১ লা আগষ্ট, ২০১৫ ইং, শনিবার। সকালটা বেশ রৌদ্রোজ্জ্বল, নীল আকাশে সাদা—কালো মেঘের ছুটোছুটি। ভোর বেলায় ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিস্তা নদী পথে ’সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) টু চিলমারী (কুড়িগ্রাম)’ এক আনন্দ—ভ্রমণ এর আয়োজন করা হয়েছে।
সকাল সকাল তাই প্রস্তুতি নিয়ে সুন্দরগঞ্জ পৌরসভা অফিস চত্ত¦রে উপস্থিত হলাম। তখন সকাল সোয়া ৮ টা, অফিস চত্ত্বরে এসে দেখি আমাদের আগেই বেশ ক’জন ভ্রমণসঙ্গী উপস্থিত হয়েছে। পাঠকদের জন্য ভ্রমণের কাহিনী শুরুর পূর্বে সুন্দরগঞ্জে আমার অবস্থানের কারণ বলাটা একটু প্রয়োজন।
সুন্দরগঞ্জ, বাংলাদেশের উত্তরের এক জনপদ গাইবান্ধা জেলার একটি উপজেলা। চাকুরিগত কারণে আমি প্রায় আড়াইবছরের মতো সুন্দরগঞ্জ পৌরসভাতে থেকেছি, ঐ সময়ে পৌরসভার কর্মকতার্ ও কর্মচারীদের আয়োজনে এই নৌ—ভ্রমণের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন অভিজ্ঞতার আলোকে এই ভ্রমণটি আমার জন্য স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে রয়েছে। ভ্রমণের কিছু অভিজ্ঞতা পাঠকদের সাথে বিনিময় করার প্রয়াসেই এই লেখার চেষ্টা।
সিন্ধান্ত অনুযায়ী, হাবলুর মোড় সংলগ্ন তিস্তার শাখা নদীর পাড় থেকে আমাদের নৌকা ভ্রমণ শুরু হবে। সব প্রস্তুতি, চড়াই উৎড়াই শেষে সকাল সাড়ে ১১ টার পর আমাদের ভ্রমণ শুরু হলো। এরই মধ্যে রান্নার জন্য সকল উপকরণ, লাকড়ি ও আনুষাঙ্গিক সরঞ্জামাদি সাথে নেয়া হয়েছে কারণ আমরা কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার কোন স্থানে নিজেরাই রান্না করে মধ্যাহ্নের ভোজন পর্ব করবো।
সকালের খাবার রান্না করেই নেয়া হয়েছিলো, যেটা আমরা ইঞ্জিন চালিত নৌকাতেই সেরে ফেললাম। ভ্রমণে সঙ্গী সকলের জন্য আনন্দ দেয়ার জন্য বিভিন্ন কুইজ ও খেলাধুলা আয়োজনের দায়িত্ব পড়েছিলো আমার আর হিমেলের ওপর। আমরা খুব আগ্রহ নিয়েই আগের রাতে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলাম।
নদীর বুক চিড়ে চলতে শুরু করেছে আমাদের নৌকাটি, আমি যেহেতেু ঐ এলাকার সাথে পরিচিত ছিলাম না তাই দুপাশের প্রকৃতি আর জনপদ দেখছিলাম। আগেই বলেছি এটা ছিলো তিস্তা নদীর একটি শাখা, এখানে নদীতে তেমন ঢেউ ছিলোনা। যদিও বিষয়গলো আমি চলার পথে জেনেছি, মূল নদীতে পৌঁছাতে আমাদের একঘন্টার মতো সময় লেগে গিয়েছিলো।
এরই মধ্যে সকলের জন্য আমরা একটি কুইজের আয়োজন করে ফেললাম, খুবই মজার ছিলো আয়োজনটি, সকলেই অনেক উপভোগ করলো। হঠাৎ—ই বোধহয় টের পেয়ে গেলাম খরে¯্রাতা তিস্তার পরিচয়ের সাথে, তীব্র স্রোতের সাথে বোধহয় বেশ ধাক্কা খেলো আমাদের নৌকা, বুঝতে বাকি রইলোনা মূল তিস্তা নদীতে আমরা প্রবেশ করে ফেলেছি। আমি বাইরে তাকিয়ে দেখতে থাকলাম তিস্তা নদীর রূপ।
তীব্র খরস্রোতা এক নদী এই তিস্তা, বষার্য় যেন নদী ফেলে ফুঁপে উঠেছে, যেদিকে তাকাই যেন পানি আর পানি, বেশকিছু এলাকার বাড়িঘর দেখা গেলো নদীর পানিতে নিমজ্জিত, শুধু ঘরের চাল দেখা যাচ্ছে। শাখা নদী থেকে মূল তিস্তা নদীতে প্রবেশের সময়টায় বুকে বোধহয় একটু নাড়া দিয়ে উঠেছিলো।
অভিজ্ঞ মাঝিদের কাছে এ বিষয়টি যে অনেক পূর্ব পরিচিত সেটি তাদের দক্ষ চালনা দেখেই বোঝা গেলো, কি ভাবে এমন খরস্রোতা নদীর সাথে তাল মিলিয়ে নৌকা এগিয়ে নিয়ে চললো। এদিকে নৌকার ভিতরে ও ছাদে চলছে আড্ডাবাজি, গল্পগুজব আর সবজি কাটার কাজ।
আমি গল্পের পাশাপাশি বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম, ক্যামেরায় চেষ্টা করছিলাম নৈসর্গিক দৃশ্যগুলো বন্দী করে রাখতে। এর মাঝেই লক্ষ্য করলাম, আকাশে আর সূর্যের দেখা নেই, কালো মেঘের আগ্রাসন, কেমন যেন একটা থমথমে পরিবেশ। নৌকার একদম সামনে বসেছিলেন একজন মরুব্বী, এই নৌকাটির মালিক যিনি এবং তিনিই সংকেত দিয়ে নৌকা পরিচালনার যাচ্ছিলেন, তিনি আকাশের এ অবস্থা বুঝেই বললেন ঝড় আসতে আর বেশি দেরি নেই।
মাঝনদীতে তখন আমাদের নৌকা, দুপাশের তীর ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না, নদীর ঢেউ যেন টালমাটাল হয়ে উঠেছে। তিনি (মুরুব্বী) সংকেত দিলেন নৌকা তীর ঘেঁষে নিতে। কিন্তু কয়েক মিনিটের মাঝেই শুরু হয়ে গেলো ঝড়ো বাতাস আর বৃষ্টি। আমরা সবাই তখন নৌকার ছাউনির ভেতর চলে এসেছি। সেই মুরুব্বী কিন্তু ঝড় বৃষ্টির মাঝেই নৌকার একদম সামনে বসেই নির্দেশনা দিতে লাগলেন।
সেই সময়টা আমাদের জন্য বেশ শ^াসরুদ্ধকর ছিলো। আমি প্রচন্ড ভয়ে সৃি®টকতার্কে স্মরণ করতে লাগলাম। তীব্র বাতাসের বেগ, উত্তাল ঢেউয়ে নৌকা এদিক ওদিক দুলছিলো, ঢেউয়ের পানি নৌকায় বাড়ি খেয়ে নৌকার ভেতরে চলে আসছিলো। এর মাঝেই মাঝিদের চেষ্টা ছিলো নৌকা নদীর তীরে ভেড়ানোর। প্রায় ২০ থেকে ২৫ মিনিট চললো এই ঝড় বৃষ্টি, তারপর ঝড় ধীরে ধীরে থেমে গেলো তবে মৃদু বৃষ্টি ছিলো।
আমাদের নৌকা ততক্ষণে নদীর তীর ঘেষে চলছে, নিজের কাছে মনে হচ্ছিলো, হয়তো কোন পূণ্য কাজ করেছিলাম বলে সৃষ্টিকতার্ এ যাত্রায় আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। ঐ সময়টাতে নদীর যে ক্ষিপ্রতা আমি দেখেছি, সেটা এখনো মনে করলে গা শিউরে ওঠে। আমাদের নৌকা এগিয়ে চলছে, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি তখনো। আমরা এরই মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলা সীমানার মধ্যে প্রবেশ করে ফেলেছি।
এবার সিদ্ধান্ত হলো নদীর তীরবতীর্ একটা স্থান দেখার জন্য যেখানে রান্নার আয়োজন করা হবে কারণ আমাদের আবারো ফিরতে হবে কারণ অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। একটা স্থানও পাওয়া গেলো, তীরে নৌকা ভেড়ানো হলো। ঝড়ের কবলে পড়ে আমাদের পড়নের কাপড় আধাআধি ভেজা, ধীরে ধীরে আমরা সবাই নামলাম, নামানো হলো প্রয়োজনীয় সকল কিছু।
নামার পর বোধহয় দারুণ এক প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে পরিচয় ঘটলো, হিম শীতল বাতাস, ঝড়ের পর নদীর অন্যরকম এক দৃশ্য— যা আসলে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমরা যেখানে আছি এটা আসলে নদীর চর যা ধীরে ধীরে লোকলয়ে পরিণত হয়েছে, চর ঘেঁষেই একটা বাজারও দেখা গেলো।
আমাদের কয়েকজন বাজারের দিকে চলে গেলো বিশুদ্ধ পানি আনতে, শুরু হলো চুলা তৈরির কাজ, সাথে রান্নার প্রস্তুতি। এরই ফাঁকে আমরা প্রস্তুতি নিলাম খেলা আয়োজনের। রান্না শুরুর পর চরের মাঠে শুরু হলো বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, হাড়ি ভাঙ্গা, ঝুঁড়িতে বল নিক্ষেপ আর নিজেদের মধ্যেই দুই দল তৈরি করে আকর্ষণীয় ফুটবল ম্যাচ। এরই মধ্যে আশপাশের বেশ কয়েকজন ছোট শিশু ও মধ্যবয়সীরা আমাদের খেলার দর্শক হিসেবে যোগ দিলো।
চ্যাম্পিয়ন দলের জন্য ছিলো দেশী লাউ দিয়ে তৈরি সুদৃশ্য ট্রফি। কে প্রবীণ, কে নবীন আজ যেন সবাই তরুণ, এক সাথে ছুটোছুটি, আনন্দ ভাগাভাগি, হৈ হুল্লোর করেই সময় পার করছিলাম সবাই। সময় এভাবেই চলে যাচ্ছিলো দ্রুত, এরই মধ্যে আমাদের রান্নাও সমাপ্ত।
বিকেলের তখন শেষ ভাগ, সিদ্ধান্ত হলো যেহেতু আমাদের আবার ফিরতে হবে আর মেঘলা পরিবেশ— তাই নৌকার ভেতরেই খাওয়া দাওয়া করবো। দ্রুত সব গোছগাছ করে আমরা নৌকায় উঠলাম, নৌকার ইঞ্জিনের শব্দ বেজে উঠলো, শুরু হলো আমাদের ফিরতি যাত্রা। সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম।
অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেলো। নদীর ে¯্রাতের সাথে তাল মিলিয়ে ছুটে চলছে আমাদের নৌকা, এইতো একটু দূরেই ছোট ছোট লাইট জ¦ালানো আরো নৌকার দেখা মিলছে। এভাবেই চলতে চলতে আর গল্পে গল্পে আমরা একসময় সুন্দরগঞ্জে পৌঁছালাম। বিদায় জানালাম নৌকার মাঝিদের আর স্মৃতিবিজড়িত দিনটিকে। দিনটি আমার জীবনের অন্যতম এক স্মরণীয় দিন যা আমি কোনোদিনই ভুলতে পারবোনা।
ধন্যবাদ জানাই, সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার তৎকালীন হিসাব রক্ষক রায়হান ভাই, মোকলেছ ভাই, সহকমীর্ আশরাফ ভাই, মাহবুব ভাই, সাইফুল ভাই, হিমেল বড়–য়া, আফসার ভাই, মিঠু ভাই, আরিফ ভাই, মান্নান ভাই, নুরুজ্জামান ভাই, শরীফুল ভাই, রাজু ভাই, আনোয়ার ভাই, আকতার ভাই, রাজু দা সহ সকলকে যাদের পরিশ্রমে ও অংশগ্রহণে এই আনন্দ ভ্রমণ সার্থক হয়েছিলো।
সত্যিই একটি প্রাণবন্ত ভ্রমণ ছিলো, যেখানে আনন্দ যেমন ছিলো, কিছু ভয়—উৎকন্ঠাও ছিলো। তবে কাজের পরিধির বাইরেও প্রয়োজন থাকে একটু অবকাশের আর বিনোদনের, যা মনটাকে পরিশুদ্ধ করে।
ভ্রমনটি আমার কাছে সতিকার অর্থেই স্মৃতিবিজড়িত, এই ভ্রমণেই আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর মিলনক্ষেত্র। আমি স্বল্প পরিসরে চেষ্টা করেছি ভ্রমণের মূল ঘটনাগুলো উল্লেখ করার জন্য। লেখায় ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। ধন্যবাদ।