কিভাবে পড়লে পড়া মনে থাকবে?
কোনো কিছু মনে রাখাকে আমরা স্মৃতিশক্তি বলি। এই স্মৃতিশক্তি মেধার প্রথম লক্ষণ। পণ্ডিত বলে পরিচিতি পেতে গেলে অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী হতেই হবে। কুরআন, বাইবেল, বেদ, ত্রিপিটক, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি গ্রন্থ শুধু পড়লেই যথেষ্ট হবে না; সেগুলো মুখস্থও করতে হবে এবং প্রয়োজনের সময় উদ্ধৃতি দিতে হবে। বক্তৃতায় বিভিন্ন রেফারেন্স তুলে ধরতে হবে। তবেই কথার গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। একইভাবে পরীক্ষায় যদি ভালো নম্বর পেতে চান, তবে বিভিন্ন বিষয় মুখস্থ রাখতে হবে। চার-পাঁচটা বই পড়ে, দরকারি বিষয়গুলো একত্র করে নোট লিখতে হবে। তারপর উত্তরপত্রে লেখার সময় মাঝে মাঝে উদ্ধৃতি দিতে হবে। তেমনি গণিতে ভালো হতে হলে, এর সমস্ত ফর্মূলা মুখস্থ রাখতে হবে। এছাড়াও মুখস্থ রাখতে হবে গোটা অভিধানের বানান, গ্রামার ও ব্যাকরণের নিয়ম-কানুন; বিজ্ঞানের যাবতীয় সূত্র, ইংরেজি ও বাংলা কবিতা।
এগুলো ছাত্রজীবনে তো অবশ্যই, কর্মজীবনেও যিনি যত মনে রাখতে পারেন, তিনি তত কৃতী হন। একবার ভাবেন তো, ডাক্তার রোগী দেখেই কীভাবে খস খস করে লিখে দিচ্ছেন হাজারো ওষুধের নাম? আর কী সব বিদঘুটে নাম, তাই না? এরকম কত যে ওষুধের নাম তাদের মুখস্থ রাখতে হয়! এ ছাড়া নিত্য নতুন আবিষ্কৃত ওষুধের নাম তো আছেই। এর সবগুলোই তারা মনে রাখে।
উকিলদের মনে রাখতে হচ্ছে বিভিন্ন ধারার আইন। এই সব ধারার সংখ্যা কি আর কম? এর সঙ্গে আইনের সংশোধন ও নতুন ধারা যুক্ত হওয়ার বিষয়টি তো আছেই। তেমনি স্কলারদের অর্জন করতে হচ্ছে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের অধ্যায়, পরিচ্ছেদ, পৃষ্ঠাসহ সকল বিষয়ের অন্তর্নিহিত জ্ঞান।
মজার কথা হলো, শুধু মুখস্থ করতে জানলেই কিন্তু মেধাবী হওয়া যায় না। এর সঙ্গে বোঝার বা হৃদয়ংগম করার সক্ষমতাও থাকতে হয়। তা না হলে তো যেকোনো অভিনেতাই স্যার আইজ্যাক নিউটন হতে পারতেন। আর একজন হাফেজ হয়ে যেতেন বড়ো স্কলারের সমান।
মেধা বলতে স্মৃতিকে কাজে লাগিয়ে নিজের সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী শক্তিকে গড়ে তোলাকে বোঝায়। সে জন্য থাকতে হবে প্রখর বিশ্লেষণী শক্তি; আর প্রতিটি বিষয় বুঝতে পারার ক্ষমতা। এই বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলেই আপনি হয়ে যাবেন অন্য সবার থেকে আলাদা। একজন ভালো বক্তার কথাই ধরেন- তিনি কথা বলে নিমিষেই সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে নেন; তাই না? তিনি কেন এটা পারেন, বলতে পারবেন? কারণ, তার রয়েছে প্রখর বিশ্লেষণী শক্তি, আর কঠিন বিষয়কে সহজ করে বোঝানোর ক্ষমতা।
আপনাদের প্রতিষ্ঠানে যারা ভালো ছাত্র, তাদেরকে দেখবেন যে, খুব বেশি পড়ে না। কারণ, তাদের একবার পড়লেই মনে থাকে। কলেজজীবনে আমাদের ক্লাসে যে ফার্স্টবয় ছিল, তাকে দেখতাম; সবসময় আড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু পরীক্ষায় বসলেই ফার্স্ট। এরা খুবই মনযোগী হয়। এদের মধ্যে যাদের মৌলিকতা বা সৃজনশীল শক্তি বেশি এবং যারা জটিল ও দুরূহ বিষয় চট করে বুঝতে পারে, অর্থাৎ জটিল বিষয়কে নিজের মতো করে সহজ করতে পারে, তারা অনেক বেশি সফল হয়।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের দেহের ওজনের চল্লিশ ভাগের একভাগ হলো তার মস্তিষ্কের ওজন। আর মৌমাছির দেহের ওজনের একশো সাতচল্লিশ ভাগের একভাগ হলো মস্তিষ্কের ওজন। এই ক্ষুদ্র পতঙ্গগুলো মস্তিষ্ককে পূর্ণভাবে ব্যবহার করে। তাদের বানানো কারুকাজময় মৌচাক আর শাসনব্যবস্থা দেখলেই এটা বোঝা যায়। অপরদিকে একজন মানুষও তার মস্তিষ্কের পূর্ণ ব্যবহার করতে পারে না; বরং মাথাকে একটি বোঝা হিসেবেই নিয়ে বেড়ায়। যারা এই মস্তিষ্কের যথার্থ ব্যবহার জানেন ও করেন, তারাই হন কৃতী মানুষ।
সেই অর্থে বলতে পারি ইবনে সিনা, আইনস্টাইন, ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ, জগদীশচন্দ্র বসু, বিজ্ঞানী সত্যেন বসু, প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত ব্যক্তিগণ মেধার যথার্থ ব্যবহার করেছেন।
আপনাদের একজন মেধাবীর গল্প শোনাই।
তিনি হচ্ছেন বিজ্ঞানী সত্যেন বসু। ছোটোবেলা থেকেই তাঁর বিভিন্ন বিষয়ে পড়ার ব্যাপক আগ্রহ ছিল। এমনকি তিনি বন্ধু-বান্ধবদেরও পড়া বুঝিয়ে দিতেন। একবার হলো কী? তিনি বইয়ের পাতা ধরছিলেন, আর ছিঁড়ছিলেন। এই কান্ড দেখে মা খুব রাগ করলেন এবং বকাবকি করলেন। সত্যেন বসু তখন ম্লান বদনে বললেন, ‘বই তো আমার মুখস্থ মা। তাহলে পাতার আর দরকার কী?’ মায়ের বিশ্বাস হলো না। মা তখন বললেন, ‘ঠিক আছে বল দেখি, কেমন পারিস? ১০ নম্বর পাতায় কী লেখা আছে?’ সত্যেন বসু সত্যি সত্যি ১০ নম্বর পাতাটি মন্ত্রের মতো হুবহু মুখস্থ বলে গেলেন। শুধু বিজ্ঞান নয়, যেকোনো বিষয়ের ওপরই সত্যেনের দখল ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ। তিনি যখন কলেজে পড়েন, তখন তার এক সহপাঠী এসে বলল, ‘সত্যেন, গণিতটা আমার মাথায় ঢুকছে না। কাল পরীক্ষা, কী করি বলত?’ সত্যেন বললেন, ‘কাল ভোরে তোর বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে আসব।’ সত্যেন পরদিন ভোরে গিয়ে বন্ধুকে এমন পানির মতো করে অঙ্ক বুঝিয়ে দিলেন যে, সে পরীক্ষায় খুবই ভালো করল। সত্যেন বসু যখন স্কুলে পড়েন, তখন অঙ্ক পরীক্ষায় একশোর মধ্যে একশো দশ নম্বর পেয়েছিলেন। কারণ, দশটা অঙ্ক করার কথা থাকলেও সত্যেন এগারোটি অঙ্কই করে দিয়েছিলেন।
কলেজে একবার ইংরেজিতে নম্বর পেলেন ৬০+১০। শিক্ষককে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘কেন তাকে ১০ নম্বর বেশি দেওয়া হলো?’ শিক্ষক মুচকি হেসে বললেন, ‘ওই দশ নম্বর দিলাম ওর নিজস্ব তাত্ত্বিক বক্তব্য লেখার জন্য। ওর মধ্যে আলাদা কিছু একটা আছে। বইতে যা আছে, তা সে কখনো উগরে দেয় না।’
মজার ব্যাপার কি জানেন? স্মৃতিশক্তি কিন্তু অনুশীলনের সাহায্যে বাড়ানো যায়। তবে বেশি বয়সের মানুষ পারে না; কিন্তু ছোটোরা পারে। তারা ইচ্ছে করলেই নিয়মিত অনুশীলন করে মনে রাখার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। তা বীজগণিতের সূত্র, বিজ্ঞানের সূত্র, বিভিন্ন মতবাদ কিংবা কাজী নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা, যাই হোক না কেন।
এস. জনসন বলেছেন-
‘সত্যিকারের স্মৃতি হলো মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা।’
তার মানে হলো, কোনো কিছুতে পূর্ণ মনোযোগ দিলেই তা আমাদের মনে থাকবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা মনে রাখতে পারি না। এর কারণ হলো, আমরা ভালো করে শুনি না এবং মনোযোগ দিই না।
একজন সুস্থ মানুষের মস্তিষ্ক একসঙ্গে কয়েক হাজার কম্পিউটারের কাজ করতে পারে। অথচ এর ওজন মাত্র তিন পাউন্ড। আমাদের পুরো দেহের মধ্যে মস্তিষ্কের গঠন সবচেয়ে জটিল। এমনকি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার সুপার কম্পিউটারের চেয়েও হাজারো কোটি গুণ জটিল। ডাক্তার ওয়াল্টারের মতে, ‘কেউ যদি বৈজ্ঞানিক প্রণালিতে মানুষের মস্তিষ্কের মতো ক্ষমতাধর বা শক্তিশালি অন্য কোনো বৈদ্যুতিক মস্তিষ্ক বানাতে চায়, তাহলে এর জন্য খরচ হবে পনেরো শত কোটি টাকারও বেশি।’
সংখ্যাটি অঙ্কে লিখলে দাঁড়ায় ১,৫০,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০০ টাকা। যা দিয়ে বর্তমানে প্রায় দশ হাজার কোটি কম্পিউটার কেনা সম্ভব। তার মানে তোমার মাথার কম্পিউটারটি দশ হাজার কোটি কম্পিউটারের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। কী হলো? অমন হা হয়ে থাকলে যে? বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না? কিন্তু এটাই সত্যি।
আরও আনন্দের সংবাদ হলো, এই মস্তিষ্ককে চালাতে এক হাজার কোটি কিলোওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে। দৈনিক চালু রাখার জন্য কর্ণফুলীর কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো আরও তিন হাজার আড়াইশোটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সামগ্রিক উৎপাদন প্রয়োজন হবে। সাবধান, ভয় পেয়ো না কিন্তু! এই যান্ত্রিক মস্তিষ্কের আয়তন হবে আঠারোটি একশো তলা বিল্ডিংয়ের সমান। আমাদের মস্তিষ্কের ওপরের সাদা ঢেউ খেলানো অংশকে বলা হয় কর্টেক্স। স্তরে স্তরে বিন্যস্ত এই কর্টেক্সকে সমান্তরালভাবে সাজালে এর আয়তন হবে দুহাজার বর্গ মাইলেরও বেশি। অর্থাৎ ব্রুনাই দেশের সমান।
চোদ্দোশত কোটি নিরপেক্ষ জীবকোষ দিয়ে এই কর্টেক্স গঠিত। এ সকল পরস্পর বিচ্ছিন্ন সম্পূর্ণ একক জীবকোষকে নিউরন বলা হয়। এগুলো এতই ক্ষুদ্র যে, কয়েকশত নিউরন একত্রে করলে একটি আলপিনের মাথায় স্থান নিতে পারে। আর প্রতি সেকেন্ডে এ ধরনের লাখো নিউরন এসে ব্রেইনের প্রাথমিক স্তরে জমা হতে থাকে। আমাদের দেহের মেরুদন্ডের মাধ্যমে নিউরনগুলো সারা শরীরের যন্ত্রপাতিকে তৎপর ও সজীব রাখে। এগুলোর আবার অনেক স্বতন্ত্র বিভাগ রয়েছে; যার সংখ্যা প্রায় ২৫০টি। এর কোনো অংশ শোনার জন্য, কোনো অংশ বলার জন্য, আবার কোনো অংশ দেখার জন্য। এতে আবার বসানো হয়েছে একটি স্বয়ংক্রিয় শক্তিশালী মেমোরি সেল। যার কাজ হলো নিত্য নতুন সংগ্রহগুলোকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা।
পরম আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে পৃথিবীর সর্বকালের সর্ব প্রকারের যাবতীয় তথ্য ও তত্ত্বকে এক জায়গায় একত্র করে যদি এই মেমোরি সেলে রাখা যায়, তাতে এর লক্ষ ভাগের একভাগ জায়গাও পূরণ হবে না। আল্লাহু আকবার! আমরা মহান আল্লাহর অপার মহিমার শুকরিয়া কীভাবে আদায় করব, ভেবে কূল-কিনারা পাই না।
আপনি কি অনুভব করতে পেরেছেন, কত শক্তিশালী আমাদের মস্তিষ্ক! তবে দুঃখের বিষয়, আমরা এর হাজার ভাগের এক ভাগও কাজে লাগাতে পারি না। আধুনিক বিজ্ঞান এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমরা প্রত্যেকে আল্লাহ প্রদত্ত এই মহাশক্তিশালী কম্পিউটার (মস্তিষ্ক)-কে কাজে লাগাতে পারব।
আগেকার দিনের লোকদের স্মৃতিশক্তি কত বেশি ছিল, শুনলে আপনাদের বিস্ময়ে থ হয়ে যাবে। জুলিয়াস সিজার ও আলেকজান্ডারের ত্রিশ হাজার সৈন্য ছিল। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসের দশ হাজার সৈন্য ছিল। তাঁরা প্রত্যেক সৈন্যের নাম জানতেন। সক্রেটিসের সময় এথেন্সে সাড়ে তিন লাখ লোক বাস করতেন। সক্রেটিস এই সাড়ে তিন লাখ লোকের প্রত্যেকের নাম জানতেন। স্মৃতিশক্তির প্রখরতা নাম মনে রাখার ওপর অনেকটা নির্ভর করে। আপনি যত বেশি লোকের নাম মনে রাখবেন, ততই আপনার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। তাহলে আর দেরি কেনো, শুরু করে দেন ক্লাসের বন্ধুদের নাম মনে রাখার কাজ। প্রথমে আপনার ক্লাসের বন্ধুদের নাম মনে মনে রপ্ত করতে হবে। এরপর অন্যান্য ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের যত জনের নাম মনে রাখা সম্ভব, মনে রাখেন। এভাবে পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের নামও মনে রাখার চেষ্টা করবেন।
অনেক সময় আমরা পরিচিতদের ভালো নাম জানি না। ঝুমু আন্টি, তারেক মামা, মিজান চাচা, রোজি ভাবি এসব নামেই তাদের মনে রাখি। মিশু আন্টির ভালো নাম যে, তাহমিনা আক্তার , তারেক মামার ভালো যে নাম আবু সুফিয়ান, মিজান চাচার ভালো নাম যে মিজানুর রহমান, রোজি ভাবির ভালো যে নাম রোজিনা আক্তার , এগুলো আমাদের মনে রাখা দরকার। সেই সঙ্গে বাড়ির ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর যত বেশি মুখস্থ রাখা যায়, ততই ভালো। এগুলো বড়ো হলে কাজে আসবে। তুমি যদি অফিসের বড়ো সাহেব হও, কর্মচারীদের প্রকৃত নামে চিনলে দেখবে সবাই তোমাকে আলাদা সম্মান করছে।
আমেরিকানদের মধ্যে একটা সুন্দর নিয়ম আছে। তারা পরিচিতদের প্রথম নামে ডাকে। ধরেন আপনি, বয়সে অথবা পদমর্যাদায় ছোটো। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। আপনি মাইকেল ফেলপস নামের কোনো ভদ্রলোককে অনায়াসে মাইকেল বলে ডাকতে পারেন। সাংবাদিকতায়, রাজনীতিতে ও সেলস-এর কাজে আপনি যত লোকের নাম মনে রাখতে পারবেন, ততই কাজের সুবিধা।
কারও সঙ্গে নতুন পরিচয় হলে তার নামটি ভালো করে শুনে নেবেন। চোহারাটিও ভালো করে দেখে নেবেন। কাউকে একবার দেখে মনে রাখা, এটাও কিন্তু স্মৃতিশক্তি। দুর্বল স্মৃতির লোক কাউকে একবার দুবার দেখে চিনতে পারে না, নাম মনে রাখা তো দূরের কথা। ‘লিনা পো’ নামে এক বিখ্যাত শিল্পী অন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও সুন্দর সুন্দর ভাস্কর্য করতেন। আবার দেখা যায় অনেক কুরআনের হাফেজ অন্ধ হওয়ার পরও কোন পৃষ্ঠায় কোন সূরা বা আয়াত, তা একটানা বলে দিচ্ছে। এগুলো সবই অসাধারণ স্মৃতি শক্তির প্রমাণ।
অসাধারণ ব্যক্তিদের কথা থাক। ধরেন আপনি একজন সাধারণ ছাত্র/ছাত্রী। আপনি প্রচুর পড়েন, কিন্তু কিছুক্ষণ পর আর মনে থাকে না। এখন আপনি কী করবেন? অনেকে ভাবে এ অবস্থায়, আমার মনে হয় লেখাপড়া হবে না। মুখস্থবিদ্যা কম থাকলে অনেকের পরীক্ষাভীতি আসে। এই ভীতি থেকে পরীক্ষার আগে মাথা ঘোরে, বুক ধরফড় করে, পেট খারাপ হয়, বমি পায়, এমনকি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় গড়ায়। এসবই কিন্তু মানসিক অসুখ, পরীক্ষাভীতি থেকেই এটা হয়।
এখন এই স্মৃতিশক্তি কীভাবে বাড়ানো যায়? এতদিন বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, মস্তিষ্কে এক ধরনের রসক্ষরণের কারণে স্মৃতি ধারণের ক্ষমতায় তারতম্য ঘটে। কিন্তু এটা ঠিক নয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা এখন বহুলাংশে পালটেছে। আমাদের মস্তিষ্কের ভেতর কয়েক কোটি নার্ভ সেল বা কোষ আছে। এই নার্ভ সেলগুলোর পরস্পরের মধ্যে সংযোগের ফলে আমরা মনে রাখতে পারি। এই সংযোগ ঠিকমতো না হলে আর মনে থাকবে না।
প্রত্যেকটি বিষয় মনে রাখতে গেলে একটা প্রচন্ড ইচ্ছা ও চেষ্টা থাকা চাই। প্রত্যেক ক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তি আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে। এখন যাদের স্মৃতিশক্তি দ্রুত কাজ করতে চায় না, তাদের প্রথম কাজ হলো মনোযোগ বৃদ্ধি করা। যাকে বলে মনঃসংযম। এটা করতে হলে রোজ ভোরে নির্জন ঘরে বা বিজন মাঠে বসে যোগ ব্যায়ামের অভ্যাস করতে হবে। যোগব্যায়াম মানে চুপচাপ চোখ বুজে বসে যেকোনো একটি বিষয় চিন্তা। পাঁচটা চিন্তা তাড়িয়ে একটি চিন্তাই মাথায় রাখতে হবে।
দ্বিতীয়ত, সর্বদা আল্লাহর কাছে জ্ঞান চাইতে হবে। কেননা, তিনিই আমাদেরকে তার কাছে জ্ঞান চাওয়ার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন। ‘রাব্বি জিদনি ইলমা’ (অর্থাৎ হে আমার প্রভু! আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দিন) এই বাক্য সবসময় পড়তে হবে।
তৃতীয়ত, যে বিষয়টি আপনি যা পড়বেন, সঙ্গে সঙ্গে তা লিখবেন। পড়ার পর বই বন্ধ করে আবার লিখবেন। তারপর মিলিয়ে দেখতে হবে কোথায় ভুল হচ্ছে?
চতুর্থ কাজটি হলো, আপনাকে ধীর গতিতে পড়তে হবে। বিষয়টি নিয়ে ধ্যান করতে হবে। বইয়ের পাশে পেন্সিল দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট লিখতে হবে। হতে পারে আপনি নতুন করে এমন কিছু বুঝেছেন, যা এই বইয়ে ভালোভাবে নেই; সেটাও লিখে রাখবেন। বইয়ের পাতাগুলোর পুরো ছবিটা মনের ভেতর তুলে নিতে হবে। দরজা বন্ধ করে যা পড়েছেন সে সম্পর্কে নিজে নিজে একটা ভাষণ দিতে চেষ্টা করেন। ধরেন, আপনি ওই বিষয়টি কাল ক্লাসে পড়াবেন। ছাত্রদের কী বলবেন, কেমন করে বলবেন, তার প্র্যাকটিস করবেন। সামনে একটা আয়না রাখেন। রাতে ঘুমানোর আগে বিছানায় শুয়ে আজ সারা দিন কী পড়লেন, নিজেকে একবার পরীক্ষা নেন। চেঁচিয়ে পড়লেই যে মনে থাকবে, তা নয়। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই বিষয়টি নিয়ে সর্বদা ভাবতে হবে। মাথায় একটি চিত্র আঁকতে হবে।
প্রতি অনুচ্ছেদ পড়ার পর এক মিনিট থামতে হবে। আগে ভাবেন, প্যারার সারাংশ বুঝতে পারলেন কিনা। না বুঝলে আবার পড়েন। কোনো শ্লোক, শব্দার্থ, বিখ্যাত উক্তি, ফর্মুলা, মোবাইল নম্বর মুখস্থ না হলে কাগজে লিখে দেয়ালে সেঁটে দেন। রোজ দুবেলা কিছু সময় ওই লেখার দিকে তাকিয়ে থাকেন। মনে মনে পড়তে থাকেন। যদি তাতেও মুখস্থ না হয়, তাহলে যে অংশটি মনে রাখা খুব দরকার, সেটি কাগজে বা নোট বইতে লিখে পকেটে রেখে দেন। যখন বাস, ট্রেন কিংবা স্টেশনে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করবে, তখন নোট বইটা টুক করে বের করে পড়ে নেবেন। অনেকে এতে লজ্জা পায়। কিন্তু আপনি লজ্জা পাবেন না। লজ্জা পাবার কী আছে? আপনি তো চুরি করছেন না, তাই না?
ঢাকাকে এখন বলা হয় জ্যামের শহর। জ্যামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি আটকে থাকে। নিয়মিত ব্যাগের মধ্যে বই রেখে এই সময়েও পড়তে পারেন। যাদের অ্যানড্রায়েড মোবাইল আছে তারা pdf ফাইল সংরক্ষণ কিংবা বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহার করেও গাড়িতে বসে বই পড়তে পারেন।
ছোটোবেলায় খুব ভালো মুখস্থ হয়। তাই যত বেশি পারেন কবিতা, কুরআন-হাদিস মুখস্থ করে ফেলেন। ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য সাল, তারিখ যেকোনো ছাত্রেরই মনে রাখা দরকার। এরপর মহাপুরুষদের বিখ্যাত উক্তি বা কোটেশন মুখস্থ করেন। মনে রাখবেন, ছাত্রজীবনে যা মুখস্ত করবেন, সারা জীবন তা ভুলবেন না।
বর্তমান ছেলে-মেয়েদের বড়ো হওয়ার পথে একটা বিরাট বাধা হলো ইংরেজি। ভালো ইংরেজি বলতে ও লিখতে না জানলে কখনোই নিজের এলাকা ছাড়িয়ে বাইরে যেতে পারবে না। বাংলা ভাষা দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে পারো, কিন্তু ইংরেজি না জানলে গ্লোবাল বিশ্বে টিকে থাকতে পারবে না, বিশ্ব নাগরিক হতে পারবে না। পৃথিবী আপনাকে ধারণ করতে পারবে না। বড়ো হয়ে আপনি কত দেশে ঘুরবেন, কত জাতির সঙ্গে কথা বলবেন। ইংরেজিতে কথা বলতে না শিখলে, তখন নিজেকে খুব ছোটো মনে হবে।
আপনি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েননি। তাতে কী হয়েছে? প্রতিদিন কমপক্ষে ৫টি অজানা শব্দ মুখস্ত করেন, জানেন। ইংরেজিতে কথা বলা এখন থেকে অনুশীলন করেন। তিন চার বন্ধু মিলে একটা ক্লাব খুলুন। নাম রাখেন ইংলিশ স্পিকিং ক্লাব। যখনই আপনারা একত্রিত হবেন, ইংরেজিতে কথা বলবেন। প্রথম প্রথম দ্রুত কথা বলতে পারবেন না। তবে কিছু দিন পর দেখবেন, বেশ গড় গড় করে বলতে পারছেন।
বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। একজন মুসলমান যদি একজন মুসলমান হন তবে আপনাকে অবশ্যই আরবি ভাষা দখলে আনতে হবে। আরবি ভাষা জানা মুসলমানদের স্মার্টনেস। কুরআনুল কারিম পড়া আপনার নিজের জন্যই অতীব জরুরি। বাংলা, ইংরেজি পারেন, কিন্তু আরবি পারেন না; এটা একটা বড়ো ব্যর্থতা। আবার আপনি যদি হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খ্রিষ্টান ধর্মের হন তাহলে আমাকে আপনার ধর্মীয় জ্ঞান আপনাকে রাখতে হবে। এখনও যদি না জানেন তাহলে আজ থেকেই চেষ্টা শুরু করে দেন। দেখবে মাত্র কয়েক মাস পরে আপনি নতুন করে শিখে নিজেকে উচ্চ মাত্রায় উপস্থাপিত করতে সক্ষম হয়েছেন।
আচ্ছা, আপনাদের কি বই পড়ার অভ্যাস আছে?
স্পিনজা বলেছেন,
‘ভালো খাদ্য বস্তুতে পেট ভরে, কিন্তু ভালো বই মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে।’
দেকার্তে বলেছেন,
‘ভালো বই পড়াটা যেন গত শতকগুলোর সেরা মানুষদের সঙ্গে কথা বলা।’
ইউরোপ কাঁপানো নেপোলিয়ন কি বলেছেন জানেন?
‘অন্তত ষাট হাজার বই সঙ্গে না থাকলে জীবন অচল।’
ভারতে ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তক জন মেকলে আরও মজার কথা বলেছেন,
‘বরং প্রচুর বই নিয়ে গরিব হয়ে চিলেকোঠায় থাকব; তবু এমন রাজা হতে চাই না, যে বই পড়তে ভালোবাসে না।’ আর সবচেয়ে চরমপন্থি কথাটি বলেছেন নর্মান মেলর, ‘আমি চাই বই পাঠরত অবস্থায় যেন আমার মৃত্যু হয়।’
রাসুল (সা.) বলেছেন,
‘জ্ঞান হচ্ছে তোমাদের হারানো সম্পদ। সুতরাং যেখানে তা পাও, কুড়িয়ে নাও।’
তো, আজ থেকেই শুরু হোক জ্ঞান সাধনার নতুন পথ চলা!
সময়োপযোগী পোস্ট
darun
Ok
good
nice, keep it up
বেশ ভালো পোস্ট।
Nice