আমরা যারা বাঙালী তারা অ্যাবরশন বলতে যা বুঝি তাহলো,
গর্ভের সন্তান নষ্ট করা ।
আমাদের দেশে অ্যাবরশন খুব অল্প সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে ।
আজকে আমরা অ্যাবরশনের আদ্যোপান্ত সব জানবো ।
প্রথমেই চলুন জানি যে উইকিপিডিয়া আমাদের অ্যাবরশন সম্পর্কে
কি জানায়-
Abortion is the termination of a pregnancy by removal or expulsion of an embryo or fetus.
ইংরেজিতে বুঝতে সমস্যা হচ্ছে,চলুন ঐ কথাটাই বাঙলায় বলা যাক-
যে পদ্ধতির মাধ্যমে ভ্রণ নষ্ট করে পেটের মধ্যের সন্তান অর্থাৎ গর্ভপাতকে থামিয়ে দেওয়া হয় সেটাকেই বলে অ্যাবরশন ।
এবার প্রশ্ন হলো ভ্রুণ কি ?
ভ্রূণ একটি বহুকোষী জীবের বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়। সাধারণভাবে,যে জীবগুলি যৌন সঙ্গমের মাধ্যমে প্রজনন করে তাদের ক্ষেত্রে ভ্রুণ গঠিত হতে দেখা যায় । ভ্রূণের বিকাশ জীবনচক্রের একটি অংশ যা নিষিক্তকরণের ঠিক পরে শুরু হয় এবং টিস্যু এবং অঙ্গের মতো শরীরের কাঠামো গঠনের মাধ্যমে অব্যাহত থাকে। (উইকিপিডিয়া ) ।
এই ছবিটি ভাল করে দেখুন । ছবির এই ভ্রুণর বয়স ৬-৭ সপ্তাহ । ছবিটা উইকিপিডিয়া থেকেই এনেছি ।
এই ভ্রণ যে পদ্ধতির মাধ্যমে নষ্ট করে দেওয়া হয় তাকেই বলে অ্যাবরশন ।
তাহলে অ্যাবরশন সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হলো তো ?
চলুন এবার অন্য আলোচনায় পৌাছানো যাকঃ-
অ্যাবরশন কারা করে এবং কেন করে ?
অ্যাবরশন মূলত বিবাহিত দাম্পত্যিরাই করে থাকে ।
কিন্তু অল্প বয়সী অবিবাহিত প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে অ্যাবরশন খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে ।
যদিও এখনকার প্রজন্ম খুব সচেতন,
তারা এতো বেশি সচেতন যে ফার্মেসীতে ঝুলে থাকা কনডম তারা বিবাহিতদের থেকে বেশি কিনে থাকে ।
আবার অনেক ছেলে মেয়ের ভরসা জন্মবিরতি পিল যা সঙ্গমের ৪৮ অথবা ৭২ ঘন্টার মধ্যে সেবন করলে
ভ্রুণ সৃষ্টির ভয় থাকেনা ।
কিন্তু এতো সতর্কতাও অনেক সময় কোনো কাজে আসেনা অথবা যারা অসেচতন বা অধিক পাকা তাদের জন্য অ্যাবরশন হচ্ছে একমাত্র ভরসা।
অ্যাবরশন বিবাহিতদের মধ্যেও খুব জনপ্রিয় বিশেষ করে অল্পবয়সী,চাকুরিজীবি দম্পত্যিদের জন্য ।
তবে বিবাহিতদের থেকে বর্তমান সময়ে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে এটা খুব জনপ্রিয় ।
ছোটবেলায় বিটিভিতে “মেরি স্টোপ” ক্লিনিকের বিজ্ঞাপন দেখে কিছু না বুঝলেও বড় হয়ে ঠিকই বুঝেছি যে
মেরি স্টোপস ক্লিনিক এখনো কেন এতো জনপ্রিয় ।
যাহোক,
এবার আসি এই আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে;সেটা হলো অ্যাবরশনের ক্ষতিকর দিক ।
অ্যবারশন একজন নারীকে সাময়িক প্রশান্তি দিলেও তা বেশিরভাগ সময় দীর্ঘকালীন ক্ষতির কারণ হতে পারে ।
চলুন প্রথমেই এটা জানি যে অ্যাবরশনের এর সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো,অ্যাবরশনের পর বেশিরভাগ নারীই এই সমস্যাগুলোর সম্মূখীন হয় যা এক সপ্তাহ বা দীর্ঘকালীন সময় ধরে একজন নারীকে কষ্ট দেয়-
Ø রক্তপাত । অ্যাবরশনের পর রক্তপাতের মতো কষ্টদায়ক সমস্যার সম্মূখীন হতে হয় নারীকে যা এক বা তিন সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে;
Ø ক্র্যাম্পিং অর্থাং জরায়ুতে প্রচন্ড ব্যথা হয়;
Ø প্রচন্ড মাথা ঘুরা;
Ø সবসময় ঘুমঘুম ভাব;
Ø বমি বমি ভাব অথবা বমি ।
অ্যাবরশনের তাৎক্ষণিক জটিলতা যা কিনা আরো বিস্তৃত ও ভয়াভহ ।যথা-
Ø গর্ভ বা জরায়ুর ক্ষতি হয়;
Ø অতিরিক্ত রক্তপাত হয়;
Ø যদি অ্যাবরশনের সময় কোনো ত্রুটি থেকে থাকে তাহলে পরবর্তীতে আবার অপারেশেন করা লাগে ।
Ø জরায়ুর ফ্যালোপিয়ানে(নালী) সংক্রমণ হতে পারে;
Ø জরায়ুর ভিতের দাগ পড়ে যায়;
Ø শরীরকে ভয়াভহ নিম্ন রক্তচাপের দিকে নিয়ে যায় যাকে মেডিকেলের ভাষায় বলে সেপসিস বা সেপটিক শক;
Ø জরায়ু ছিদ্র হয়ে যাওয়ার সঙ্কা থাকে!;
Ø এমনকি এটি করার সময় বা পরবর্তীতে মৃত্যুও ঘটতে পারে ।
কি ভয়ংকর এই অ্যাবরশন জিনিসটা তাইনা ?
এতো শুধু অ্যাবরশনের পর এবং পরবর্তী কিছুদিনের ক্ষতির কথা বললাম ।
কিন্তু ভবিষ্যত ক্ষতির কথা তো এখনো বললাম না ।
অ্যাবরশনের ভবিষ্যত ক্ষতি বর্তমানের থেকেও আরো ভয়ংকর ।
চলুন জানা যাক কিভাকে অ্যাবরশন একজন নারীর ভবিষ্যত তিলে তিলে নষ্ট করে দেয়-
§ অকাল প্রসব (প্রি-টার্ম ডেলিভারি):
অ্যাবরশন জরায়ুকে দূর্বল করে দেয়, যা কিনা একজন নারীকে ভবিষ্যতে অকাল প্রসব বা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই প্রসবের মতো ভয়াভয় অভিজ্ঞতার সম্মূখীন করে ।একবার অ্যাবরশন করলে প্রি টার্ম ডেলিভারি বা অকাল প্রসব/গর্ভপাতের ঝুঁকি ২৫-২৭% বৃদ্ধি পায় ।
কিন্তু বর্তমান সময়ে অ্যাবরশনের হার বেড়ে গেছে এবং একের অধিক অ্যাবরশন দ্রুত গর্ভপাতের ঝুঁকি ৫১-৬২% বৃদ্ধি পায় !
শুধু নারীর জন্যই নয়,অ্যাবরশনের ফলে অকাল গর্ভপাতের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুর মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে ।অধিকাংশের থাকে মৃত্যু ঝুঁকি;যারা বেঁচে থাকে তারাও স্বাভাবিক হয়না,তাদের সেরিব্রাল পলসি (স্নায়ুবিক ভারসম্যহীনতা),বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতা,মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের ব্যাধি এবং অটিজম সহ গুরুতর অক্ষমতার সম্ভাবনা বা ঝুঁকি থাকে প্রকটভাবে ।
§ ব্রেস্ট ক্যান্সার (স্তন ক্যান্সার):
গবেষণায় দেখা গেছে যে গর্ভপাত একজন মহিলার স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় ।
২০১৩ সালের একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে,
যারা মোটামুটি একটি অ্যাবরশন করিয়েছে তাদেরও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪% !কিন্তু যারা একের অধিক অ্যাবরশন করায় তাদের ক্ষেত্রে এ ঝুঁকি আরো বেশি,প্রায় ৭৬-৮৯% !
§ যৌন বাহিত রোগ এবং প্রজজন অঙ্গের সংক্রমণ:
অ্যাবরশনের সময় জরায়ুর মধ্যে ক্ল্যামিডিয়া (যৌনবাহিত রোগের ব্যাকটেরিয়া) থাকার ফলে অ্যাবরশনের পর যৌনাঙ্গ তার সংক্রমণ বৃদ্ধির ঝুঁকি থাকে যাকে প্রজজন অঙ্গের সংক্রমণ বা পিআইডি বলা হয় ।এবং আশঙ্কার কথা হচ্ছে অ্যাবরশনের ফলে ক্ল্যামিডিয়া সংক্রমণ আছে এমন রোগিদের মধ্যে ২৩% ই মাত্র ৪ সপ্তাহের মধ্যে পিআইডিতে সংক্রমিত হয় । পিআইডি সংক্রমিত হলে নারীদের খুব মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে হয় । পিআইডিতে আক্রান্ত রোগিদের বন্ধ্যাত্ব,একটোপিক গর্ভাবস্থা বা গর্ভের বাইরে অন্যকোথাও গর্ভাবস্থা এর মতো মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় ।
§ মানসিক স্বাস্থ্য:
গবেষণার ফলাফলে যেটা জানা যায় তা হলো,অ্যাবরশন করানো নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ার মারাত্মক ঝুঁকি থাকে ।যারা অ্যাবরশন করে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রায় ৮১% বৃদ্ধি পায় ! এবং সারা পৃথিবীতে মানসিক সমস্যার দশ ভাগ দখল করে আছে অ্যাবরশন ! অ্যাবরশনের ফলে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের (পিটিএসডি) ঝুঁকি বাড়ে ।মানসিক অবসাদ ও প্যানিক অ্যাটাক ছাড়া এই পিটিএসডির একজন নারীকে আত্মহত্যার দিকে প্ররোচিতও করতে পারে !
পিটিএসডির যেসব গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি আছে সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:-
Ø অনুশোচনা;
Ø শোক;
Ø দুঃখ/বিষণ্ণতা;
Ø উদ্বেগ;
Ø অপরাধবোধ/লজ্জা এবং সর্বশেষ
Ø আত্মহত্যার চিন্তা !
যদি কেউ অ্যাবরশন করানোর পর ভবিষ্যতে উপরোক্ত সমস্যার সম্মূখীন হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই উপেক্ষা না করে মানসিক ডাক্তার দেখাবেন ।
§ বন্ধ্যাত্ব এবং ভবিষ্যতে সন্তান ধারণ:
অ্যাবরশনের পর সৃষ্ট নানারকম জটিলতা,যেমন-প্রজনন অঙ্গের সংক্রমণ এবং জরায়ুর ক্ষতি এবং বন্ধ্যাত্ব এবং ভবিষ্যতে সন্তান ধারণের নানারকম ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় ।
§ গর্ভপাত এবং যৌন অক্ষমতা:
অ্যাবরশনের পরে কিছু নারী যৌন অক্ষমতা অনুভব করেন !
অ্যাবরশনের পর এ সংক্রান্ত নিম্নোক্ত সমস্যাগুলি হতে পারে-
Ø যৌনাঙ্গে শুষ্কতা বৃদ্ধি পায়;
Ø যৌন আকাঙ্ক্ষা হ্রাস পায়;
Ø প্রচণ্ড উত্তেজনা ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং
Ø ডিসপেয়ারনিয়া বা বেদনাদায়ক সহবাসে ভুগতে হয় !
আর যদি অ্যাবরশনের পর কেউ এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েই পড়েন তাহলে অবশ্যই তাকে ডাক্তার দেখাতে হবে নয়তো জীবনকে দুঃখ-কষ্ট গ্রাস করে নিবে ।
এই ছিল এই আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ । আমাদের দেশে অ্যাবরশনের ব্যাপারে এখনো ব্যাপক অসচেতনতা এবং নারীর স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে ।অপরদিকে উন্নত বিশ্বে বিশেষ করে আমেরিকা এবং ইউরোপে অ্যাবরশনে নারাীর ঝুঁকি কমাতে অনেক দূর এগিয়েছে ।তবুও অ্যাবরশন এমন একটা ব্যাপার যার ঝুঁকি কখনোই পরিপূর্ণভাবে কমানো সম্ভব না এবং যতো যা-ই করা হোক না কেন তথ্য-প্রযুক্তি মানুষকে অনেক উপকার করলেও মানুষের দেহের গঠনে সে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসহায় । তবুও এই অ্যাবরশন নিয়ে সারাবিশ্বে ব্যাপক গবেষণা প্রতিনিয়তই করা হচ্ছে ।
সত্যি বলতে অ্যাবরশন এমন একটা জিনিস যা কোনোভাবেই নারীর জন্য মঙ্গল বয়ে আনেনা,বিশেষ করে আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে অ্যাবরশন নারীদের জীবনে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট বয়ে আনতে পারে । আমার মনে হয় অল্পবয়সী মেয়েদের এ ব্যাপারে আরো বেশি সচেতন হতে হবে ।নিজেদের ব্যাপারে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে ।
সাধারণ অল্পবয়সী মেয়েরা আবেগের বশে নানারকম যৌন ক্রিয়াকলাপে যুক্ত হয়ে উঠতি বয়তে নানারকম জটিলতার সম্মূখীন হয়,অনেক সময় অ্যাবরেশনের মতো জঘন্য জিনিসের মুখোমুখি হতে হয়;যা একটা নারীর বর্তমান ও ভবিষ্যতকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দেয় ! আবার অনেক বিবাহিত নারী জেনে হোক বা না জেনে হোক অ্যাবরশন করিয়ে জীবনকে নষ্ট করে ফেলে; বিবাহিত হোক বা অবিবাহিত হোক অ্যাবরশনের ফলে একটা নারীর জীবনে আর কোনকিছুই বাকি থাকেনা তখন তারা অধিকাংশ সময় আত্মহত্যার মতো জঘন্য জিনিসের দিকে ধাবিত হয় যা কারোর কাম্য হওয়া উচিত নয় ।
সচেতন থাকুন,ভালো থাকুন । ধন্যবাদ ।।
(এই পোস্টটি লিখতে গিয়ে আমি বিভিন্ন দেশি-বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা ও বিভিন্ন মেডিকেল থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং উইকিপিডিয়ার সহায়তা নিয়েছি ।)**