আমি যখন এই লেখাটা লিখতে বসেছি, তখন পর্যন্ত দেশের মোট করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১১৭১৯ জন, আর মৃতের সংখ্যা ১৮৬ জন..
একজন করোনা আক্রান্ত পেশেন্ট হিসেবে সে এইটুকু অনুমান করতেই পারে যে, এই মুহূর্তে যদি যাদের উপসর্গ পাওয়া গেছে তাদের সবাইকে টেস্ট করা হয় তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা ২০-৩০ হাজার ছাড়াবে.. কারন উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও সবাই টেস্ট করাচ্ছে না.. কেউ অবহেলা করছে, কেউবা ভয় পাচ্ছে..
গত ২৪ ঘন্টায় আক্রান্তের সংখ্যা ৭৯০ জন এবং মৃতের সংখ্যা ৩ জন.. এবং দেশের প্রত্যেকটি জেলায় করোনা ছড়িয়ে পড়েছে..
আগামীকাল থেকে মসজিদে গিয়ে নামায পড়া যাবে, গার্মেন্টস খুলে দেয়া হচ্ছে এবং ১০ মে’র পর থেকে শপিংমলগুলোও খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে..মোটামুটি আন্দাজ করা যাচ্ছে দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়তে যাচ্ছে..তার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং যাদের এখন জ্বর, ঠান্ডা-কাশি, গলা ব্যথা হচ্ছে তাদের কি করতে হবে তা তিনি অকোপটে বলেছেন, সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন দিয়েছেন হয়ত আপনাদের উপকার হবে এই ভেবে।
উপসর্গ থাকায় ২৪ এপ্রিল সে এবং তার আব্বু মুগদা হসপিটালে করোনা টেস্ট করাতে যায়.. ২৭ এপ্রিল রিপোর্ট পায় যে তাদের দুজনেরই পজিটিভ এসেছে..
আগেই বলে রাখছি, কিভাবে করোনায় আক্রান্ত সে হলো তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন.. করোনা হলে ৭-১৪ দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়.. কিভাবে হয়েছে তা বুঝার উপায় নেই.. কিছুদিন আগে দেখলাম ৮০০ জন এমন পাওয়া গেছে যাদের কোনো উপসর্গ নেই.. তারা তো নিজের অজান্তেই ঘুড়ে বেরাচ্ছে এবং অন্যদের সংক্রমিত করে বেরাচ্ছে.. তবে এটুকু বলতে পারি আমাদের মধ্যে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে..
আমরা বাসার সবাই যথেষ্টই সচেতন ছিল তারা.. সে কোয়ারেন্টাইনে আগে থেকেই (যখন থেকে দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়) বাসা থেকে বের হয় না.. চলাচল বলতে, তাদের বিল্ডিংয়ের সেন্টারে এপার্টমেন্টের কয়েকজন মিলে নামায পড়া হতো এ কথাই তিনি বলছিলেন। সে আর তার আব্বু একসাথে নামায পড়তে যেতো.. তার আব্বু বাজারে যেতো.. আর মাঝেমাঝে ছাদে যেতো তাছাড়া ঘর থেকেও বের হতো না সে।
এপ্রিলের শেষের দিকে (টেস্ট করানোর কিছুদিন আগে) তার এবং তার আব্বুর ছেড়ে ছেড়ে জ্বর আসে.. ভেবেছিল সিজনাল জ্বর হয়ত.. তার শরীর দুর্বল, মুখে অরুচি (অবসাদ) এবং নাক বন্ধ ছিলো, কোনো ঘ্রাণ পেতো না সে। তার এবং তার আব্বুরও একই সমস্যা ছিলো.. কারোই গলা ব্যথা, কাশি বা শ্বাসকষ্ট ছিলো না.. আস্তে আস্তে বাসার সবারই (আম্মু, নানু, ছোটবোন) জ্বর আসে এবং দুর্বল হয়ে পড়ে.. তাই সন্দেহ দূর করতে টেস্ট করিয়েছিল সে।
প্রথমেই রিপোর্ট পাওয়ার পর বিল্ডিংয়ের সবাইকে জানিয়েছে যাতে তারা সতর্ক থাকে এবং তারা বাসায় নিয়ম মেনে আইসোলেশনে থাকতে পারে। তাদের জন্য এপার্টমেন্ট মালিক সমিতি থেকে একজন কেয়ারটেকার রেখে দেয়া হয় ওষুধ, বাজারসদাই এনে দেয়ার জন্য.. এবং প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই’ই তাদের অনেক সাহায্য করেছে..
সরকারিভাবে তাদের তেমন কোনো সাহায্য করা হয় নি.. আইইডিসিআর থেকে ফোন দিয়ে শুধু বাসায় থাকার জন্য বলেছে আর পুলিশ ফোন দিয়ে তাদের ইনফরমেশন নিয়েছে.. আইইডিসিআরে ফোন দিয়ে কোনো লাভ হবে না.. তারা অনেক লেটলি রেসপন্স করে..
করোনা পজিটিভ আসার পরে তারা অনলাইনে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ ও এন্টিবায়োটিক খেয়েছে। অনলাইনে ভিটামিন-সি পাউডার পাওয়া যায়; ওগুলো অর্ডার করেছিল তারা। বাসায় বেশি বেশি পানীয় (গরম পানি, রং চা) আর ফল-মূল খেয়েছে.. গরম পানি দিয়ে গোসল ও গরগরা করেছে. এই হচ্ছে তাদের ট্রিটমেন্ট..
পরম করুনাময় আল্লাহর রহমতে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে তারা বাসার সবাই পুরোপুরি সুস্হ.. আলহামদুলিল্লাহ.. আজকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (মিটফোর্ডে) যেয়ে ফলো আপ টেস্ট করিছে.. দুই-তিন দিনের মধ্যে রিপোর্ট পেয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ.. সবাই তাদের জন্য দোয়া করবেন..
…
সত্যি কথা বলতে, করোনা ভাইরাসের চেয়ে আমাদের সমাজে আতংক এবং নেগেটিভিটি জিনিসটা বেশি দ্রুত ছড়াচ্ছে.. অবশ্যই করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় সচেতনতার কোনো বিকল্প নাই.. সোশ্যাল ডিসটেন্সিং, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে, হাত ধুতে হবে, হাঁচি-কাশি মুখ ঢেকে দিতে হবে ইত্যাদি.. কিন্তু একইসাথে করোনা আক্রান্তদের পাশে মানবিকভাবে এগিয়েও আসতে হবে.. খবরে দেখলাম, করোনা আক্রান্ত হওয়ায় বাড়িওয়ালা ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে, ছেলে তার মাকে রাস্তায় ফেলে রেখে যাচ্ছে, স্বাস্থ্যকর্মীকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না ইত্যাদি.. এই অমানবিক ঘটনাগুলো করোনায় আক্রান্ত মৃত মানুষের সংখ্যা শোনার চেয়েও বেশি প্যাথেটিক..
শ্বাসকষ্ট এবং সিরিয়াস কন্ডিশন ছাড়া করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিতে পারে.. বরং তাদের জন্য হাসপাতালের চেয়ে বাসায় ট্রিটমেন্ট নেয়াই বেটার..
এমন সময় প্রতিবেশিরা সবচেয়ে বেশি তাদের হেল্প করতে পারেন.. দরকার হলে বাজার করে তাদের বাসার বাইরে রেখে দিয়ে আসবেন, যাতে তাদের বাসা থেকে বের হতে না হয়..করোনায় মৃতের হার প্রায় ২%.. ১০০ জনে ২ জন মারা যায়.. সবচেয়ে বেশি করোনা রিস্কে থাকেন যারা বৃদ্ধ, হার্টে বা ফুসফুসে সমস্যা আছে, ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং স্মোকাররা.. আর যাদের এই সমস্যাগুলো নেই এবং যাদের ইমিউন সিস্টেম ভালো তাদের করোনায় তেমন সমস্যা হওয়ার কথা না.. ইনশাআল্লাহ.. তাদের জন্য এটা নরমাল জ্বর-ঠান্ডা মনে করতে পারেন.. কিন্তু সবাইকে অবশ্যই নিয়ম মেনে চলতে হবে.. কারন আপনি হয়ত চাইবেন না আপনার জন্য অন্য কেউ আক্রান্ত হোক, যার হয়ত জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যাবে..
…
যাদের এখন জ্বর, ঠান্ডা-কাশি, সর্দি, অবসাদ ইত্যাদি সমস্যা হচ্ছে তারা সিজনাল কারন মনে করে বসে থাকবেন না.. যত দ্রুত সম্ভব অনলাইনে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন এবং তাদের গাইডলাইন মেনে চলুন.. আমি কমেন্টবক্সে ডাক্তারদের নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি যারা আপনাকে হেল্প করার জন্য দিনরাত ২৪ ঘন্টা ফোন নিয়ে অপেক্ষা করছে.. শ্বাসকষ্ট শুরু হলে (এটা করোনার সিভিয়ার লক্ষণ) যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করুন.. অক্সিজেন দেয়া লাগলে দিবে তা নাহলে ভ্যান্টিলেটর লাগবে..
করোনার লক্ষণগুলো এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন আমি কমেন্টবক্সে দিয়ে দিচ্ছি.. এগুলো দেখতে পারেন.. করোনার লক্ষণ প্রকাশ পেলে টেস্ট করিয়ে ফেলতে পারেন.. ঢাকার মোটামুটি সব সরকারি হাসপাতালগুলোতে এখন করোনা টেস্ট করাচ্ছে.. আর প্রাইভেট হসপিটালগুলো হয়ত বাসায় যেয়েও টেস্ট করায়.. খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন.. কুর্মিটোলা এবং কুয়েতমৈত্রী হসপিটাল থেকে বিরত থাকুন.. ওদের রিভিউ খুব খারাপ..
করোনা টেস্ট করে রিপোর্ট পজিটিভ আসলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই.. সবচেয়ে জরুরি মেন্টাল হেল্থ ঠিক রাখা.. নাহলে হয়ত আপনার শরীর করোনার বিরুদ্ধে ঠিক মত লড়াই করতে পারবে না.. চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন.. কাছের আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের জানান.. কারন বিপদে তারাই সবার আগে এগিয়ে আসবে..
করোনায় আক্রান্ত হওয়া পাপ নয়, বরং সচেতন না হয়ে অন্যদের সংক্রমিত করা পাপ..
অসুস্থ হলে রোজা রাখা দরকার নেই.. এই সময় শরীর হাইড্রেটেড রাখতে হবে.. বেশি বেশি পানি আর ভিটামিন-সি জাতীয় ফলমূল (মালটা, লেবুর সরবত) খেতে হবে.. আরেকটা কথা, আপনি একা সতর্ক থাকলেই কিন্তু আপনি নিরাপদ নন.. আপনার পরিবার ও প্রতিবেশীদের সর্তক করুন..
আর আল্লাহকে স্মরণ করুন.. রমজান মাসে বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করুন, দোয়া করুন.. নিশ্চয়ই তিঁনি আমাদের সহায় হবেন..
এবং নিশ্চয়ই আমরা অতিশীঘ্রই আমাদের নতুন পৃথিবীতে আবার আগের মত বিচরণ করবো ইনশাআল্লাহ; যেখানে হাত মেলাতে সংকোচ থাকবে না, বন্ধুকে নিরদ্বিধায় বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবো, মুখের হাঁসিটা মাস্কের কারনে ঢাকা পড়বে না আর.. সেদিনটার অপেক্ষায়…