স্বপ্ন সকল মানুষের অধিকার। স্বপ্ন আমাদের নতুন করে বাঁচতে শেখায়। স্বপ্নের সীমা নির্ধারণ করাটা খুব কঠিন। স্বপ্নের কি আদৌ কোনো সীমা আছে? তা হয়তো নেই কিন্তু জীবনের কোনো না কোনো সময় এমন এক অবস্থানে নিজেকে আবিষ্কার করতে হয় যখন মনে হয় স্বপ্ন দেখাটা হয়তো বড় কোনো ভুল ছিল। মনের কোণে কিছু আশা, কিছু স্বপ্ন পাখা ঝাপটাতে শুরু করলেই হুট করে তাকে হয় শিকার করা হয় নয়তো শখের বশে গুলি ছোরা হয়।
আমি বেলি। এবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি। ছোট থেকেই বুয়েটের একজন সদস্য হওয়ার ভীষণ শখ ছিল আমার। স্বপ্নকে বাস্তবিক রূপ দেয়ার জন্য ভীষণ কষ্ট করতে হয়েছে আমাকে। আমাদের বংশে আমিই প্রথম বিজ্ঞান শাখার ছাত্রী। আমাকে ঘিরে আমার বাবা–মায়ের অনেক স্বপ্ন। স্কুলে পড়াকালীন বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যখন কোনো প্রশ্ন করে উঠতাম তখনই আমার সকল উৎসাহকে দমিয়ে দিতেন ম্যাডাম যাকে আমরা আপু বলে ডাকি। আপুর সাথে বন্ধন মজবুত করার জন্য আমার স্বপ্নের কথা নির্দ্ধিধায় বলতাম কিন্তু কে জানতো যে একদিন এই স্বপ্নের কথা নিয়ে আমাকে হাসির পাত্র বানাবে! পৃথিবীটা সত্যি অদ্ভুত। এর পর থেকে পদার্থবিজ্ঞান কারো কাছে পড়ার সাহস আমার হয়নি। এই যুগের ইন্টারনেটকে কাজে লাগিয়ে যতটুকু সম্ভব ততটুকু জ্ঞান অর্জন করার চেষ্টা করেছি।
জানিনা কেন এই বিজ্ঞানের জন্য আমাকে এত ধাক্কা খেতে হয়েছে। আজ সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিন। এতো বছরের সাধনার ফল আজ পেতে চলেছি। কেন যেন ভয় মনকে গ্রাস করে নিচ্ছে। হঠাৎ করেই মোবাইল বেজে উঠল। রূপার কল। কেন যেন কলটা উঠাতে মন বাধা দিচ্ছে। মনের বিরুদ্ধে গিয়েই কল উঠাতে হলো। মোবাইলের ওপাশে যেই কথাগুলো হলো সেকথাগুলো শুনতে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।এতগুলো বছরের কষ্ট–ত্যাগ সব বিফলে যাবে! কখনো ভাবিনি যে এমন দিন আমায় দেখতে হবে। মা কিছুক্ষণ পর যখন এসে জিজ্ঞেস করবে রেজাল্টের ব্যাপারে তখন কি বলবো! নানান রকমের চিন্তা মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগলো। অগোচরে দুফোঁটা চোখের জল পড়ে গেল।
রাত প্রায় ১১টা বাজে। ঘুম আসছে না কোনোভাবেই। ভেতরটা নিরবতায় থমকে আছে। মনটাকে শান্ত করার অভিপ্রায়ে ছাদে যাওয়া দরকার। আমাদের বাসার ছাদটা খুবই সুন্দর। সিঁড়ির পাশে ছোট ছোট গাছের সারি ছাদ অবদি উঠেছে। রাতের তারাভরা আকাশে রূপালি চাঁদ যেন বিষন্ন হয়ে ধরণীকে দেখছে। হালকা শীতল বাতাস যেন মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। ছাদের কোণার বেঞ্চে বসতেই করুণ সব স্মৃতিগুলো মনে পড়তে লাগল। ছোট থেকেই যেকোনো কথায় আমাকে জানানো হতো যে আমাকে সকল প্রচেষ্ঠায় বুয়েটে ভর্তি হতে হবে। আজ সব আত্মীয়দের কথা শুনে মনে হলো আমার জীবনটা বৃথা। তাদের ভাষ্যমতে আমি বুয়েটে সুযোগ পাওয়ার যোগ্য ছিলাম না অমনোযোগি হওয়ার দায়ে।
এত বড় অপবাদ আমার ঘাড়ে যে কোনো একদিন আসবে তা আমি কল্পনাও করি নি। স্বপ্ন বাস্তবায়নে কতমাস, কত বছর যে কষ্ট করেছি তা কেবল আমি, আমার মা ও আমার ভাই জানে। মানুষ কেবল কথা শোনাতেই জানে কিন্তু যাকে নিয়ে কথাগুলো বলছে তার ব্যাপারে ভালো করে জানতেও চায় না। একটিবারও চিন্তা করে না যে কথাগুলো কত গভীরভাবে একজনের মনেদাগ কেটে দেয়। মানুষ আসলে জানে না যে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতের মধ্যে পার্থক্য নেই যেখানে মানসিক ক্ষতের প্রভাবটা সারাজীবনের জন্য থেকে যায়। কত নির্ঘুম রাত কেটেছে পড়তে পড়তে, কত শখ পড়ে ছিল মনের অগোচরে শুধু এই স্বপ্নকে বাস্তবিক একটা রূপ দেয়ার জন্য। কিন্তু সবসময় স্বপ্ন সত্যি হয় না। স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে যেন এক মজবুদ দেয়াল দাঁড়িয়ে রয়েছে।ভালো পরীক্ষা দেয়ার পরও যদি স্বপ্নের দারে পৌঁছতে না পারি সেখানে তো আমার কোনো দোষ নেই। এখান থেকে তো এই সিদ্ধান্তে আসা ঠিক নয় যে পরিশ্রম আমার কম ছিল। জীবনটা যেন এক অগ্নিপরীক্ষা! মনের অবস্থা নিতান্তই করুণ। মাথায় শুধু মানুষের ধিক্কার আর ঘৃণার শব্দ বেজে উঠছে।
বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই আমার। চোখ দুটো পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে আসছে। পা ঘামছে। ধিরে ধিরে ছাদের পাশে অগ্রসর হচ্ছি। এইপাশ থেকে শহরটাকে কত সুন্দর দেখায়! এই পরিস্থিতির সামনে না আসলে হয়তো কখনো এই দৃশ্য দেখতেই পেতাম না। দেখবোই বা কি করে, সারাদিন বাসায় বসে হুমড়ি খেয়ে পড়তাম বইয়ের পাতায়। পা এগিয়ে দিলেই নিচে রাতের ঠান্ডা বাতাস স্পর্শ করে শিরশির করে ওঠে। ভেতরটা কেঁপে ওঠে এক অজানা অনিশ্চিত ভয়ে। কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? কিন্তু এই পথ না বেছেই বা করবো কি? জীবনের কোনো পর্যায়ই কখনো মর্যাদা বা প্রশংসনীয় কিছু পাইনি। জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করে এসেছি।আমাদের এই ছাত্রসমাজকে মানুষ কখনো বুঝে উঠতে পারেনি। যেদিন এই শিক্ষাব্যবস্থার নির্মম নিয়মে প্রথম পা রেখেছিলাম ঠিক সেদিন থেকেই আমাদের দেখানো হয়েছিল ভয় আর শেখানো হয়েছিল প্রতিযোগিতা। শেখানো হয়নি সহমর্মিতা, সহযোগিতা, বন্ধুত্ব।জীবনে কত কিছু যে হারিয়েছি তা হয়তো বলে বোঝানো সম্ভব না। কত বন্ধন যে ছুটে গেছে, কত স্মৃতি যে আটকে আছে খাঁচায়! এখন এসব ভেবেই বা কি লাভ? চোখ দিয়ে অঝোরে বয়ে যাচ্ছে অশ্রুজল। ভেতরে বেজে উঠছে অড সিগনেচারের গান:
“দেহ পাশে কেহ কেঁদো না,
গল্পগুলো রেখো অজানা,
গানখানা থেকে খুঁজে নিও মোর সে গল্প।
যাতে লিখা হাজার কষ্ট,
নিজেকে ভেবে নিতাম এক শ্রেষ্ঠ,
যার প্রতিপদে জীবন বিচ্ছেদের স্বপ্ন।”