প্রথম বিশ্বযুদ্ধ – পরবর্তী জার্মানি এবং এডলফ হিটলার এর আবির্ভাব।
•প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের ফলে রাজ্যসীমা ও উপনিবেশিক সাম্রাজ্যের যেমন ঘাটতি ঘটে, তেমনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জার্মানির প্রতিপত্তি ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে এক গভীর হতাশা ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা দেখা দেয়। শাসন ব্যবস্থার শিথিলতার সুযোগে দেশে অরাজকতা দেখা দিলে শাসক কাইজার দেশত্যাগ করে হলান্ডে আশ্রয় নেন। ফলে জার্মানির রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং প্রজাতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হয়। সাময়িকভাবে ‘কাউন্সিল অব পিপলস কমিসার’ নামে একটি কার্যনির্বাহক সমিতির উপর শাসনভার ন্যস্ত হয়। নবগঠিত সরকার (যারা সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী) জনগণকে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ও জান মালের নিরাপত্তা বজায় রেখে চলতে অনুরোধ জানায়। তাই শাসন ব্যবস্থা জাতীয় সংবিধান সভা কর্তৃক স্থির হবে বলে তারা আশ্বাস দেয়। জার্মানির কমিউনিস্ট যারা ‘স্পার্টাকিস্ট’ নামে পরিচিত, তারা পূর্ণমাত্রায় সাম্যবাদ প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে লাইবনেকটের নেতৃত্বে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে থাকে। ইবার্ট তাদের আন্দোলন কঠোর হস্তে দমন করলে স্পার্টাকাসদের ক্ষমতা দখলের চেষ্টা বিফল হয়। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে যে নির্বাচন হয় তাতে ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দল ‘ ৪২১ টি আসনের মধ্যে ১৬৩ টি আসন পায়। ভাইমার নামক স্থানে জাতীয় সংবিধান সভার অধিবেশনে জার্মানির জন্য একটি প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান গৃহীত হয়। ভাইমারের নাম অনুসারে নতুন শাসন ব্যবস্থার নামকরণ হয় ‘ভাইমার প্রজাতন্ত্র’।
নতুন শাসনতন্ত্র অনুসারে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হন প্রেসিডেন্ট। আইনসভা হল দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট। উচ্চকক্ষের নাম হল রাইখস্টাডাট, যা বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত। নিম্নকক্ষের নাম হল ‘রাইখস্টাগ’, এর প্রতিনিধিরা প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে নির্বাচিত। নতুন শাসনতন্ত্র মতে ভাইমার প্রজাতন্ত্রের সর্বপ্রথম প্রেসিডেন্ট হলেন”ফ্রেডারিক ইবার্ট”।
ভাইমার প্রজাতন্ত্রের প্রথম সমস্যা ছিল মিত্রপক্ষের সাথে চুক্তি সম্পাদন। দ্বিতীয়ত, বিরোধী দলগুলোকে দমন। ভার্সাই সন্ধির কঠোরতা মিত্রপক্ষের হাতে জার্মানির অপমান জার্মানদের মনে ব্যাপক বিদ্বেষ ও বিক্ষোভের সৃষ্টি করে। সার উপত্যকা জার্মানির হস্তচ্যুত হওয়ায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফলে নবগঠিত প্রজাতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র চলতে থাকে এবং উৎখাতের চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু দেশ প্রেমিক সাধারণ সৈনিকরা জার্মান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি সহ্য করতে রাজি না থাকায় ১৯২০ ও ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের অভ্যুত্থানের চেষ্টা বিফল হয়।তাছাড়া জার্মানির উপর ক্ষতিপূরণের যে বিশাল ভার হয়েছিল তার সংস্থান করা প্রজাতান্ত্রিক সরকার একটি প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। ৬৬০ কোটি পাউন্ডের ক্ষতিপূরণের যে ভার চাপানো হলো তারও যুক্তিকতা ও দেওয়ার অক্ষমতা সম্পর্কে প্রতিবাদ জানিয়ে কোনো কাজ হলো না।উপরন্ত জার্মানিকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করার জন্য ফ্রান্স জার্মানির শিল্পসমৃদ্ধ অঞ্চল রুহর দখল করে নেয়।ফলে জার্মানির শিল্প শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়ে এবং দেশের সর্বত্র এক মারাত্মক অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে” স্টেসিম্যান” নামক এক বিচক্ষণ অর্থনীতিবিদ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের ভার গ্রহণ করলেন।জার্মানির কাছ থেকে কী পরিমাণ ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করা হবে তার জন্য একটি “ক্ষতিপূরণ কমিশন” গঠন করা হয়। কিস্তিতে জার্মান সরকার ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হওয়ায় ফ্রান্স রুহুর অঞ্চল ত্যাগ করে।
ভবিষ্যতে জার্মানির আক্রমণের ভয়ে ভীত হয়ে ফ্রান্স জার্মানির সাথে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে “লোকার্নো” যুক্তি দ্বারা জার্মানি – বেলজিয়াম, জার্মানি- ফ্রান্স এর মধ্যবর্তী সীমারেখা নির্ধারণ করে।এ সমস্যা সমাধানের ফলে জার্মানির এক ঘরে থাকার বিষয়টি সুরাহা হয় লীগ অব নেশনস এর কাউন্সিলের স্থায়ী সদস্য পদ লাভ করে।রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও অর্থনীতি ক্ষেত্রে জানুয়ারি ব্যবস্থা দিনদিনই দুর্দশার চরমে পৌঁছতে থাকে।পূর্ববর্তী ক্ষতিপূরণ কমিশনে যে সুবিধা দিয়েছিল তাও পরিশোধ করা জার্মানির পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো না। ফলে পুনরায় আওয়েন-এর নেতৃত্বে আরেকটি কমিশন গঠন করা হয়। এতে ৫৯ বছর ধরে কিস্তি দ্বারা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুযোগ জার্মানি লাভ করে। জার্মানি মার্কিন সরকারের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে ক্ষতিপূরণের কিস্তি দিতে থাকে। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা (শুরু ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে) দেখা দিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জার্মানিকে ঋণদানের অক্ষমতা জানায়।অর্থনৈতিক অক্ষমতার জন্য জার্মানির ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্ন পরিত্যক্ত হয়।এরূপ পটভূমিকায় জার্মানিতে নাৎসি দলের সদস্য ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে এবং রাজনৈতিক ও ক্ষমতার মঞ্চে এডলফ হিটলারের আবির্ভাব ঘটে।