সারা দিনের কাজ শেষে বিকালে ফ্রি হয়ে অনলাইনে ঢুকে নীলা। মেসেজ আর ফেসবুক নোটিফিকেশন দিয়ে মোবাইল হ্যাং করার যোগাড়। ২ মিনিট সময় দিয়ে সব নোটিফিকেশন আশা শেষ হলো। এই বার এক এক করে সব গুলো দেখছে নীলা। সব নোটিফিকেশন চেক করে কিছু মেসেজর রিপ্লাই করলো সে। এখন তেমন কেউ চেনা জানা অনলাইনে নেই।
মেসেজ বক্সে ৩ দিন আগের একজনের মেসেজ দেখতে পেলো। অনেক দিন পর সে নীলাকে মেসেজ দিয়েছে। এত দিন তারা দুইজনই কেউ কারো খোঁজ খবর নেই নি। আলিফের মেসেজ অনেক উৎসাহ নিয়ে মেসেজ চেক করতে বসলো সে।
মেসেজ দেখে সে অবাক এত গুলো মেসেজ নাহলেও ২০টি হবে, সব বড় প্যারাগ্রাফ এর মতো। তেমন কোনো কাজ নেই তাই বিছানায় আরাম করে সব মেসেজ পড়তে থাকে। মেসেজ গুলো ছিল কিছুটা এমন,
আশা করি ভালোই আছো তোমায় সম্বোধন করবার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। তার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত, তা যাই হোক। হা আজ এত দিন পরে তোমায় মেসেজ দিচ্ছি। জানি না তুমি দেখবে কি না? আর যে কারণে তোমায় মেসেজ দিলাম ,
সে কথা গুলো তোমায় জানানো প্রয়োজন কি না ? তাও জানি না। যদি সময় হয় একটু পরে দেখো ১ বার। আজ কেন জানি, হটাৎ করেই ফেসবুক আইডি টা ডিলিট করতে গিয়েও, শেষে ডিলিট বাটনটি চাপতে পারলাম না।
কিছু পুরোনো স্মৃতি নাড়া দিয়ে উঠলো।
কেউ যেন বার বার ভিতর থেকে কাজ টি করতে, দৃঢ় ভাবে বাধা দিচ্ছে আমায়। মেসেন্জারতে পুরোনো চ্যাট হিস্ট্রি দেখতে গিয়ে অনেক পরে তোমার দেয়া, শেষ মেসেজটি খুঁজে পেলাম।
স্মৃতি আরো তাজা হয়ে উঠলো। মনে আছে সেই দিন টির কথা? তিন বছর আগে, ১৪ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ। রাত ১১টা বেজে ৫১ মিনিট, আমাদের প্রথম কথা হয়ে ছিল। তার কিছু সময় আগে রিকুয়েস্ট দিয়েছিলে তুমি আর সেই দিন কথা শুরু করেছিলাম আমি। বেশ আমতা আমতা করেই মেসেজ এর মাধ্যমে আমাদের প্রথম কথা শুরু।
আমার চেনা জানা বন্ধু বান্ধবের বাইরে তুমিই প্রথম কেউ যাকে আমি চিনি না. জানি না, কখনো দেখি নি। তারপরেও বন্ধু। যাকে ফেসবুক ফ্রেন্ড বলে আর কি।
সেদিন থেকে ফেসবুক আমার কাছে জাদুকরী জ্বিন থেকে কম কিছু নয়। নাহলে যাকে চিনি না জানি না তাকে ও কত সহজে বন্ধু বলে আখ্যা দিয়ে দেয়। বেশ কিছু দিন তো এমনি কথা চলে আমাদের। ৬ মাস তোমায় না দেখেই কথা বলেছি।
আমি তোমায় দেখতে চাইনি, জীবনে প্রথম কোনো অপরিচিত কাউকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করার পরিণতি দেখবো বলে। ১ দিন হটাৎ দেখি তুমিই তুলে ধরলে তোমার আসল মুখটি। স্তব্ধ ছিলাম কিছুক্ষন এক কোথায় বলতে গেলে মায়াবী মুখটি ভোলার নয়।
সেই থেকে বন্ধুত্ব আরো গভীর হলো আমাদের। প্রায়ই ছবি আদান প্রদান চলে। তোমার দেয়া সব ছবি ই আমার কাছে গচ্ছিত হতে থাকে।
এইভাবে কেটে যায় বেশ কয় দিন। প্রথম ১টা বছর আমাদের বেশ ভালোই কাটে। কিভাবে যে আমরা এত ক্লোস হয়ে গেলাম কে জানে ? মেসেজ দেখেই বুঝে ফেলতাম কার মনের অবস্থা কেমন। তবে সময় বাড়ার সাথে সাথে আমাদের মধ্যে দুরুত্বটাও বেশ বাড়তে থাকে। শুরুটা হলো তোমায় দিয়ে শেষটা হলো আমায় দিয়ে। হটাৎ করে তোমার আমায় ইগনোর করা। মেসেজ রিপ্লাই না দেয়া।
প্রথমে ভাবলাম ব্যাস্ত আছো বুঝি। ব্যস্ততা ১ দিন ২ দিন ৩ দিন হলে বুঝতাম। কিন্তু প্রতিনিয়ত হলে সেটাকে কি বুঝায় বা কি বলে? ১ দিন আর সহ্য করতে না পেরে প্রথম তোমার সাথে আমার ঝগড়া হলো। প্রথমে তো ২ জনই রেগে ছিলাম কিন্তু পরে তুমি ক্ষমা চাইলে আমি ও তোমার কাছে ক্ষমা চাইলাম।
তারপর কিছু দিন অনেক কিছু ঘটে গেলো। চলে আসলো তোমার জন্মদিন আমার জন্মদিন। ১ জন আর ১ জনের জন্মদিন গুলোতে বেশ অনেক সময় কথা হয়েছিল প্রথম বছরটিতে।
ঈদ সহ বিভিন্ন উৎসবের শুভেচ্ছা বিনিময় তো চলতই। কিন্তু পরের বছর থেকে কেন যেন এই গুলো শুধু ফর্মালিটিতে পরিণত হলো।
জানি না কেন? শেষ ২ বছর আমাদের মধ্যে কিছুই ভালো নেই। অবহেলা শুরু করেছিলে তুমি। কিন্তু আমি সেটা টেনে টেনে এত বড় করেছি যে সেটা মনে হয় আর ঠিক করা সম্ভব নয়।
এই তিন বছরে বেশ কয়েক বার ফোনে কথা হয়েছে আর ২ বার ভিডিও কোলে কথা হয়েছে মাত্র। ফোনে আলাপের সময় আমরা সব ভুলে যেতাম যে আমাদের মধ্যে দন্ডটার কোনো মীমাংসা হয় নি। তোমায় কল করলে আমি কথা বলার সুযোগ খুব কম এ পেতাম। তুমি এ বলে যেতে আর আমি শুনতাম।
তোমার লেখা কবিতা গুলো এখনো মনে আছে আমার। হুবুহু না হলেও কিছুটা। ফোনেও এই নিয়ে বেশ কথা হতো আমাদের
ফোনে কথার সময় আমার মনেই হতো না আমাদের মধ্যে যে কত মাইলের দুরুত্ব। ২ টি ভিন্ন শহরের বাসিন্দা আমরা। এমনকি আজো দেখা করি নি। শুধু মনে হতো আমার আসে পাশেই আছো হয় তো বা।
শেষবার কথা হলো করোনা নিয়ে কি এক মহামারী সারা পৃথিবীকে কবরস্তানে পরিণত করছে। কথার শেষে তুমি মনে করিয়ে দিলে তোমার উপহারের কথা। হা তোমার মতো আমার ও মনে আছে।
২ বছর আগে একটি নীল শাড়ী ও ম্যাচিং চুরি ফেসবুকে দিয়ে বলেছিলে কেউ যদি তোমায় এমন গিফট করতো। আমি বলেছিলাম আমি দেব। আর সেই থেকেই তুমি এই কথা আমায় স্মরণ করিয়ে দাও।
এত সবের মাঝে ভুলেই গেছি। যেই করোনা নিয়ে আমাদের শেষ কথা হয়েছিল। সেই করোনাই আমার শরীরে দালানের মতো মজবুত বাসা বেঁধেছে। কিভাবে হলো জানি না। ভালইছিলাম ১ দিন জানতে পারলাম আমি পজিটিভ। কিছু দিন বাসায় এ ছিলাম আজ ৭ দিন অবস্থা বেগতিক। ডাক্তাররা বলছেন উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই। সময় আছে কি নেই জানি না।
তাই এই সকল কথা গুলো বলতে ইচ্ছা হলো। তোমার আমার এই বন্ধুত্বের মাঝে যে কিভাবে এত দূরত্ব তৈরী হলো জানি না। তবে এই সকল কিছুর জন্য আমিই দায়ী সেটা জানি।
আমি কেন জানি না খুব পোসেসিভ হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি ভুল করে চিলি প্রথম আমায় অবহেলা করে তার পর সেটা তুমি বার বার করেছো।
আমার সেটা সহ্য হয় নি তাই আমি এই বিষয়টিকে খুবই বড় ভেবে ভুলের পর ভুল করে গেছি। আমি ও কম দূর ব্যবহার করিনি তোমার সাথে।
ক্ষমা চাইবার মুখ নেই আমার। কিন্তু যদি এইটি আমার শেষ মেসেজ হয় পারলে ক্ষমা করে দিয়ো আমায়। যদি বেঁচে থাকি তোমার উপহারটা নিয়ে হাজির হবো আমাদের যেদিন প্রথম দেখা হবে। আর যদি না থাকি তাহলে সেই উপহারটি তুমি অন্য করো থেকে নিয়ো। ভালো থেকো।
ইতি
তোমার ফেসবুক ফ্রেন্ড।
মেসেজ গুলো পরে হতবম্ব হয়ে গেলো নীলা। কিছুতেই বিসসাস করতে পারছিলো না আলিফের করোনা হয়েছে। এই প্রথম বার মেসেজ না পড়ার জন্য তার ভিতরে অনেক অনুসূচনা হচ্ছে। আরো ৩ দিন আগে আলিফ এই কথা গুলো তাকে জানিয়েছে। কিন্তু সে দেখে নি।
কোনো প্রকার দেরি না করে মনে একটি অজানা আতঙ্ক নিয়ে আলিফের ফোনে কল করলো নীলা। এক বার, দুই বার, তিন বার কল করবার পরও ফোন রিসিভ করছে না আলিফ। প্রতিবার ভয়ে কেঁপে উঠছে নীলা। শেষে চতুর্থ বারের মতো ফোনটা রিসিভ করলো।
ফোনটা ধরেই বেশ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে নীলা বলে উঠে
নীলা- আলিফ কোথায় তুমি? তুমি অসুস্থ আমায় আগে জানাও নি কেন?
ফোনের ওই পাশে একটি নারী কণ্ঠ- আপনি কে বলছেন?
নীলা হতবাক –
নীলা- আমি নীলা। আপনি কে ? আলিফ কোথায় ?
নারী কণ্ঠটি বলে উঠলো- আমি হসপিটালের থেকে সিনিয়র নার্স বলছি।
নীলা উদবিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
নীলা- আলিফ কোথায় ?
নার্স বললেন
নার্স- আপনি কি আলিফের আত্মীয়?
নীলা কি বলবে বুঝছে না। নার্স আবার বললেন।
নার্স- আপনি শুনতে পাচ্ছেন? আপনি কি আলিফের আত্মীয়?
নীলা একটু নীরব হয়ে বলে
নীলা- না। আলিফ আমার বন্ধু। আলিফ কোথায় আছে বলবেন?
নার্স একটু ইতস্ত হয়ে বললেন
নার্স- আলিফ আছে। কিন্তু….
নীলা- কিন্তু কি?
নার্স আবারো ও ইতস্থ হয়ে বললো।
নার্স-আলিফের অবস্থা খুব খারাপ ছিল অনেক দিন ধরে। খুব কষ্ট করেছে সে। শেষে ১ ঘন্টা আগে মারা গেছে।
কথা গুলো শুনে যেন মাথায় বাজ পড়লো নীলার। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। নিজের অজান্তেই চোখ থেকে পানি পড়তে থাকে নীলার।
নার্স বলে উঠে
নার্স- যদি সম্ভব হয় আপনি তার বাড়ির লোকদের জানিয়ে দেবেন। আমরা কল করছি কিন্তু কেউ ধরছে না। নীলা শান্ত কণ্ঠে ঠিক আছে বলে ফোন কেটে দিলো।
নীলা নিজের ভুল বুঝতে পেরে বার বার আলিফের কাছে ক্ষমা চাইতে থাকে আর নিরব নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙ্গে পরে। এর থেকে বেশি আর কিছুই করার নেই তার।
যদি ৩দিন আগেই সে মেসেজ গুলো দেখতো। তাহলে সে হয়তো আলিফকে শেষবারের মতো শুনতে পেত। জানা অজানায় কি ভুলটাই না করেছে নীলা।
নিজের ভিতর অনুসূচনা বোধ নিয়ে আজীবন বাঁচতে হবে তাকে আর সাথে থাকবে আলিফের দেয়া সেই লাস্ট মেসেজ।