“শিক্ষকতা একটা জটিল পেশা। মন খারাপ থাকলেও হাসি মুখে ছাত্রদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। আবার সেই ছাত্রদের কারণেই বেশ মন খারাপ হয়ে যায়।”
এসব কিছু ভাবতে ভাবতে কখন স্কুল শিক্ষিকা শিউলি শহীদ মিনারের সামনে এসে হাজির হলো তা সে নিজেও জানে না। আনমনেই শহীদ মিনারের সিড়ির পাশে বসে আছে। মন খারাপের কারণে আশে পাশে কি হচ্ছে সে কিছুই উপলব্ধি করতে পারছে না। তার কাঁধে একটা স্পর্শ অনুভূত হতেই সে চমকে উঠে পিছনে তাকালো। ৮/১০ বছর বয়সী একটা ছেলে এক গুচ্ছ ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। শিউলি তার দিকে তাকাতেই মুখ ভরে হেসে ছেলেটা বললো,
-“ফুল নেবেন আপা! ১০ টাকা”
শিউলি শান্ত গলায় বললো,
-“না, নেবো না।”
না বলার পরেও ছেলেটা পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পেরে শিউলি আবার বললো,
-“ফুল নেবো না, আমি।”
ছেলেটা এবারও গেলো না বরং শিউলির পাশে এসে বসলো।
– “আপা ঐযে দেখতেছেন ঐযে শহীদ মিনার, এই শহীদ মিনারটারে আর কয়দিন পর সাজানো হইবো। ঐ শহীদ মিনারেরও আপনার মতো মন খারাপ।”
শিউলি বেশ অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে চেয়ে থাকলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
– “তোমাকে কে বলেছে শহীদ মিনারের মন খারাপ?”
– “আমিই বলসি।”
– “তোমার কেন এটা মনে হলো?”
ছেলেটা শিউলির দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে আবার শহীদ মিনারের দিকে তাকিয়ে বললো,
– “মা কইতো, এই শহীদ মিনার নাকি মানুষের রক্তের উপর বানাইসে। কারা যেন মায়ের ভাষার জন্য আন্দোলন করতে গিয়া এইখানে গুলি খায়া মরসে। তারপর এইখানে এই শহীদ মিনার বানাইসে। মা কইতো এই জায়গাটা অনেক পবিত্র। সব সময় যেন সম্মান করি। মা কইতো, আজকে যে আমি কথা কই এটাও তাদের অবদান। এইযে এখন দেখেন কতো মানুষ জুতা পায়ে দিয়া যাইতেসে, শহীদ মিনারের সামনে গিয়া কি কি করতেসে, মিনারের গায়ে আঁকাআঁকি করতেসে আর কয়দিন পর দেখবেন সাদা কালো জামা পইড়া, হাতে ফুল নিয়া খালি পায়ে এরাই আসবো শহীদদের সম্মান দেখাইতে। এটার জন্য কি শহীদ মিনারের দুঃখ হয় না! কন আপা, শুধু কি ২১ সে ফেব্রুয়ারির দিনই শহীদরা ঐখানে থাকে! এমনি দিনে থাকে না! সম্মান শুধু ঐদিনের জন্যই! ঐ দিন ছাড়া এই শহীদ মিনারের কোন মূল্য নেই,কোন সম্মান নাই!”
ছেলেটার কথা শুনে শিউলি হতবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। আর ছেলেটা শহীদ মিনারের দিকে। শিউলির মাথায় হঠাৎ করে তার মৃত বাবার কথা মনে পড়লো। বাবা তাকে এইভাবেই ভাষা আন্দোলনের গল্প শোনাতেন। বলতেন,
-“আমরা আমাদের মায়ের ভাষার জন্য আন্দোলন করেছি। আর তোমরা কি করছো? বাংলা ভাষার বিকৃতি করছো। শুধু বাংলা কেন তোমরা সব ভাষার অপমান করছো। কথায় কথায় ইংরেজি গালি দাও, বাংলার মাঝে ইংরেজি শব্দ টেনে এনে নিজেদের শিক্ষিত, মার্জিত ভাবো। কিন্তু এটা মোটেও শিক্ষিত, মার্জিত স্বভাব না। তোমরা মায়ের ভাষাকে ভালোবাসো না। কথা বলতে তোমরা জানোই না। তোমাদের কাছে ২১ শে ফেব্রুয়ারি একটা সাজগোজ করার উৎসব মাত্র, কিন্তু আমাদের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারি একটা আবেগ। যেখানে মা জড়িত, মাতৃভাষা জড়িত।”
শিউলির স্মৃতি বিজড়িত আনমনে মস্তিষ্ককে আবার সাড়া দিয়ে ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো,
– “আপা, আমার মা মারা গেসে দুই বছর। মা ডাকতে পারি না। কিন্তু মায়ের কওয়া কথা এখনো কানে ভাসে। মনে হয় যেন মায়ের রুহটাও ঐ শহীদ মিনারে ঠাই নিয়ে বলতেসে, খোকন ভাষার সম্মান কর, শহীদ মিনারের সম্মান কর,মানুষের সম্মান কর।”
শিউলির চোখ ভোরে এলো। সে শহীদ মিনার থেকে চোখ সরিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলো ছেলেটা নেই। দূর দূর পর্যন্ত ছেলেটার কোন চিহ্ন সে দেখতে পেলো না। কিন্তু তার মধ্যে অন্য রকম একটা দায়িত্ববোধের আবেগ সঞ্চারিত হতে অনুভব করলো সে। আর ভাবতে লাগলো ছেলেটার নাম জিজ্ঞেস করা হলো না। কি নাম হতে পারে ছেলেটার!