আস্সালামু আলাইকুম কেমন আছেন বন্ধুরা? আজ আপনাদের কে একটা গল্প শুনাবো ৩ ঘন্টার পরীক্ষায় ১ ঘন্টা ৩০ মিনিটের মধ্যেই ছেলেটি হল থেকে বেরিয়ে যায়। প্রথম দিন মনে করেছিলাম ছেলেটি ছাত্র হিসেবে খারাপ তাই এত তাড়াতাড়ি হল থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু পরপর চারটি পরীক্ষায় একই ঘটনা ঘটার পর ছেলেটির সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ছেলেটি মোটেও খারাপ ছাত্র না। কারণ সে ১ ঘন্টা ৩০ মিনিটের মধ্যেই প্রায় ৮০-৯০ নাম্বার প্রশ্নের উত্তর লিখে। এই জিনিসটা আমাকে আরও বেশি উদ্বিগ্ন করেছে ছেলেটি সম্পর্কে জানার জন্য।অতঃপর খোঁজ নেওয়া শুরু করলাম এবং পরবর্তীতে জানতে পারলাম ছেলেটির নাম আরিফ। ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট পরীক্ষা দেওয়ার পর সে একটি গাড়ির গ্যারেজে কাজ করতে যায় আর সেখানে সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে তার মায়ের জন্য খাবার এবং ওষুধের ব্যবস্থা করে। শুধু তাই না ছেলেটি অনেক বেশি আত্মমর্যাদা সম্পন্ন। দরকার হলে না খেয়ে থাকবে কিন্তু তাও কারো কাছ থেকে চাইবে না।
চন্দ্রনগর উচ্চ বিদ্যালয়, এই বিদ্যালয়টি পুরো ঢাকা শহরের সবচেয়ে ভালো বিদ্যালয়। প্রতিবছর এই বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে অন্য শহর থেকে শিক্ষক আনা হয় পরীক্ষার হলে গার্ড হিসেবে থাকার জন্য। এই বছর চট্টগ্রাম থেকে আমি ডাক পেয়েছি এবং একটি অবাক করার বিষয় হলো টানা চারদিন ধরে আমার দায়িত্ব একই হলে পরছে যার ফলে আরিফের কর্মকাণ্ড গুলো আমার চোখের আড়াল হলো না। সত্যি এই যুগে এইরকম ছেলে পাওয়া অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। মায়ের প্রতি আরিফের এমন ভালোবাসা দেখে আমারও আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল কিন্তু কষ্টের বিষয় হল আমার মা অনেক আগেই আমাকে ছেড়ে এই পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। মুহুর্তের মধ্যে আবারও মন খারাপ হয়ে গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম আজকে সূর্যের তাপ অন্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি। সূর্য খাড়া মাথার উপরে আছে তাই গরম টা অনেক বেশী লাগছে। রাস্তাঘাটেও যথেষ্ট মানুষ রয়েছে তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আশেপাশে কোথাও কিছুক্ষণ জিড়িয়ে নেব। সূর্যের উত্তাপ কমলে আবারও বাসার পথে রওনা দেব কিন্তু কোথাও ভালো বসার জায়গা পেলাম না। অবশেষে একটি গাড়ির গ্যারেজে ঢুকে চেয়ারে বসতেই দেখলাম আরিফ নামক ছেলেটি গাড়ির চাকা পরিষ্কার করছে। আমাকে দেখার সাথে সাথে আমার কাছে এসে বলল,
– “আসসালামু আলাইকুম স্যার।”
– “ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
– “স্যার আপনি হঠাৎ এখানে? আপনার কি কোন গাড়ির কাজ করাতে হবে, আমাকে বলুন আমি করে দিচ্ছি।”
– “না না ওসব কিছু না আসলে বাইরে অনেক বেশি গরম তাই এখানে এসে বসলাম।”
– “তাহলে আপনি বসুন আমি আপনার জন্য ঠান্ডা নিয়ে আসছি।”
যেই আরিফ কিছু আনার জন্য বের হতে যাবে অমনি আমি তার হাত ধরে টেনে আমার পাশে বসিয়ে বললাম,
– “কিচ্ছু আনতে হবেনা আগে বল আজকের পরীক্ষা কেমন দিলে?”
– “আলহামদুলিল্লাহ স্যার অনেক ভালো হয়েছে।”
– “আমার মনে হয় তুমি আর ৩০ মিনিট বেশি পরীক্ষা দিলে ১০০ তে ১০০ নাম্বার প্রশ্নের উওর লিখতে সক্ষম হবে।”
– “সার দোকান খুলতে হয় দশটা বাজে তবে পরীক্ষার কারণে আমি সাড়ে দশটা বাজে খুলি। এখন যদি আমি এর চেয়ে বেশি দেরি করি তাহলে মালিক আমাকে দোকান থেকে বের করে দিবে।আর একবার যদি আমাকে দোকান থেকে বের করে দেয় তাহলে আমি কিভাবে আমার মায়ের জন্য খাবার ও ওষুধ জোগাড় করবো? তাই ১০:৩০ এর মধ্যে যতটুকু পারি ততটুকুই লিখেই বের হয়ে যায়।আর স্যার আমি ১০০ তে ১০০ পেলেও অতটা খুশি হবনা যত খুশি মায়ের জন্য পরিশ্রম করার ফলে হয়।প্রতিদিন মা আমার জন্য দোয়া করেন আর বলেন একদিন আমি নিশ্চয়ই সফল হব।পরীক্ষায় ১০০ নাম্বার পাওয়ার চেয়েও আমার কাছে মায়ের দোয়ার মূল্য বেশি।”
নিজের অজান্তেই চোখের কোনে জল জমে এল। মনে হচ্ছে পলকে ঝাপটা লেই স্রোতের মতো অঝোরে জল গুলো গড়িয়ে পড়বে। নিজেকে শান্ত রেখে জিজ্ঞেস করলাম,
– “তোমার বাবা কি করে?”
– “আমার মা গত তিন চার বছর ধরে অসুস্থ তাই আমার বাবা আমার মাকে ছেড়ে আরেকটা বিয়ে করে আমাদের একা রেখে বহুদূর চলে গেছে। আর তখন থেকে আমি বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে উপার্জন করি আর গত ছয় মাস হল এই গ্যারেজে কাজ করছি আর এখন আলহামদুলিল্লাহ আমরা অনেক ভালো আছি।”
আরিফের প্রত্যেকটা কথাই যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস আছে। বিশেষ করে আরিফের হাসি। আরিফের হাসি পৃথিবীর সকল দুঃখকখকে জয় করতে সক্ষম। আরিফ তার হাসির মাধ্যমে তার বুকে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য ক্ষতগুলো ঢেকে রেখছে।
– “আচ্ছা আরিফ চলো তোমাকে কিছু কিনে দেয়।”
– “স্যার কিছু মনে করবেন না কিন্তু আমি আপনার সাথে যেতে পারবো না।এখন গ্যারেজ থেকে বের হলে মালিক প্রচুর বকবে।”
বুঝতে পারলাম ছেলেটি মরে গেলেও আমার থেকে কিছু নিবে-না।অতঃপর আয়েশার জন্য যে শাড়িটি কিনেছিলাম সে শাড়িটি আরিফকে দিয়ে বললাম,
– “এই শাড়িটি তোমার মায়ের জন্য উপহার স্বরূপ দিলাম আর গুরুজন উপহার দিলে সেটা গ্রহণ করতে হয়।”
এইবার আরিফ আমার কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পরলো না।আরিফ শাড়িটি গ্রহণ করার পর আমি সেখান থেকে বেরিয়ে গেলাম এবং খানিক পরেই আমার বাসায় পৌছে গেলাম। বাসায় ঢুকতেই আয়েশা বলল,
– “জনাব আজ এত হাসি খুশি লাগছে কেন?”
– “না মানে…..
– “বুঝতে পারলাম আজকে নিশ্চয়ই কারো সাহায্য করতে পেরেছেন তাই আপনি এত খুশি। এখন তাড়াতাড়ি আমার জন্য যে শাড়িটি কিনেছেন সেটা দেখান? দেখি তো আমার স্বামী আমার জন্য কত সুন্দর শাড়ি কিনেছে?”
আমার হাতে থাকা খালি ব্যাগটি আয়েশার দিকে এগিয়ে দিলাম। খালি ব্যাগ হাতে নিয়ে আয়েশা বলল,
– “বাহ তাহলে আজকের সাহায্যটা আমার শাড়ি দিয়ে করা হয়েছে।এমনিতেও আমার কাছে অনেক শাড়ি আছে। আপনি কারো সাহায্য করতে পেরেছেন এটাই আমার জন্য অনেক বেশি।”
আমি আয়েশার কাছে নিয়ে তার হাতে হাত রেখে বললাম,
– “এমন অর্ধাঙ্গিনী যেন মহান রাব্বুল আলামিন সবাইকে দেয়।”
– “মিস্টার বাহাদুর আপনি কি জানেন না আমি ওয়ান পিস আমাকে শুধু আপনার জন্যই বানানো হয়েছে?”
আয়েশার কথা শুনে আমি হাসতে লাগলাম। সত্যি আয়েশার মত একজন অর্ধাঙ্গিনী পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। মা-বাবার পর, জীবনে প্রত্যেকটা অধ্যায়ে সেটা ভালো কিংবা খারাপ আপনার সাথে থাকা মানুষটাই হল অর্ধাঙ্গিনী।আমার প্রত্যেকটা ভালো কাজকে আয়েশা স্বাগত জানায় এবং খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকার জন্য শাসন করে। অতঃপর আরিফ নামক ছেলেটির ব্যাপারে সবকিছুই আয়েশাকে বললাম। তার সম্পর্কে বলতে বলতে কখন যে দুজনেই কেঁদে দিলাম বুঝতেই পারলাম না।আয়েশার সাথে কথা শেষ করে মনে মনে চাইলাম যেন আগামী পরীক্ষাগুলোতে আমি আরিফের হলে গার্ডের দায়িত্ব তে থাকি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেদিনই আমার থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য চট্টগ্রামে এসে যেতে হলো।যার ফলে আর আরিফের সাথে দেখা হলো না।২-৩ মাস পর ঢাকায় গিয়ে আরিফ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম সে এই গ্যারেজে আর কাজ করে না এবং সে কোথায় সেটাও কেউ জানে না।
১০ বছর পর, কিছুদিন আগে আয়েশা ও আমি সিদ্ধান্ত নিলাম একটা ছোট্ট ঘর বানাবো। অনেকেই উপদেশ দিল একটা ভালো আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ারের সাথে দেখা করার জন্য। আর লোকমুখে আরিফুজ্জামান নামক আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ারের অনেক সুনাম শুনেছি তাই আজকে তার সাথে দেখা করতে এসেছি। অতঃপর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার দুই ঘন্টা পর আরিফুজ্জামানের সাথে দেখা করার সুযোগ হলো। আমি কেবিনে ঢুকতেই আরিফুজ্জামান দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।হঠাৎ এমন একটা দৃশ্যের মুখোমুখি হব তা আমার কল্পনার বাহিরে।আমাকে জড়িয়ে ধরে আরিফুজ্জামান বলল,
– “স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন?”
– “আপনি ইঞ্জিনিয়ার আরিফুজ্জামান না!”
– “আরে স্যার অন্য মানুষদের জন্য আমি ইঞ্জিনিয়ার আরিফুজ্জামান কিন্তু আপনার জন্য তো আমি আপনার আরিফ। মনে আছে স্যার আমি গ্যারেজে কাজ করতাম। আর আপনি আমার মায়ের জন্য একটি শাড়ি উপহার দিয়েছিলেন?”
কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণের জন্য মনে হলো আমি কোন এক রূপকথার গল্প শুনছি।১০ বছরে একজন মানুষের পরিবর্তন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না কিন্তু এতটাই পরিবর্তন যে আমি তাকে চিনতে পারিনি। ১০ বছর আগে তাকে একটি গ্যারেজে দেখেছিলাম আর আজ ১০ বছর পর তাকে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের হেড হিসেবে দেখছি। আরিফ আমাকে তার পাশে বসিয়ে বলল,
– “কেমন আছেন স্যার? আর এখানে কোন কাজের জন্য এসেছেন?”
– “আলহামদুলিল্লাহ আর আমি একটি ঘরের কাজে এসেছিলাম।”
– “আপনি কোন চিন্তা করবেন না আপনার কাজ সবচেয়ে ভাল ভাবে করে দেওয়া আমার দায়িত্ব কারণ আমি আজীবন আপনার কাছে ঋণী।”
– “ঋণী! কিন্তু কেন?”
– “স্যার সেদিন আপনি আমার মায়ের জন্য শাড়ি দিয়েছিলেন আর সেই শাড়িটি দেখে মা কতটা খুশি হয়েছিলেন তা আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারবোনা। মায়ের চোখের পানি বলে দিয়েছিল যে মা কতটা খুশি হয়েছিলেন। অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার।”
– “তা এখন তোমার মা কেমন আছে?”
– “আসলে স্যার সেদিনের ঘটনার এক সপ্তাহ পরেই মা না ফেরার দেশে চলে যায়।”
মুহূর্তের মধ্যেই আরিফের হাসি খুশি চেহারাটা দুঃখে ভরে যায়।হঠাৎ এমন একটা সংবাদ শুনতে হবে সেটা আমিও কল্পনা করিনি। আরিফ আমার হাত ধরে বলল,
– “স্যার হয়তো আমার মা আজ এখানে নেই কিন্তু আমার মায়ের দোয়া সবসময় আমার সাথে আছে। অনেকেই বলে প্রত্যেকটা মানুষ সফল হওয়ার পেছনে একজন নারী থাকে।আমি গর্ব করে বলতে পারি যে আমার সফলতার পেছনে আমার মা রয়েছে। শুধু তাই না পৃথিবীর প্রত্যেকটা ছেলের সফলতার পেছনে তার মা এবং মায়ের দোয়া রয়েছে। কারণ একজন মা যদি সন্তানকে জন্ম না দেয় তাহলে সেই সন্তান কিভাবে সফল হবে?আমার সফলতার পেছনে আমার কঠোর পরিশ্রমের চেয়েও অনেক গুণে বেশি আছে আমার মায়ের দোয়া।”
আমি আর কথা বাড়ালাম না আরিফ কে বিদায় জানিয়ে তার কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলাম।বারান্দায় আয়েশার হাতে হাত রেখে চিন্তা করছি, আমার মাও সবসময় আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করতেন।আর বলতেন, আমি যেন অনেক ভালো একজন জীবনসঙ্গী পাই এবং সবসময় যেন মানুষের সাহায্য করতে পারি।আর আজকে আয়েশা হয়তো তারই প্রমাণ।সত্যি এই পৃথিবীতে সবকিছুর উর্ধ্বে রয়েছে মায়ের দোয়া।
জীবণে সফল হতে চাইলে সবার আগে মা এর দোয়া সংগ্রহ করতে হবে