পৃথিবীতে ভালোবাসা সবচেয়ে বড় অর্জন। যারা এটিকে অর্জন করতে পেরেছেন, তাদেরকে ভাগ্যবান বলাটা খুব বেশী হবেনা। ভালোবাসা ছাড়া মানুষ নেই। এমনকি ভালোবাসার পরিধিটা শুধু মানুষের মধ্যেও সীমাবদ্ধ নেই। ভালোবাসা যে কোন সময়ে, যে কারো সাথে, কিংবা অদ্ভুতভাবে হঠাৎ করেই হয়ে যায়। যখন ভালোবাসাটা আমাদের জীবনে আসে তখন আমরা বুঝতে পারি না।কিন্তু যখন সেটি চলে যায় তখন তার মর্ম টা আমরা স্পর্শ করতে পারি।
ভালোবাসাটা কত দামি জিনিস তা একজন সুন্দর কিংবা অসুন্দর দু’রকমের প্রাণীরাই বুঝতে পারে। কেউ আগে বোঝে কেউবা বোঝে অনেকদিন পর। সব ভালোবাসারই শুরুর কোন নির্দিষ্ট স্থান , কাল, ও সময় আছে। একেকজনের লাভ স্টোরি একেক রকম। একেকজনের ভালোবাসা এক একটি প্লাটফর্মে সৃষ্টি হয়েছে। আর সেটা কি ?আমরা বলি ভালোবাসার প্রথম প্ল্যাটফর্ম। আমার ভালবাসার প্রথম প্ল্যাটফর্ম টা আমার কাছে কিছুটা গল্পের মত। গল্প হলেও এটি এখন রিয়েল স্টোরি। শুরুটা হয়েছিল, খুব রোমান্টিক ভাবে।
আমি তখন রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে, গন্তব্য আমার অনেক দূর। আমি রেলের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। আমার হাতে খুব ভারী একটি ব্যাগ। অবশ্য কোন মূল্যবান জিনিস নেই, আমার ব্যাগে। শুধু রয়েছে কিছু ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় জিনিস। যে সময় রেলটি আসার কথা ছিল। সে সময়টা পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। ঘড়ির কাঁটা ঠিক তখন বারোটা। আমি দাঁড়িয়ে থেকে থেকে কিছুটা বোরিং হয়ে গিয়েছিলাম।
একটা সময় এতটাই বোরিং হয়ে গিয়েছিলাম, যে”তখন আমার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল। এক পর্যায়ে আমি ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। আমি যখন ফিরে যেতে চাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই আমার চোখের সামনে চলে আসলো একটি কমন দৃশ্য। আমি দেখলাম, প্ল্যাটফর্মের একটি বেঞ্চে বসে আছে একটি তরুণ বয়সের তরুণী। খুব ছিমছাম তার দেহের গড়ন। খুব বেশি সুন্দর না। তবে তার মুখমন্ডলের দিকে তাকালে, মনে হয় অনেক দিনের চেনা।
মেয়েটিঃ মোটাও না আবার চিকন তাও না। একদম মাঝামাঝি সাইজের গঠন কাটুন। দেখতে একদম কিউট। মেয়েদের দেখলেই ছেলেরা একটু তাকিয়ে থাকেন। এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। তবে আমি একটু আশ্চর্য নিত হলাম, মেয়েটিকে কাঁদতে দেখে। মেয়েটিঃ অজস্র ভাবে কেঁদে চলছে। আমার খুব মায়া হল। আমি আস্তে আস্তে তার কাছে যেতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু মনের ভেতর একটা ভয় আমার বয়ে বেড়াচ্ছে। মেয়েটির যদি আমাকে পজিটিভ ভাবে না নেয়।নানান সব চিন্তা ধারা আমার মাথার ভেতরে তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল।
স্টেশনে তেমন লোকজনের ভিড় নেই। লোকজনের ভিড় একটু কম দেখে মনে মনে একটু সাহস হচ্ছিল। এক পায়ে করছিলাম তো আর এক পা পিছনে ফেলছিলাম। আমার ঠিক কি করা উচিত আমি বুঝতে পারছিলাম না। তারপরও মনে মনে সাহস যুগিয়ে মেয়েটির ঠিক কাছে গিয়ে বসলাম।আমি যখন মেয়েটির কাছে গিয়ে বসলাম তখন আরো বেশি আশ্চার্যনিত হলাম। মেয়েটি আমাকে কোন কিছুই বলল না।
সে নিরবে নিভৃতে শুধু কেঁদেই চলছে। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর। আমার মনে হল মেয়েটিকে প্রশ্ন করার সময় আমার হয়ে গেছে। আমি খুব মৃদুস্বরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে আপনার? মিটি আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালো। মেয়েটির চোখ দুটো তখনও ঢকঢক করে লাল হয়ে জ্বলছে। মেয়েটির পাশে রাখা আছে বড় একটি কালো ব্যাগ। ব্যাগ নয় মনে হচ্ছিল একটি লাগেজ।
তবে আজকাল এত বড় লাকেরস নিয়ে কাউকে প্লাটফর্মে দেখা যায় না। আমি মনে মনে ভয় পেয়ে গেলাম। আমি ভাবতে লাগলাম মেয়েটি এখন কী রিঅ্যাকশন টা দেখাবে। কিন্তু আমি যেমনটি ভাবছি তেমনটি ঘটল না। মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে তার চোখ দুটো আবার নিচের দিকে করে নিল। আমি এবার সাহস করে তাকে, প্রশ্নটিই দ্বিতীয় বার করলাম। তবে এবার বিষয়টি অন্য রকম হলো।
মেয়েটি আমাকে বলল আপনার সমস্যা কি? আমি একটু বিচলিত হয়ে গেলাম। আমি ভাবতে লাগলাম মেয়েটিকে এখন কি বলবো। হঠাৎ আমার মাথায়, অটো বুদ্ধির উদয় হলো। আমি খুব স্মার্টলি তাকে বললাম, আমার কাছে শেয়ার করতে পারেন।যদি কোন হেল্প আমি করতে পারি তবে নিজেকে খুব ধন্য মনে করব। মেথি কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো। আমার চোখে চশমা ছিল। আমি চশমাটা চোখ থেকে খুলে নিয়ে বুকের ঠিক মাঝখানে রেখে দিলাম।
আমি একটু নম্র-ভদ্র তার অভিনয় করতে লাগলাম। মেয়েটিঃ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর তার মুখ খুলল। মেয়েটি আমাকে যা যা বলল,মেয়েটি: আমার সংসারটা এবার ভেঙে গেল/আমি: আমি একটু হতভম্ব হয়ে গেলাম/আমি ভেবেছিলাম মেয়েটির বিয়ে হয়নি/কিন্তু মেয়েটি বিবাহিতা/আমি: হাজবেন্ডের সাথে ঝগড়া হয়েছে/মেয়েটিঃ না ঝগড়া টগরা হয়নি। ওই ব্যাটা অন্য একটা বিয়ে করেছে।আমি: আমি এবার একটু বেশি হতবাক হয়ে গেলাম/মানুষ কি বোকা/এমন একটি সুন্দর মেয়ে বউ হিসেবে থাকতে অন্য একটি বিয়ে মানুষ কিভাবে করতে পারে/আমি: আপনার হাজব্যান্ড কি করত?
মেয়েটি: ও একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার/বিয়ের প্রথম দিকে আমাকে খুব ভালোবাসতো/কিন্তু এখন সে আমাকে সহ্য করতে পারে না/অন্য মেয়ের পাল্লায় পড়ে তাকে বিয়ে করে ফেলেছে/
আমি: এখন আপনার কি করার আছে?
মেয়েটি: আমার যা করার সেটা আমি করে দিয়ে এসেছি/ফাইনালি ডিভোর্স করে দিয়েছি/
আমি আর কোন কথা বাড়ালাম না,বুঝতে পারলাম মেয়েটির উপর দিয়ে যা বলছে তার স্বাভাবিক বিষয় না। কান্না করা সেটা তো অনেক কম দামের বিষয়ে। ওযে অন্য কোন কিছু করে বসে নেই সেটাই তো ভাগ্যের ব্যাপার। আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। মেয়েটিও অনেকক্ষণ বসে ছিল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল। খুব জোরে বৃষ্টি হয়েছিল। আমরা দুজন সেখান থেকে উঠে প্ল্যাটফর্ম এর ভেতরে চলে এলাম।
আমি বারবার তাকিয়ে মেয়েটিকে দেখছি। মেয়েও। দু একবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ খেয়াল করলাম মেয়েটি খুব মনোযোগ দিয়ে বৃষ্টি দেখেছে। আমি ওর চোখের বৃষ্টি দেখতে লাগলাম। বাইরের বৃষ্টিটা আমার কাছে খুব ভালো লাগছিলো না। তবে ওর চোখের বৃষ্টিতে আমি মনের অজান্তেই ভেসে যাচ্ছিলাম।
অসাধারণ সুন্দর একটি মেয়ে। মেয়েকে বলতে যা বোঝায় তার সব গুণাবলীর ওর মাঝে আছে। সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা আমাকে আকর্ষিত করেছিল তা ছিল ওর চুল। চুলগুলো কোমর অব্দি লম্বা। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল তার ভেতর কোনো কিছুর কমতি নেই। খাবার ভাবছিলাম একটু সুন্দর একটি মেয়েকে কিভাবে কোন স্বামীর অবহেলা করতে পারে। নাকি বিষয়টি অন্য কিছু।
আমি যতই ভাবছি ততই আমি ভাবনার গভীরে চলে যাচ্ছিলাম। আমি বুঝতেই পারছিলাম না আমি কোন জগতে পা রাখছি। হঠাৎ বৃষ্টি থেমে গেল। বৃষ্টি থামার পর, মেথি একফোঁটাও নড়ছে না। আমি চিন্তা করতে লাগলাম এখন কি করা যায়। আমি আবার প্রশ্ন শুরু করলাম।
আমি: এখন কি করবেন?
সে: জানিনা
আমি: কোথায় যাবেন?
সে: জানিনা
আমি তাকে শেষ প্রশ্নটা করলাম। আমি মেয়েটিকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম মেয়েটি অনেক ট্যালেন্ট। সম্ভবত খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিল। মানুষকে দেখলেই কিছুটা আন্দাজ করা যায়। আমি সাতপাঁচ না ভেবে, ভাগ্যের উপর সবকিছু ছেড়ে দিলাম। অনেক সময় অনেক সঠিক সিদ্ধান্ত মানুষের ভাগ্যকে পরিবর্তন করে দিতে পারে? আমি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আমি যে শেষ প্রশ্নটি মেয়েটিকে করলাম,
আমার সাথে যাবেন অচিনপুর?
মেয়েটি:কিছুক্ষণ ভেবে বলল/আমার সমস্যা নেই। তার কিছুক্ষণ পর আমার ট্রেন চলে আসলো। আমি তাকে চোখে ইশারা করলাম ট্রেনে ওঠার। মেয়েটি লক্ষী মেয়ের মত, আমার দিকে তাকিয়ে শুধু মাথা নাড়লো।
মেয়েটিঃ আমাকে শেষে একটি প্রশ্ন করল। আচ্ছা আপনার নাম কি?
আমি কোন কিছু না বলে শুধু হাসতে লাগলাম।কারণ আমি ভাগ্যের কাছে আগেই সবকিছু সঁপে দিয়েছিলাম। আমরা দুজনে ট্রেনে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পর ট্রেনটি ছেড়ে দিল। এটি ছিল আমার ভালবাসার প্রথম প্ল্যাটফর্ম। কিছুটা সত্যি আর কিছুটা মিথ্যে, তবুও মাঝে মাঝে মনে হয় এটি একটি রিয়েল স্টোরি।