ভাষার জন্য ভাসা ভাসা ভালোবাসা কেন?

কষ্টে পাওয়া জিনিস মানুষের খুব আপন হয়। কষ্টে পাওয়া জিনিসের প্রতি দরদটাও থাকে একটু বেশি। আর এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের প্রিয় মাতৃভাষার ক্ষেত্রে বোধহয় এই স্বাভাবিক বিষয়টারই চরম ঘাটতি পরিলক্ষিত হচেছ দিন দিন। যে মাতৃভাষার জন্য বাংলার মানুষ জীবন দিয়েছে। রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। জেল জুলুম সইতে হয়েছে। সেই অতিকষ্টে পাওয়া মাতৃভাষার চরম অবমাননার উৎসবে যেন মেতে উঠেছি আমরা। সবচেয়ে বড় কথা হলো মাতৃভাষার প্রতি আমরা অন্যায় করছি, অবিচার করছি এ বিষয়টাও আমরা বুঝতে পারছি না কিংবা বুঝতে চাইছি না। ফলে প্রাণপ্রিয় ভাষার প্রতি অবহেলা,অনাদর আর অনাদর আর অযত্নের বিষয়টি করে যাচ্ছি অবলীলায়। দেখুন যদি পাঠক হিসেবে আপনাকেই প্রশ্ন করা হয় আপনার অফিসে আপনি কোন ভাষায় আবেদন লিখেন, কোন ভাষায় আপনি দস্তখত করেন,কিংবা কোন ভাষায় আপনি দাপ্তরিক কাজকর্ম কিংবা ফাইলপত্র সম্পন্ন করেন। তাহলে আপনিসহ ৯৫ ভাগ পাঠকের কাছ থেকেই নিশ্চিত উত্তর আসবে ইংরেজি ভাষায়। যদি জিজ্ঞেস করা হয় আপনার ভিজিটিং কার্ডটি কোন ভাষায় ছাপানো। ৯৮ভাগ লোকের কাছ থেকেই নিশ্চিত উত্তর আসবে ইংরেজি। শহরের অলিগলিতে ছোট বড় সাইনবোর্ড, রাস্তায় সেট করা বড় বড় বিলবোর্ড, মার্কেট কিংবা দোকানের সাইনবোর্ড, বাসা-বাড়ির নামফলকসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যানার ফেস্টুনগুলো কোন ভাষায় লেখা। উত্তর আসবে বেশিরভাগই ইংরেজি ভাষায় লেখা। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনগুলোর ৯৫ ভাগইতো সেই ইংরেজিতেই লেখা। তাও আবার এমন ইংরেজি যা অন্য কোনো ডাক্তার ছাড়া বোঝার সাধ্য কারো নেই। দোকানের ক্যাশম্যামো,ভাউচার ইত্যাদি বিষয়গুলোর বেশিরভাগই ইংরেজিতে ছাপা হয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় এখনো ইংরেজিতেই ছাপা হয়! অনেকের মোবাইলের রিংটোনটাও বিদেশি কোনো মিওজিকের অংশবিশেষ। কিন্তু এসব কেন? আমার রক্ত দিয়ে অর্জিত মায়ের ভাষা দিয়ে কি এই কাজগুলো সম্পন্ন করা সম্ভব নয়? অবশ্যই সম্ভব । প্রয়োজন শুধু ইতিবাচক মানসিকতার। প্রয়োজন নিজের ভাষার প্রতি অগাধ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার। আর এসবের অভাবেই আজ আমরা বাংলার সাথে অদ্ভুদ ইংরেজি মিশিয়ে জগাখিচুরির বাংলিশ ভাষা আবিষ্কার করেছি। শুধু ভালোবাসার অভাবেই আজ অনেক বিদেশি শব্দ আমাদের বাংলা ভাষায় স্থায়ী জায়গা নিয়ে নিয়েছে। তাই আজ আমরা বাংলায় ‘বাহ’! কিংবা ‘চমৎকার’ না বলে বলি ‘ওয়াও’। গর্ভধারিনী মাকে ‘মা’ না বলে বলি ‘মম’। জন্মদাতা বাবাকে ‘বাবা’ না বলে বলছি ‘ড্যাড’। এখনতো বোন কিংবা আপুকে বলা হচ্ছে ‘সিস’ আবার ভাইকে বলা হচ্ছে ‘ব্রো’। আপন সন্তানকে আমার সন্তান না বলে বলা হচ্ছে আমার ‘বেবি’। আমি জানি না মা-এর মমত্ববোধ আর ভালোবাসার যে পরশ এই ‘মা’ ডাকে পাওয়া যায় তা ‘মমের’ মধ্যে আছে কি না। জানিনা আমার সন্তান বলতেই বুকের মধ্যে যে গর্বের ঢেউ খেলে যায় সেই রসবোধ ‘বেবি’ শব্দের মধ্যে আছে কি না। আজকাল এফএম রেডিওগুলোতে বাংলা ভাষার যাচ্ছেতাই ব্যবহার হচেছ। এসব যেন দেখার কেউ নেই। যেভাবে আমাদের তরুণ সমাজ বাংলা ইংরেজির মিশেলে নতুন ভাষার সৃষ্টি করছে তা প্রকৃতই হতাশার এবং আতংকের । আমাদের সমস্যাটা হচেছ আমরা অন্যের সংস্কৃতি অন্যের কৃষ্টি কালচারকে গুরুত্ব দিচ্ছি বেশি। আমরা মনে করছি বিদেশী সংস্কৃতির চর্চা করলে, বিদেশি ভাষার ব্যবহার করলে সমাজে আমার অবস্থান উঁচু হয়, নিজেদের প্রগতিশীল ভাবা যায়, নিজেকে অন্যের থেকে আলাদা ভাবা যায়। বরং নিজের মাকে তথা মায়ের ভাষাকে অবজ্ঞা করে অন্যকে বেশি ও অহেতুক গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের দৈন্যতা ও ছোট মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছি আমরা। অথচ আমার আপনার মাতৃভাষা বাংলা আজ আন্তর্জাতিক মর্যাদায় ভূষিত। বিশে^র ১৯০টি দেশ আমার মাতৃভাষাকে সম্মান জানিয়ে মাতৃভাষা দিবস পালন করে। যেখানে আমার বাংলা ভাষা জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে সেখানে আমরা অসম্মান করে চলেছি নিজ মাতৃভাষাকে। আমি বিদেশি ভাষা শেখার বিরোধী নই, নিতান্ত প্রয়োজনে ব্যবহারের বিরোধী নই। শুধু মাসীর জন্য নিজের মাকে অবহেলা না করার উপর জোর দিচ্ছি। কারণ মায়ের চেয়ে আপন আর কেউ হতে পারে না। তাই আসুন ভাসা ভাসা নয় মন থেকেই ভালোবাসি মাতৃভাষাকে নিজ ভাষাতেই মাকে ডাকি, নিজ ভাষাতেই হাসি কাঁদি।

Related Posts