আমাদের মনুষ্যত্ব !!??

সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের মধ্যে নিহিত রয়েছে মনুষ্যত্ব । মনুষ্যত্ব অর্থ হচ্ছে দয়া, ধর্ম ও প্রেম । মানুষের মতো বাচতে হলে এসব না হলে চলে না । তাই একান্ত প্রয়োজনীয় না হলেও প্রেম, সৌন্দর্য ও আনন্দেই মনুষ্যত্বের বিকাশ । এসব নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে । আদিম যুগ পেরিয়ে মানুষ অনেক কষ্টত্যাগ, অত্যাচার, নির্যাতন, বিদ্রোহ ইত্যাদি স্বীকার করে এবং ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে বর্তমানে আধুমিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে পৃথিবীতে বাস করছে । বর্তমান যুগে মানুষ বা করতে পেরে সত্যিই ভাগ্যবান । কারণ ভাষা, শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি বিজ্ঞান, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি ও ঐতিহ্য বর্তমান বিশ্বে অনেক অগ্রসর । তারপরও পৃথিবী জুড়ে চলছে শিক্ষা ও উর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আন্দোলন । যেহেতু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও বিস্ফোরণের ঘটনা তখন সত্যিই ব্যথিত না হয়ে পারি না । এটা সত্যিই দুঃখজনক ঘটনা । আমরা চাই না যুদ্ধ, চাই না আর কোনো দেশে নতুন করে পারমাণবিক বিস্ফোরন ঘটুক । এমনিতেই দু’টি বিশ্বযুদ্ধে লাখ লাখ জীবনের প্রাণহানি ঘটেছে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও সাড়া বিশ্বে ফিলিস্তিন, বসনিয়া, সোমালিয়া, বুরুন্টি, রুয়ান্ডা, বিয়েতনাম, ভারত, বার্মা, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইরাক, ইরান, কুয়েত, রাসিয়া, আফগানিস্তানসহ নানা দেশে কম স্নায়ুযুদ্ধ হয়নি । এখনো হচ্ছে । বিশ্ববাসী তারা এখন আর যুদ্ধ চায় না , সুখ চায়, শান্তি চায়, বিস্ফোরণ চায় না, চায় শিক্ষা ও উন্নতি । চায় বাচার জন্যে খাদ্য ও পানি । তাই আমাদের মনুয়ষ্যত্ব কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে তা ভেবে দেখা দরকার । মনুষ্যত্বের কথাই যখন এলো তখন মোতাহের হোসেন চৌধুরীর মনুষ্যত্ব প্রবন্ধের কিছু কথা মনে পড়ে গেলো । তিনি বলেছেন, মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে । জীবসত্তায় ঘড়ে নিয়ে যেতে পারে । আর শিক্ষার মারফত মূল্যবোধ তথা মনুষ্যত্ব লাভ করা যায় ।
কিন্তু আমাদের দেশে সম্প্রতি যেভাবে সন্ত্রাস, হত্যা, খুন, নারী নির্যাতন, অপহরণ, পাচার এসিড নিক্ষেপ, যৌতুকের শিকার এবং শিশু ধর্ষণ হচ্ছে তা সত্যিই জাতির জন্যে দুর্ভাগ্যজনকই লজ্জাজনকও বটে । সন্ত্রাসের মূল কারণ হচ্ছে চাঁদাবাজি, এঁকে অপরের মধ্যে কলহ, পূর্ব শত্রুতার জের এবং পরস্পর স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় তাই এক ধরনের লোক সন্ত্রাসী কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে । খুন হচ্ছে নিরীহ মানুষ- যা দেশের জন্যে, জাতির জন্যে কল্যাণকর নয়। সন্ত্রাস বন্ধ করতে হলে শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দিয়েই হবে না । এজন্যে দেশের প্রত্যেক সচেতন নাগরিক তথা কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী সবাই মিলে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে পারেন । যা অতীতের ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের আন্দোলনে দেখেছি । দেশকে উন্নত করতে হলে দেশে পুঁজি বিনিয়োগে বিদেশিদেরকে আকৃষ্ট করতে হবে। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত । বিদেশিরা যাতে আমাদের দেশে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে বিনিয়োগ করতে পারে সে ব্যাপারেও আমাদের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেয়া দরকার । সন্ত্রাস দমন না করতে পারলে পুঁজি বিনিয়োগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হবে । দেশে উন্নতি হবে না । শুধু কি তাই ! সন্ত্রাসের পাশাপাশি চলছে নারী নির্যাতন, দাম্পত্য কলহ, যৌতুকের বোঝা, পারিবারিক কোন্দল, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ । এসব কারণে নারী নির্যাতন চলছে । নারী নির্যাতন সাড়া বিশ্বে একই । এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন অ্যামেরিকার দেশ গুলোতে গৃহ সংসারে মহিলাদের শান্তি নাই । জাতিসংঘের এক রিপোর্টে দেখা যায় বাংলাদেশের বউ পিটানোর হাড় বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় স্থান । মন্ত্রীপরিষদ বৈঠকে নারী ও শিশু নির্যাতন ১৯৯৮ আইন পাস হয়েছে । এ ব্যাপারে পত্র-পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে । কিন্তু আইন প্রয়োগ হচ্ছে না সঠিকভাবে । এর জন্যে আইনকে কার্যকরী করে তুলতে হবে । এবং এর পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে হবে । সম্প্রতি আরেকটি বিষয় ভয়ংকরভাবে চোখে পড়ার মতো । তা হচ্ছে ৫ বছরের শিশু থেকে ১৪ বছরের শিশু পর্যন্ত যেভাবে দেশে প্রতিটি অঞ্চলে ধর্ষিত হচ্ছে তা সত্যিই লজ্জাজনক ঘটনা । সমাজে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াবো, তা না করে মনুষ্যত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছি আমরা । অবশ্য অ্যামেরিকার মতো সভ্য দেশেও ধর্ষণ হচ্ছে । বাংলাদেশে এ অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে এক ধরনের নরপষু দিনের পর দিন । আর আমরা তা নিরবে নিভৃতে সহ্য করে যাচ্ছি । এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটলের একটি কথা মনে পড়ে গেলো । তিনি বলেছে, মানুষ স্বাভাবিকভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব । যে মানুষ সমাজের সভ্য নয়, সে হয় দেবতা অথবা পশু । ২৩০০ বছর পূর্বে এরিস্টটল যে কথা বলেছেন তা ঠিকই সত্য বলে আজ প্রমাণিত হচ্ছে । আমরা পশুর মতো পরিচয় দিচ্ছি সমাজে । মানুষ হিসেবে নয় । এক সময় ইউরোপ ও আফ্রিকাতে নারী, শিশু বেচাকেনা হতো । বিভিন্ন সরকারি, এবং এনজিও প্রতিষ্ঠাঙ্গুলোতে নারীরা কাজ করে যাচ্ছেন । তারপরও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে । একটি শিশু যখন পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় তখন সে সুস্থ সবলভাবে বাঁচতে চায় । কে না সুখে-স্বচ্ছন্দে বাঁচতে চাই । স্বপ্ন দেখি । স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে । সে একদিন বড়ো হবে । মানুষ হবে । আর সে কিনা শিকার হচ্ছে নরপিশাচের । নারী ও শিশু যখন পাচার হচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তখন সমাজের মানুষ জানে না ধর্ষিত মেয়ের কি আর্তনাদ, চিৎকার এবং চরম মানসিক পরিস্থিতির কথা । সমাজে কি এরা স্বীকৃতি পাবে ? এরা তো আমাদের সন্তান । এ দায়-দায়িত্ব আমাদেরকেই বহন করতে হবে ।
পরিশেষে বলতে চাই, দেশে হাজারো সমস্যা আছে এবং এর সমাধানও হবে একদিন । তারপরও সবচেয়ে যেটা বেশি জরুরি বিষয় তা হলো সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন ও শিশু ঘর্ষণের মতো স্পর্শকাতর জিনিসগুলো জরুরিভাবে সরকারকে বদ্ধ করতে হবে । শুধু আইন দিয়ে চলবে না । জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নির্বিশেষে দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে সকলকে সরকারের পাশাপাশি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে । নির্যাতিত নারী ও শিশুদেরকে পুনর্বাসনের জন্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে । আর যেন কোনো মায়ের কোল খালি না হয়, বাপের ক্রন্দন না শুনতে হয় এবং কোনো নারী বা বোন বা মেয়েকে আর যেনো নরপশুদের হাতে ধর্ষিত না হতে হয়-সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে । তাহলে হয়তো আমরা মনুষ্যত্বের পরিচয় দিতে পারবো ।
(মোহাম্মদ শামসুল কবির)

Related Posts