নীলাকে আবার দেখতে পাবো, এটা কোনো দিন আমি ভাবি নি। নীলা গত বছর হঠাৎ হারিয়ে গেছিল। কোথা থেকে হারিয়ে গেছিল সেটাও জানি না, শুধু আমি না, কেউ জানে না। সে কি কিডন্যাপ হয়েছিল। না, নিজেই তার চেনা জগৎ থেকে নিজেকে আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিল। তা আমরা জানি না।
শুধু জানি, নীলা ফিরে এসেছে।
মানানসই লম্বা, ছিপছিপে গড়নের নীলা ফিরে এসেছে। অনেকেই অনেক কথা বলতেছে, এতদিন কোথায় ছিল মেয়েটা। কি করছিল। কি কি পরিবর্তন হয়েছে তার। আগের সেই হাসিখুশি নীলা আজ যেন জীবনের সহস্র মাইল পার হয়ে ক্লান্ত, হতাশ হয়ে গেছে। মুখে হাসি নেই। মুখাবয়বে স্পষ্ট যন্ত্রণার ছাপ।
আমি দেখতে গেলাম নীলাকে। তখন তাদের বাড়িতে ওর ছোট ভাই রাজ আর ওর বুড়ি খুড়িমা ছাড়া আর কেউ ছিল না। অতি উৎসাহী দর্শক শ্রোতারা এর মাঝেই তাদের কৌতুহল নিবারন করে চলে গেছে। নীলা তখন বারান্দার খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। মাথা নীচু করে কি যেন ভাবছিল সে। আমাকে দেখতে পেয়ে ম্লান হেসে বলল, কেমন আছিস বিন্দু।
আমি তার ম্লান হাসির মাঝে তার জীবনের গত একটা বছরের প্রতিটি দিনের যন্ত্রণা আর কষ্টের আভাস পেলাম। এমন তো ছিল না। যে মেয়ে এক মহূর্ত না হেসে থাকতে পারতো না। আজ সে কি না স্তম্ভিত। আর পরিণত। বালিকা স্বভাবটি আর তার মাঝে নেই।
আমি বললাম, এইতো আছি। কিন্তু তোর এমন চেহারা কেন। কোথায় ছিলিস্ তুই।
আমার কথায় ওর মন যেন আরো খারাপ হয়ে গেল। অনেক কষ্টে বলল, বলবো, তোকেই বলবো বিন্দু। এখনও যা কাউকে বলতে পারিনি, তোকে তা বলবো।
কথাগুলো বলতে নীলার দু চোখ পানিতে ভরে গেল।
নীলা ভালবাসত পাশের গ্রামের রাজেস কে। রাজেসও নীলাকে ভালবাসতো। তাদের কথা হতো রোজই। দেখাও করতো লুকিয়ে লুকিয়ে। রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে রাজেস নীলাদের বাড়ির পশ্চিমে লিচু বাগানে আসতো। তাদের প্রেম কাহিনি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছিল। নেশার মতো গ্রহণ করছিল একে অপরকে। তারপর একদিন-
নীলার রজঃস্রাব বন্ধ হয়ে গেল। তারও কিছুদিন পর নীলার বমি বমি লাগতে শুরু করলো।
নীলার এ অবস্থা দেখে তার খুড়িমা বলল, মুখপুড়ি, কার সন্তান তোর পেটে নিয়েছিস। একথা জানাজানি হওয়ার আগে ওকে বিয়ে করতে বল। নীলা আন্দাজ করেছিল। এইরকম কিছু একটা ঘটবে। লাগাম ছাড়া ঘোড়ার মতো তারা ছুটছিল।
ফল তো একটা হতোই। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে এটা সে আশা করে নি। সেদিন খুড়িমাকে কিছু বলতে পারে নি। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে লিচু বাগানে যায় নীলা। যেখানে রোজ দেখা করে সেখানে যায় সে। বাঁশের পাতানো মাচানে বসে নীলা। মনে তার হাজারো প্রশ্ন। কিন্তু এ হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে একমাত্র রাজেস।
কি বলবে নীলা?
এমন সময় একটু দূরে কয়েকজন লোকের ফিসফিস আওয়াজ শুনতে পায়। আর একজনের গোঙানির শব্দ। অজানা ভয়ে নীলা কাঁপতে থাকে। কি করবে সে বুঝতে পারে না। সে কি বাড়ি চলে যাবে, না এগিয়ে গিয়ে দেখবে। ভয়ে তার পা যেন সরছে না। কিন্তু তার সিক্সথ সেন্স বলছে, অঘটন কিছু একটা ঘটতে চলেছে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় নীলা অজানা ভয়ে কাঁপতে থাকে। ফিসফিস কিন্তু ধমকানোর মতো আওয়াজ ধীরে ধীরে কাছে চলে আসছে। কোনো রকমে নীলা মাচান থেকে নেমে একটা লিচু গাছের ঝোপালো ডালে উঠে পড়ে। আবছা আলোয় দেখতে পায়, চার জন লোক একজনকে বেঁধে আনছে। যাকে বেঁধেছে, তার মুখও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। মুখ বাঁধা লোকটি কথা বলতে পারছে না। কেবল গুঙিয়ে যাচ্ছে।
চার জন লোকের চেহারা দেখতে অনেকটা ডাকাতদের মতো। লম্বা, তাগড়া চেহারার, সবার হাতেই কোনো না কোনো অস্ত্র। রামদা, ছুরি, বল্লম, আর একজনের হাতে একটা পিস্তল। ভয়ানক ব্যাপার। নীলা কিছু বুঝে উঠার আগে বেঁধে রাখা লোকটির মুখের ওপরে পিস্তল ঠেকিয়ে এক লোক বলে, ব্যাটা এত রাতে যাচ্ছিস কোথায়। আমাদের সামনে এলি কেনো।
মুখ বাঁধা লোকটি কি যেন বলতে চাইলো, কিন্তু মুখ বাঁধা থাকার কারণে গুঙিয়ে উঠলো। লীলা ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে। কারা এরা, আর কাকে বেঁধেছে। রাজেস নয়তো আবার। কে জানে ভগবান, রাজেসকে তুমি রক্ষা করো। রাজেস যেনো এখন এদিকে আর না আসে। চারজনের একজন লোকটার মুখ খুলে দিলো। হায় ভগবান, নীলা রাজেসকে চিনতে পারলো। ওরা কারা, রাজেসকে ওরা ধরলো কেন। আর এখন কি করবে নীলা। সেকি চিৎকার দিবে। নাকি এগিয়ে যাবে রাজেসকে বাঁচাতে। কিন্তু সে কিভাবে বাঁচাবে রাজেসকে। সে একা কিভাবে পেরে উঠবে এতজনের সাথে। এরকম হাজারো প্রশ্নের উত্তর যখন নীলা খুঁজছে। তখন একজন রাজেস এর মাথায় আঘাত করে। রাজেস বোবা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য নীলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। ডাকাতদের একজন নীলাকে দেখতে পায়। ধরা পড়ে যায় নীলা। নীলার মাথাতেও আঘাত করা হয়। তারপর আর কিছুই মনে পড়ে না নীলার।
যখন হুঁশ হয়। তখন নীলা নিজেকে আবিস্কার করে একটা বদ্ধ ঘরে। চোখ মেলে দেখে একটা মাত্র জানালা, সেটাও বন্ধ করা আছে। জানালার ফোকর দিয়ে বাইরের আলো প্রবেশ করেছে। চোখ সয়ে যেতেই নীলা দেখতে পায়। ঘরে একটা বিছানা পাতা আছে। আর সে বিছানার পাশে ফাঁকা মেঝেতে সে শুয়ে আছে। প্রথমে কিছুই মনে পড়ে না তার। নিজের নামটাও মনে করতে পারে না সে। তারপর ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে। রাজেসকে খোঁজে। না, রাজেসকে সে দেখতে পায় না। নিজের অাধমরা দেহটাকে টেনে খাট ধরে কোনো মতে দাঁড়ায় সে। তারপর বিছানায় বসে পড়ে। তার মাথার আঘাতের জায়গাতে ব্যাথা করছে। কি করবে। কি করবে না, এসব কিছু সে ভাবতে পারছে না। আরো কিছু সময় পরে জানালার কাছে যায় নীলা। জানালার খিল খুলে দেয়। জানালা খুলতে বাইরের দুপুরের আলো ঘরে প্রবেশ করে। কিন্তু ঘরের জিনিস দেখার আগে বাইরের দিকে চোখ স্থির হয় তার।
একি দেখছে সে। বাইরে তো জঙ্গল। বিভিন্ন পাখির ডাকছে। জনমানবহীন শুনশান নীরবতা ভেঙে বাদরের চিৎকারও সে শুনতে পাচ্ছে। এই জঙ্গলের ভিতরে এরকম একটা ঘরে সে এলো কিভাবে? তবে কি ঐ ডাকাতেরা তাকে ধরে এনেছে। আর রাজেস, তাকে কি করেছে তারা।