেসে উঠলো- “Please Enter The Time Equation!”
হাসান দ্রুত হাতে ডিভাইসের গায়ের কয়েকটা বোতাম চেপে তার বের করা সময় সমীকরণটা প্রবেশ করালো। তারপর “Enter” লেখা বোতামটা চেপে দিতেই স্ক্রীণে ভেসে উঠলো একটা ফর্ম। সেই ফর্মটাতে কেবল তিনটা তথ্য প্রবেশ করাতে হবে- সময়, তারিখ, এবং লোকেশন। হাসান সময়ের জায়গায় লিখলো- 11:30 PM। তারপর তারিখের জায়গায় লিখলো- 23rd March, 2021। এরপর লোকেশনের জায়গায় নিজের বাসার লোকেশন প্রবেশ করিয়ে ডিভাইসটার জিপিএস ট্র্যাকার অন করে দিয়ে আবার “Enter” লেখা বোতামটা চাপলো সে।
সঙ্গে সঙ্গে টাইম ডিভাইসের ওপরে পজিটিভ এবং নেগেটিভ টার্মিনাল দু’টোর মাঝখানে স্পার্ক করতে শুরু করল। কয়েক পা পিছিয়ে গেলো হাসান। একদৃষ্টে টার্মিনাল দু’টোর মাঝ বরাবর তাকিয়ে রইলো সে। তার চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো, যখন সে দেখলো টার্মিনাল দু’টোর মাঝখানে যে জায়গাটায় স্পার্ক হচ্ছে সেখান থেকে একটা উজ্জ্বল আলোকচ্ছটা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে!
দেখতে দেখতে বিরাট একটা সুরঙ্গ উন্মুক্ত হলো টার্মিনাল দু’টোর মাঝখান থেকে। হাসান সম্মোহিতের মত তাকিয়েই রইলো সুরঙ্গটার দিকে। ক্ষণিকের জন্যে স্ত্রীর শোক ভুলেই গেলো হাসান, তার আবিষ্কৃত টাইম ডিভাইস একটা সত্যিকারের সময় সুরঙ্গ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে এই খুশিতে!
মোহাচ্ছন্নের মত এক পা এক পা করে সময় সুরঙ্গের দিকে এগোতে লাগলো হাসান। পৃথিবীর প্রথম সময় পরিভ্রমণকারী সম্ভবত সে-ই হতে যাচ্ছে!

৩.
হাসান সময় সুরঙ্গে পা রেখে সারতে পারে নি, ওমনি একটা শক্তি যেন তাকে টেনে নিয়ে গেলো সুরঙ্গের ভেতরে। তীব্র আলোর ঝলকানির কারণে চোখ খোলা রাখা দায় হয়ে দাঁড়ালো হাসানের পক্ষে। চোখ বুজে ফেললো সে। কতক্ষণ ধরে সেই অজানা শক্তিটা হাসানকে সময় সুরঙ্গের ভেতর দিয়ে টেনে নিয়ে গেলো, হাসান জানে না। একসময় ধপাস করে মাটির ওপরে আছড়ে পড়লো হাসান। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলো সে। আস্তে আস্তে চোখ খুললো। চারপাশে নিকষ কালো অন্ধকার। সময় সুরঙ্গের ভেতরের তীব্র আলোয় তার চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ায় বেশ খানিকক্ষণ সময় লাগলো অন্ধকারটা তার চোখে সয়ে আসতে। অন্ধকার সয়ে আসার পর হাসান তার চোখের সামনে যা দেখলো, তাতে বিস্ময়ে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো।
তার চোখের সামনে অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তার একতলা বাড়িটা!
তারমানে সে সত্যি সত্যিই সময় পরিভ্রমণ করে চার-পাঁচ ঘণ্টা পিছিয়ে এসেছে! মাটিতে আছড়ে পড়ার কারণে তার শরীরের ব্যথাই বলে দিচ্ছে, চোখের সামনে সে যা দেখছে তা কোনো স্বপ্ন নয়, সত্যি।
উঠে দাঁড়ালো হাসান। বেশ কয়েকবার ঝাড়া দিয়ে গায়ে লেগে থাকা ধূলোবালি পরিষ্কার করল সে। তারপর বাড়ির দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে কলিংবেল চেপে অপেক্ষা করতে লাগলো।
“মিলির প্রেমিকের তো এখন বাড়ির ভেতরেই থাকার কথা। নাকি সে এখনো এসে পৌঁছায় নি?” আপনমনে হাসান বলল।
আরো বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর হাসান যখন আবার কলিংবেল চাপতে যাবে তখনই ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলো মিলি। দরজার বাইরে দাঁড়ানো হাসানকে দেখে খুশিতে ঝলমল করে উঠলো মিলির মুখ।
“আরে! তুমি চলে এসেছো?!” উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে মিলি বলল, “ভেতরে এসো! সরি আমি ওয়াশরুমে ছিলাম, তাই দরজা খুলতে দেরি হলো।”
মিলি পিছিয়ে গিয়ে হাসানকে ভেতরে ঢোকার জায়গা করে দিলো। হাসান ভেতরে ঢুকে পুরো বসার ঘরটার ওপর একবার চোখ বোলালো। তার চোখ খুঁজছে মিলির প্রেমিককে। পুরো ঘরে মিলি ছাড়া আর কারো চিহ্নমাত্র নেই। ড্রয়িং রুমের একপাশে ডাইনিং স্পেস এবং তার পাশেই রান্নাঘর। রান্নাঘরটা শুধুমাত্র একটা স্বচ্ছ কাচের দেয়াল দিয়ে আলাদা করা। রান্নাঘরে জায়গাও কম। সেখানে যদি কেউ থাকত তবে হাসান এই মুহুর্তে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকেই দেখা যেত। ড্রয়িং রুমের আরেকপাশে হাসানের স্টাডিরুম এবং বাড়ির গেস্টরুম। ঐ দু’টো ঘরের চাবি সবসময় হাসানের কাছেই থাকে, সুতরাং মিলির প্রেমিকের ঐ দু’টো ঘরের একটাতেও থাকার কথা না। তারমানে মিলির প্রেমিক এখন তাদের বেডরুমেই আছে!
মিলির দিকে তাকিয়ে হাসান শীতল গলায় জিজ্ঞেস করল, “আমি চলে এসে অসুবিধায় ফেলে দিলাম বুঝি?”
“হ্যাঁ! অনেক অসুবিধায় ফেলে দিয়েছো!” ঠাট্টার সুরে বলল মিলি, তারপর ফিক করে হেসে ফেললো। বলল, “এক কাজ করো, জলদি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি ডাইনিং টেবিলে খাবার লাগিয়ে দিচ্ছি।”
বলেই রান্নাঘরের দিকে হাটা ধরল মিলি। হাসান পেছন থেকে ডেকে একই রকম শীতল কণ্ঠে বলল, “তোমার বয়ফ্রেন্ডকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছো? আমাদের বেডরুমে নাকি?”
থমকে দাঁড়ালো মিলি। পেছন ফিরে তাকালো হাসানের দিকে। অবাক হয়ে বলল, “কী বললে?”
“বললাম,” হাসান বলল, “আমার অনুপস্থিতিতে তোমার যেই প্রেমিক তোমার কাছে আসে, সে কি এখন আমাদের বেডরুমে লুকিয়ে আছে?”
মুখে কিছুই বলল না মিলি। হতবাক হয়ে সে তাকিয়ে রইলো হাসানের দিকে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেন কিছু বলার মত ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। হাসান আবারও অত্যন্ত শান্ত স্বরে বলল, “তুমি আমার সঙ্গে সুখী নও এটা আমাকে একবার বললেই পারতে পারতে মিলি। আমি মানছি যে আমি তোমাকে ঠিকমত সময় দিয়ে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু তাই বলে তুমি আমাকে ফাকি দিয়ে অন্য একজনের সাথে এভাবে…”
“চুপ করো তুমি!” এবারে মিলি রীতিমত চিৎকার করে উঠলো, “চুপ করো! কী আবোল তাবোল বলছো তুমি এসব? বছরের পর বছর ল্যাবে পড়ে থাকতে থাকতে তোমার মাথাটা কি একেবারেই বিগড়ে গেছে?!”
“চিৎকার কোরো না মিলি!” হাসান এবার মেঘস্বরে বলল, “আমি মোটেও আবোল তাবোল বকছি না, আর আমার মাথাও বিগড়ায় নি। আমি তাই বলছি যা আমি দেখেছি।”
মিলি আবারও চিৎকার করে উঠলো, “কী দেখেছো তুমি? বলো কী দেখেছো?!”
“আমি তোমাকে তোমার প্রেমিকের সঙ্গে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখেছি আমাদের বেডরুমে।” কথাটা বলে হাসান একবার দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটার দিকে তাকালো। এখন রাত এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট। ঘড়িতে সময়টা দেখে নিয়ে হাসান আবার তাকালো মিলির দিকে। বলল, “এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোমার প্রেমিক এখনো আমাদের বেডরুমেই আছে।”
মিলির দুই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তার দু’চোখের জল। অনেক চেষ্টা করে কান্না আটকে রাখতে পারে নি সে। কয়েক মুহুর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে আরো কয়েক ফোটা চোখের জল ফেলে মিলি একপর্যায়ে ছুটে এসে হাসানের ডানহাতটা চেপে ধরলো। তারপর তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো তাদের বেডরুমে। হাসানকে বেডরুমের ঠিক মাঝখানে এনে দাঁড় করিয়ে মিলি কাঁদতে কাঁদতে বলল, “কোথায় আমার প্রেমিক? কোথায়?! নাও, ভালো করে খুঁজে দ্যাখো! তাতেও যদি তোমার মনে শান্তি হয়!”
হাসান পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজলো। কিন্তু কারো টিকিটাও পেলো না! প্রমাদ গুণলো হাসান। তবে কি মিলির কথাই ঠিক? দিনের পর দিন ল্যাবে পড়ে থাকতে থাকতে এবং অমানুষিক পরিশ্রম করতে করতে তার মাথাটা কি আসলেই বিগড়ে গেছে? তখন সে যা কিছু দেখেছে সেসব কি স্রেফ তার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা?! পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খুজেও কাউকে না পেয়ে এখন তো তার সেটাই মনে হচ্ছে!
“তুমি কীভাবে পারলে আমার সম্পর্কে এরকম ধারণা করতে?! কীভাবে পারলে?” মিলি এবার রীতিমত হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
মিলির কান্না দেখে হাসান আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। সে মিলির কাছে ছুটে গিয়ে মিলিকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর মরিয়া হয়ে সে বলল, “আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও মিলি! আমার ভুল হয়ে গেছে! বিরাট বড় ভুল…”
হাসান আর কথা শেষ করতে পারলো না। তার গলা ধরে এলো। মিলিও কিছুই বলল না, কেবল হাসানের বুকে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেই লাগলো। এভাবে কতক্ষণ পাড় হয়ে গেলো সেটা তারা নিজেরাও জানে না। এক পর্যায়ে মুখ তুললো মিলি। হাসানের মুখের দিকে তাকিয়ে সে কাঁদো কাঁদো স্বরেই মিনতির সুরে বলল, “আমার একটা কথা রাখবে?”
“বলো, কী কথা?”
“আমার এক বন্ধু আছে সাইকিয়াট্রিস্ট।” মিলি বলল, “তুমি কাল সকালে একবার আমার সাথে যাবে ওর কাছে?”
মিলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো হাসান। তারপর মৃদু হাসার চেষ্টা করে বলল, “তুমি আমাকে যেখানে নিয়ে যাবে, আমি সেখানেই যাবো। এখন থেকে তুমি যা যা বলবে, আমি তাই করব। শুধু তুমি আমার ওপর রাগ করে থেকো না প্লিজ!”
মিলি মুখে কিছুই বলল না, সে আবারও জড়িয়ে ধরল হাসানকে।
হঠাৎ করেই একটা বিকট গন্ধ এসে আঘাত হানলো হাসানের নাকে। গ্যাসের গন্ধ! হাসান নাক্মুখ কুচকে উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠলো, “কী ব্যাপার? গ্যাসের গন্ধ আসছে কোথা থেকে?!”
মিলি মুখ তুলে নাক উচু করে গন্ধ শুঁকতে চেষ্টা করল। বিস্ময়ঝরা কণ্ঠে সে বলল, “তাইতো! একটু দাড়াও, আমি কিচেনে গিয়ে দেখে আসছি সিলিন্ডারের লাইন লিক হলো কিনা!”
কথাটা বলেই শোবার ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো মিলি। এদিকে বিকট গন্ধটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে!
হঠাৎ করে একটা চিন্তা মাথায় আসতেই আতঙ্কের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো হাসানের শিরদাঁড়া বেয়ে। একদৌড়ে বেডরুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে এলো হাসান। তারপর ড্রয়িং রুমের ছোট জানালাটার দিকে তাকাতেই বিস্ফারিত চোখে সে দেখলো, জানালার বাইরে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে একটা কিছুর খোঁজে নিজের পকেট হাতড়াচ্ছে একজন লোক।
“অ্যাই শুনছো?! সবকয়টা সিলিন্ডার থেকে গ্যাস লিক হচ্ছে!” রান্নাঘর থেকে ভেসে এলো মিলির উত্তেজিত স্বরের চিৎকার, “দরজা, জানালা সব খুলে দাও জলদি!”
হাসান হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েই রইলো। তার পা যেন জায়গায় জমে গেছে। চিৎকার করার জন্যে মুখ খুললো সে, কিন্তু মুখ দিয়ে তার কোনো আওয়াজ বেরোলো না! সে হতবাক হয়ে কেবল তাকিয়েই আছে বাইরে দাঁড়ানো লোকটার দিকে, যে ইতোমধ্যেই নিজের পকেট থেকে একটা লাইটার বের করে এনেছে। সেই লোকটা অন্য কেউ নয়, বরং হাসান নিজেই!
হাসান জানে, কয়েক মুহুর্তের মাঝেই যে ঘটনাটা ঘটতে চলেছে, সেটাকে সে ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু সে এটাও জানে, এখানেই সবকিছুর শেষ নয়! জানালার বাইরে যেই হাসানকে সে দেখতে পাচ্ছে, সে তাকে এবং মিলিকে শেষ করে ফিরে যাবে নিজের ল্যাবে। সেখানে গিয়ে সময় পরিভ্রমণ করে সে আবার ফিরে আসবে অন্য কোনো প্যারালাল ইউনিভার্সের ২৩শে মার্চ, ২০২১ তারিখের রাত এগারোটা বেজে ঠিক ত্রিশ মিনিটে, নিজের স্ত্রী মিলিকে বাঁচাতে। তারপর একই ভাবে এই হাসানও প্রাণ হারাবে সেই ইউনিভার্সের হাসানের প্রতিহিংসার আগুনে! তার সঙ্গে প্রাণ হারাবে সেই ইউনিভার্সের মিলিও! এবং সেখানেও যে শেষ নয় এটাও হাসান বেশ ভালো করেই জানে। সে জানে, এই টাইম প্যারাডক্স চলতে থাকবে অনন্ত কাল ধরে! প্রতিবার সে ফিরে আসবে, এবং প্রতিবারই তার মৃত্যু হবে তার নিজেরই অন্য এক অস্তিত্বের হাতে।
সে এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছে, মিলির সঙ্গে সে যাকে দেখেছিলো সে ছিলো অন্য এক প্যারালাল ইউনিভার্স থেকে সময় পরিভ্রমণ করে আসা তারই আরেক অস্তিত্ব। হাসান তার গবেষণায় সফল হওয়ার সুখবর মিলিকে জানাতে ল্যাবরেটরী থেকে বের হয়ে নিজের গাড়িতে চড়ে বাড়ি ফিরেছিলো। কিন্তু অন্য কোনো এক ইউনিভার্সের হাসান হয়ত সেটা করে নি। সে হয়ত চেয়েছিলো নিজের সদ্য আবিষ্কৃত টাইম ডিভাইস ব্যবহার করে সময় পরিভ্রমণ করে নিজের স্ত্রী মিলির কাছে গিয়ে মিলিকে চমকে দিতে। কিন্তু সে ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবে নি যে সে সময় পরিভ্রমণ করে নিজের কাঙ্খিত সময়ে তো যাবে, কিন্তু সেটা অন্য কোনো প্যারালাল ইউনিভার্সে, তার নিজের ইউনিভার্সে নয়। বেচারা হয়ত এটাও ভাবে নি, সেই ইউনিভার্সে তারই আরো একটা অস্তিত্ব থাকতে পারে, এবং একটা ছোট্ট ভুল বোঝাবুঝির জের ধরে তার সেই অস্তিত্বের হাতে তার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে!
হাসান নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে, কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে বুঝতে! ড্রয়িং রুমের জানালার বাইরে দাঁড়ানো এই ইউনিভার্সের হাসান ইতোমধ্যেই তার হাতের লাইটারটা জ্বালিয়ে ছুড়ে দিয়েছে জানালার দিকে। আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেললো হাসান। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে বিড়বিড় করে সে বলল, “আবার আসিবো ফিরে!”

Related Posts

13 Comments

মন্তব্য করুন