আমাদের জীবন যাপনের একটি অপরিহার্য উপাদান হল মোবাইল ফোন। মোবাইল ছাড়া আমরা এক মুহূর্তও কল্পনা করতে পারিনা।আর সবার মত বর্তমান সময়ে আপনার হাতেও একটি মোবাইল ফোন থাকাটা স্বাভাবিক। তবে আপনার মোবাইল ফোনের সাথে যদি নিজেকে মানসিকভাবে জড়িয়ে ফেলেন তাহলে ব্যাপারটা আর স্বাভাবিক থাকে না। এটা এক ধরণের আসক্তি। এই আসক্তি বা রোগের নাম নোমোফোবিয়া। বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই ফোবিয়া বা ভীতি বেশি দেখতে পাওয়া যায়। ফোন না থাকার ভীতি বা নোমোফোবিয়ায় এমন অনেক কিছু ঘটে যা খুব বেশি বড় আর চোখে পড়ার মত না হলেও, একটু একটু করে মানসিক নানাবিধ সমস্যা তৈরি করে।
নোমোফোবিয়া কিঃ নোমোফোবিয়া শব্দটি এসেছে নো (NO), মো (MOBILE) এবং ফোবিয়া (PHOBIA) থেকে। যেটাকে একসাথে করলে হয় মোবাইল ফোন নেই- এমন ফোবিয়া। মোবাইল ফোন অত্যন্ত দরকারি একটি জিনিস। সেটি নষ্ট হলে বা না থাকলে মানসিকভাবে একটু চিন্তায় পড়তেই পারেন আপনি। কিন্তু তাই বলে সেটা মাত্রা ছাড়াবে এমন তো নয়। তবে কারো ক্ষেত্রে যদি ব্যাপারটি গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে, সেটাকে আর স্বাভাবিক বলা যায় না। তখন এই মানসিক সমস্যাকে নোমোফোবিয়া বলে। এটি একপ্রকার মানসিক রোগ।
কিভাবে বুঝবেন আপনি নোমোফোবিয়ায় আক্রান্তঃ
- মোবাইলের কাছ থেকে দূরে থাকলে চিন্তিত হয়ে পড়া,অস্থিরতায় ভোগা।
- আপনি খাচ্ছেন বা রাস্তায় হাঁটছেন। হঠাৎ আপনার মনে হল পকেটের ফোনটা হয়তো বেজে উঠেছে। কিন্তু ফোন হাতে নিয়ে দেখলেন,না! কেউই ফোন করেনি আপনাকে। এই যে ছোট্ট আর অতি সামান্য ঘটনাটি ঘটে গেল আপনার সাথে এটিও কিন্তু নোমোফোবিয়ারই অংশ!
- কোনো কাজে বা কারো কথায় মন না দিতে পারা। একটু পরপর ফোন হাতে নিয়ে দেখা কেউ কল দিল কিনা বা বার্তা পাঠালো কিনা।
- সেলফোন ভাইব্রেশন সিনড্রোম বা মোবাইলের কম্পন বারবার অনুভব করা।
- আপনি এমনকি ওয়াশরুমেও ফোন নিয়ে যান।
- এই লেখাটি পড়ার সময়ও আপনি অন্তত দুইবার আপনার ফোন চেক করেছেন।
- ফোন না থাকলে নিজেকে একা মনে হওয়া, হতাশ হয়ে পড়া।
- যারা নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত তারা মোবাইলের চার্জ অথবা ব্যালেন্স শেষ হতে শুরু করলেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। মনে করেন তারা কোনো একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়তে যাচ্ছেন।
- রাতে মাথার পাশে মোবাইল ফোন ছাড়া ঘুমাতে না পারা।
নোমোফোবিয়ার ক্ষতিকারক দিকঃ
- সময়ের অপচয় করে। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে মাল্টিটাস্কিং বা একই সময়ে একাধিক কাজ করা ক্ষতিকর। কারণ এভাবে তথ্য ধারণও প্রসেস করা যায় না। অনবরত ফোন চেক করলে সময়ের অপচয় হয় প্রচুর।
- পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ককেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সময় ফোন চেক করাটা নিষ্ঠুর আচরণ বলে গণ্য করা হয়। কর্মক্ষেত্রেও এই ধরনের কাজ করলে আপনাকে উদাসীন ভাবা হতে পারে।
- এটি উদ্বেগ তৈরি করে। ফোন থেকে দূরে থাকলে এই রোগে আক্রান্তরা উদ্বেগে ভোগেন। যার ফলে উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া এর ফলে মনোযোগও নষ্ট হয়। যার ফলে কর্মস্থলে উৎপাদনশীলতাও কমে আসে।
- নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত লোকেরা ত্বকের সমস্যায়ও আক্রান্ত হন। অনবরত ফোনের সংস্পর্শে থাকার ফলে ব্রণ, অ্যালার্জি এবং ডার্ক স্পট পড়তে পারে।
- ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।ফোন থেকে যে নীল আলো নিঃসরণ হয় তা মস্তিষ্কে এই সঙ্কেত দেয় যে এখন ঘুম থেকে জেগে ওঠার সময়। যা ঘুমের জন্য সহায়ক মেলাটোনিন হরমোনকে দমণ করে।
- বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত হন তারা মুখোমুখি কীভাবে একজন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে হয় তা ভুলে যান।
নোমোফোবিয়া থেকে দূরে থাকতে যা করবেনঃ
- অযথা বার বার মোবাইল চেক করা থেকে বিরত থাকুন।
- দিনের নির্দিষ্ট একটি সময় মোবাইলকে নিজের কাছ থেকে দূরে রাখুন। অন্যথায়, চোখের সামনে ফোন থাকলে বা ফেসবুক এবং অন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে বারবার নোটিফিকেশন আসলে আপনি মোবাইল ব্যবহার করতে বাধ্য হবেন।
- পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে বেশি সময় কাটান। আর যখন ফোন সঙ্গে থাকবে তার ব্যবহার সীমিত করুন।
- ঘুমানোর আগেড় ফোন বন্ধ করে রাখুন এবং বিরামহীনভাবে ঘুমান।
- অপ্রয়োজনীয় অ্যাপগুলো বন্ধ করে রাখুন। কারণ সেগুলোও মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায়।
- বই পড়ার অভ্যাস গরে তুলুন।
- খেলাধুলায় মনযোগ দিন।
মোবাইল ছাড়া চলা অসম্ভব, কিন্তু তারপরও এর ব্যবহার সীমিত রাখুন। নিজে ভালো থাকুন ও ফুরফুরে থাকুন, পরিবারকে সময় দিন।
সূত্র : ন্যাশনাল জার্নাল সায়েন্টিফিক আমেরিকা,সাইকোলজি টুডে, হিন্দুস্তান টাইমস এবং আল-জাজিরা।