আসসালামু আলাইকুম। প্রিয় পাঠকবৃন্দ, আশা করি সবাই ভালো আছেন। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় আমিও ভালো আছি। আজকে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করব মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক জরুরী করনীয় বিষয়গুলো, শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় মা যা খাবেন না । আশা করি আর্টিকেলটি থেকে আপনারা মা ও শিশুর স্বাস্থ্য বিষয়ক জরুরি বিষয় গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
শিশুরা মহান সৃষ্টিকর্তার অপরিসীম সুন্দর উপহার। একটা সুস্থ, সবল, সুন্দর বাচ্চার চেয়ে অসাধারন কিছু আর এই পৃথিবীতে হতে পারে না। প্রায় ৯ মাস মাতৃগর্ভে থাকার পর একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে। গর্ভাবস্থায় মায়ের স্বাস্থ্যের ও যত্নের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে জন্মগ্রহণকারী শিশুর স্বাস্থ্য, শারিরীক ও মানসিক বিকাশ। তাই গর্ভাবস্থায় ও প্রসব পরবর্তিকালিন অবস্থায় মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের প্রতি অত্যান্ত সচেতন থাকতে হবে। এসময় কি কি করনীয় ও কোন কোন বিষয় মা ও শিশুর স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক।
একটা শিশুর কাছে তার মায়ের কোলই সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। মায়ের কাছ থেকেই শিশু তার প্রাথমিক শারিরীক ও মানসিক বিকাশপ্রাপ্ত হয়। মা ও শিশু যেন ভালবাসার মোড়কে জড়ানো স্বর্গীয় একটি সম্পর্ক । মহামতি নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এজন্যই বলেছেন “আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও আমি একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।“ শিশু ও মায়ের স্বাস্থ্যের যত্ন ও নিরাপত্তা সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই আসুন পাঠক জেনে নেই মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের যত্ন ও নিরাপত্তার জন্য আমাদের করনীয় বিষয়গুলি কি কি।
গর্ভাবস্থায় মায়ের স্বাস্থ্যের প্রতি করনীয়
একজন সুস্থ্য মায়ের পক্ষেই একটি সুস্থ্য বাচ্চা জন্ম দেয়া সম্ভব। গর্ভবতী মাকে তাই সবসময় প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার ও ডাক্তার/স্বাস্থ্যকর্মীর সার্বক্ষনিক তত্ত্বাবধান এ থাকতে হবে। সন্তান প্রসবের দিনটিকে আমরা জন্মদিন বললেও প্রকৃতপক্ষে তার আসল জন্মদিন হল যেদিন সে মাতৃগর্ভে আসে। তাই পৃথিবীর আলো বাতাসে ভূমিষ্ঠ হবার আগেই পরোক্ষভাবে তার যত্ন নিতে হয়। একদম সহজ সরল ভাবে বলতে গেলে গর্ভবতী মায়ের সঠিক যত্ন ও পরিচর্যা করলেই গর্ভস্থ সন্তানেরও সঠিক যত্ন ও পরিচর্যা হয়ে যাবে।
মায়ের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উপর গর্ভস্থ সন্তানের স্বাস্থ্য নির্ভর করে। এসময়ে অপর্যাপ্ত খাদ্য ও অপুষ্টি মা ও শিশুর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। অপুষ্টিতে আক্রান্ত মায়েরা যে সন্তানের জন্মদেয় তাদের ওজন কম হয়, বুদ্ধির বিকাশ ব্যহত হয় ও স্বাস্থ্য ভাল হয় না। গর্ভাবস্থায় মা তার শরীর থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে তার গর্ভস্থ শিশুকে যথাযথ ভাবে বড় করে তোলে। এজন্য গর্ভকালীন অবস্থায় মাকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খাবার খেতে হবে।
গর্ভকালীন মায়ের সেবা
গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন তিনবেলা খাবার এর সঙ্গে নিয়মিত কমপক্ষে একমুঠো বেশি খাবার খেতে হবে। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, কলিজা, ঘন ডাল, গাঢ় সবুজ শাক সবজি ও মৌসুমী দেশি ফল খেতে হবে। গর্ভাবস্থা নিশ্চিত হবার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসক এর শরণাপন্ন হতে হবে। গর্ভাবস্থায় ভিটামিন সি যুক্ত খাবার বেশী করে খেতে হবে। গর্ভাবস্থায় যথেষ্ট পরিমাণ বিশ্রাম নিতে হবে। গর্ভবতী মায়ের জন্য শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি অত্যাবশ্যক। এতে গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি স্বাভাবিক হবে। ভারী কাজ ও কস্টকর পরিশ্রম বর্জন করতে হবে। আয়োডিনযুক্ত লবণ খেতে হবে ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
গর্ভকালীন মায়ের যত্ন
গর্ভধারনের পরপরই একজন গর্ভবতী মহিলার গর্ভকালীন যত্নের জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হবে বা ডাক্তারের শরনাপন্ন হতে হবে। গর্ভাবস্থায় অন্তত চারবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। গর্ভাবস্থায় ৫ মাস পর ২টি টিটি টিকা দিতে হবে। শিডিউল অনুযায়ী বাকি টিকাগুলোও দিয়ে নিতে হবে।
অল্পবয়সে গর্ভধারন করলে, ঘন ঘন সন্তান ধারন করলে, গর্ভাবস্থায় কম খাদ্য গ্রহণ ও সুষম খাদ্য গ্রহণ না করলে, গর্ভকালীন রক্তস্বল্পতায় ভুগলে, বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ ও কৃমিতে আক্রান্ত হলে, শারিরীক পরিশ্রম বেশী করলে ও মানসিক উদ্বেগ এ থাকলে গর্ভাবস্থায় ওজন বৃদ্ধি পায় না। তাই এসব বিষয়ে সদা সতর্ক থাকতে হবে। একজন গর্ভবতী নারীর যেকোন সময় যেকোন বিপদ দেখা দিতে পারে। পরিবারের সবার গর্ভকালীন পাঁচট বিপদচিহ্ন সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে এবং যেকোন একটি দেখা দেয়া মাত্র তাকে স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সেগুলো হলঃ রক্তক্ষরণ, প্রচন্ড জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা এবং চোখে ঝাপসা দেখা, খিঁচুনি ও অনেকক্ষণ ধরে প্রসব যন্ত্রণা।
প্রসব পরবর্তী যত্ন ও পরিচর্যা
গর্ভকালীন যত্ন ও পরিচর্যা সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি কিন্তু গর্ভ বা প্রসব পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে আমরা অনেক সময়ই অবহেলা করে থাকি। সন্তান জন্মদানের পর বিভিন্ন কারনে মা ও শিশুর শরীর দূর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। এসময় সঠিক যত্ন নিলে এবং কিছু নিয়ম মেনে চললে অনেক ধরনের জটিলতা এড়িয়ে চলা সম্ভব। প্রসবের পর সঠিক যত্ন ও পরিচর্যা নিলে মা ও শিশুর শরীর তাড়াতাড়ি সুস্থ ও সবল হয়ে উঠে।
প্রসব পরবর্তী করনীয়
মায়ের ক্ষেত্রেঃ
গর্ভধারনে মায়ের শরীরে ক্ষয় হয়। এই ক্ষয়পূরণ করার জন্য মাকে বেশি বেশি সুষম খাবার খেতে হবে। মা যদি সঠিক পরিমাণে সুষম খাবার খায় তবে শিশুর জন্যও পর্যাপ্ত পরিমানে পুষ্টিকর দুধ উৎপন্ন হবে। মাকে সবসময় পর্যাপ্ত বিশ্রামের দিকে খেয়াল রাখতে হবে, নানা ধরনের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে নিয়মিত গোসল ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মাকে নির্দিষ্ট পরিমানে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল ও আয়রন ট্যাবলেট খেতে হবে। প্রসবের পর দম্পতির জন্য পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। বিভিন্ন জটিলতা এড়াতে পরিবারের সকল সদস্যকে প্রসব পরবর্তী মায়ের সেবা সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হবে ও সচেতন থাকতে হবে।
শিশুর ক্ষেত্রে
প্রসবের পর কোন অবস্থাতেই শিশুকে মাটিতে রাখা যাবে না। কোলে নিতে হবে। পরিষ্কার কাপড় দিয়ে শিশুর মুখের ভিতর, মুখমন্ডল ও সমস্ত শরীর জড়িয়ে নিতে হবে। জন্মের পরপরই গর্ভফুল পড়ার অপেক্ষা না করে শিশুকে শালদুধ সহ মায়ের দুধ খাওয়ানো শুরু করতে হবে। জন্মের সাথে সাথে শিশু স্তন চোষা শুরু করলে মায়ের দুধ ঠিকমত আসবে। এছাড়া প্রসবের সাথে সাথে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ালে মায়ের ফুল পড়তে এবং রক্তস্রাব দ্রুত বন্ধ হতে সাহায্য করবে।
নাড়ী কাটার জন্য প্রথমে নবজাতকের পেট থেকে যথাক্রমে দুই আঙ্গুল, আধ আঙ্গুল ও এক আঙ্গুল ব্যবধানে জীবাণুমুক্ত সূতা দিয়ে পরপর তিনটি বাঁধন দিতে হবে। এরপর পরিস্কার জীবাণুমুক্ত ব্লেড দিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বাঁধনের মাঝ বরাবর কেটে দিতে হবে। শিশুর ওজন যথাযথ হয়েছে কিনা তা দেখতে জন্মের পরপরই ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তার ওজন নিতে হবে। বিসিজি এবং ইপিআই এর ৮টি রোগের টিকা জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে দিতে হবে।
শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় মা যা খাবেন না
জন্মের পর মায়েরা যখন শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান তখন শিশুর সুরক্ষার জন্য তাদের কিছু খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। বুকের দুধ খাওয়ানোর অন্তত তিন মাস এই খাবার গুলো এড়িয়ে চলতে হবে যে খাবারগুলো নবজাতকের জন্য বিপদজনক হতে পারে। শূন্য থেকে ছয় মাস অবধি একটি শিশুকে সম্পূর্ন মায়ের বুকের দুধের উপরই নির্ভরশীল থাকতে হয় এবং শিশু তার সমস্ত পুষ্টি উপাদান মায়ের এই বুকের দুধ থেকেই পেয়ে থাকে। এজন্য মায়েদের খুব সাবধানতার সাথে তাদের খাদ্যতালিকা নির্বাচন করতে হয়।
শিশু যেমন পুষ্টিকর উপাদান মায়ের বুকের দুধ থেকে পেয়ে থাকে তেমনি তার স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এমনসব উপাদানও তার শরীরে প্রবেশ করে মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমে। কফি, চা এবং চকলেট জাতীয় খাবার, শুটকি মাছ, চিংড়ি জাতীয় এলার্জি উদ্রেককারী মাছ, পুদিনা পাতা, ধনে পাতা এই জাতীয় শাক, ঝাল, তৈলাক্ত ও মশলা সমৃদ্ধ খাবার, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মটরশুটি, মূলা ইত্যাদি যেসব খাবার খেলে গ্যাস হয় এমন সব খাবার নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় এড়িয়ে চলতে হবে। এসব খাবার এড়িয়ে চলেও যদি শিশুর কোন সমস্যা হয়ে থাকে তবে অবশ্যই অতি দ্রুত অভিজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
প্রসব পরবর্তী বিপদ বা খারাপ লক্ষণ
• ডেলিভারীর পরপর রক্ত পড়া যেটা কমার পরিবর্তে বাড়ে অথবা বড় কোন রক্তের টুকরা যাওয়া
• যোনীপথে দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব বা তরল বের হওয়া
• খিঁচুনী বা অজ্ঞান হওয়া
• তলপেটে প্রচন্ড ব্যথা হওয়া
• স্তনে ব্যথা, ফোলা অথবা লাল হয়ে যাওয়া
চিকিৎসা বা সহায়তা প্রাপ্তির স্থানসমূহ
• পরিবার কল্যাণ সহকারি
• ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র
• উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
• মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র
• জেলা হাসপাতাল
• সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
সূত্রঃ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় ওয়েবসাইট।
পোস্টটি কেমন লাগলো দয়া করে কমেন্টে জানাবেন, যদি ভাল লেগে থাকে তাহলে অবশ্যয় শেয়ার করবেন, পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। এমন সব দারুন দারুন পোস্ট পেতে Grathor এর সাথেই থাকুন এবং গ্রাথোর ফেসবুক পেইজ ও ফেসবুক গ্রুপ এ যুক্ত থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।