শেয়ার বাজার বিষয়ক কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা ও তার উত্তর

শেয়ার বাজার বিষয়ক কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা ও তার উত্তর

পুঁজিবাজারকে আমাদের দেশে শেয়ারবাজার বলা হয়। কে বা কারা পুঁজিবাজারকে শেয়ারবাজার ডাকা শুরু করেছে সে হদিস পাওয়া মুশকিল। এখানে আমার এই লেখায় পুঁজিবাজার ও শেয়ারবাজার একই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আমার প্রত্যাশা অদূর ভবিষ্যতে পুঁজিবাজার শব্দটি পত্র-পত্রিকায় ও বই পুস্তকে স্থান পাবে। বাজারের ব্যপকতা বোঝানোর জন্য পরিভাষা হিসেবে পুঁজিবাজার শব্দটিই যথার্থ। সংশ্লিষ্ট সকলের এদিকে দৃষ্টি রাখা উচিত।

বিগত কয়েক বছরে আমাদের দেশের পুঁজিবাজার ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। এটি আরও বাড়বে। প্রতিদিন নতুন নতুন লোক পুঁজিবাজারে ঢুকছে। প্রায় ৪০ বছর পুঁজিবাজার ছিল ঢাকার মতিঝিলে। ১৯৯৫ সালে শুরু হলো চট্টগ্রামে। তখন গুটিকতক লোকজন শেয়ারবাজার নিয়ে কারবার করতো। এখন প্রতিমাসে নতুন নতুন শহরে ব্রোকার হাউজের শাখা খোলা হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর ছাড়াও কক্সবাজার, চকোরিয়া, পটিয়া, হাটহাজারী, সীতাকুন্ড, ফেনী, মাইজদী, চৌমুহনী, কুমিল্লা, নরসিংদী, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, রাজশাহী, বগুড়া, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, খুলনা, বরিশাল সহ আরও বেশ কয়েকটি শহরে ব্রোকার হাউজের শাখা খোলা হয়েছে। আগামী বছরগুলোতে হয়তো সব জেলা শহরগুলোতে পুঁজিবাজারের সেবা পাওয়া যাবে। সিডিবিল হওয়ার সুবাদে কতজন বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে আছে তার একটি সঠিক তথ্য পাওয়া সম্ভব। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট বিওধারীর সংখ্যা ২৬৮২২৬ এর বেশি। এই বিরাট বিনিয়োগকারী বা বিনিয়োগে আগ্রহী জনগণের অতি ক্ষুদ্রতম অংশের পুঁজিবাজার সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় বিদ্যাবুদ্ধি আছে। বাদবাকীরা একেবারে অজ্ঞ। তারপরও তারা পুঁজিবাজারে ঢুকতে আগ্রহী। আইপিও’র মাধ্যমে এদের হাতেখড়ি। বর্তমান অবস্থায় আইপিও’তে বিনিয়োগ করতে জ্ঞানবুদ্ধির তেমন কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আইপিও প্রাইসিং এর পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে বা নতুন বিনিয়োগকারীদের অজ্ঞতার কারণে ভালো খারাপ সব আইপিও’ই আজকাল ওভার সাবস্ক্রাইবি হয়। লটারির মাধ্যমে ৫/১০ টার মধ্যে একটা পেলে ৪/৫ গুন বেশি দরে বিক্রি করে লাভ করার কারণে প্রতিদিন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়ছে। এমতাবস্থায় বাজার বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন অতি দ্রুততার সঙ্গে পুঁজিবাজার সংক্রান্ত বিষয়ের উপর বিনিয়োগকারীদের প্রশিক্ষণ একান্ত প্রয়োজন। বিনিয়োগকারী ছাড়াও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট অন্যদেরও ব্যাপক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? নিজ অর্থ খরচ করে কে কাকে প্রশিক্ষণ দেবে? এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে আর উপেক্ষা করা যায় না। কারণ না জেনে-বুঝে অন্যের দেখাদেখি শেয়ার বাজারে প্রবেশ করে অনেকেই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, সর্বশান্ত হচ্ছে। তাই সামাজিক দায়িত্ববোধের তাড়নায় যৎসামান্য জ্ঞান নিয়ে নতুন বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে আমার এই ছোট্ট প্রয়াশ। গবেষক, কৌতুহলি বা জ্ঞানপিপাসুরা গুগল করলে দেখতে পাবেন কি বিশাল বিশ্ব পুঁজিবাজার জগৎ। না জেনে না বুঝে কি নিয়ে আমরা খেলছি? তবে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। এক সময় এখনকার বিজ্ঞরাও আমাদের মতো ছিল- এমন ধারনাও মোটেই ঠিক নয়। না জেনে ঝুঁকি নেওয়া প্রায়শই বিপদ ডেকে আনে। তাই পুঁজিবাজার বা শেয়ারবাজারের ধারণা কিভাবে স্বল্প পরিসরে দেওয়া যায় এই ভাবনা থেকেই, যদি পাঠাকের হয়ে প্রশ্ন-উত্তর আকারে করা যায় তাহলে সকলের জন্যই সুবিধা হয়।

প্রশ্ন-০১: সংক্ষেপে শেয়ার কি?

উত্তরঃ সংক্ষেপে বলতে হলে, শেয়ারের অর্থ হলো ভাগাভাগি। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো কিভাবে ভাগাভাগি? উত্তর হলো বড় বড় কোম্পানি, ব্যাংক, বীমা ইত্যাদির মালিকানা ভাগাভাগি। শেয়ার হলো মালিকানার অংশ। একটি শেয়ার একটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানার একটি ক্ষুদ্র অংশ। সরাসরি কিনে শেয়ারের মালিক হওয়া যায়, আইপিও অথবা যৌথ স্কিম (মিউচুয়্যাল ফান্ড, ইউনিট সার্টিফিকেট, পেনশন ফান্ড, প্রভিডেন্ড ফান্ড ইত্যাদি) এর মাধ্যমে গৌণভাবেও শেয়ারের মালিক হওয়া যায়। (শেয়ার কি এ সম্পর্কে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে)।

প্রশ্ন-০২: শেয়ারে বিনিয়োগ করলে লাভ কি?

উত্তরঃ শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে যে কেউ কোম্পানির মালিক হতে পারে। মালিক হওয়ার সুবাদে উক্ত শেয়ার হোল্ডার- কোম্পানি লাভ করলে লাভের অংশ (ডিভিডেন্ড) পাওয়ার অধিকার লাভ করে, কোম্পানি যদি মূলধন বাড়াতে চায় তা পাওয়ার অগ্রাধিকার (রাইট শেয়ার) লাভ করে। কোম্পানির বাৎসরিক আর্থিক প্রতিবেদন পাওয়ার অধিকার লাভ করে। কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় অংশগ্রহণ করে সভার কার্য়ক্রমের উপর মতামত প্রকাশের অধিকার, পরিচালকদের প্রতিবেদন অনুমোদন বা প্রত্যাখান করার অধিকার লাভ করে। পরিচালক নিয়োগে ভোট দেওয়ার অধিকার এবং নিরিক্ষক নিয়োগের অধিকার লাভ করে। শেয়ারের মালিকদের পুঁজিবাজারের পরিভাষায় শেয়ার হোল্ডার (Shareholder) বলা হয়। কোম্পানি আইন 1994-এ শেয়ার হোল্ডারদেরকে এ সকল অধিকার দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় সুবিধা লিকুইডিটি অর্থাৎ যখন নগদ টাকার প্রয়োজন হয় ¾ দিনের মধ্যে শেয়ার বিক্রয় করে নগদায়ন করা যায়।

প্রশ্ন ০৩: কোন শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন?

উত্তরঃ বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি লোক শেয়ারে বিনিয়োগ করে আসছে। এর অন্যতম কারণ হলো সঞ্চয়ের প্রকৃত বৃদ্ধি সাধন করা। শেয়ারে বিনিয়োগ করলে দুইভাবে লাভবান হওয়া যায়। একটি হলো ডিভিডেন্ড অন্যটি হলো ক্রয়কৃত শেয়ারের দরবৃদ্ধি। ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট বা সেভিং সার্টিফিকেটে বিনিয়োগ করলে মূল টাকা বাড়ে না। শেয়ারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করলে মূল টাকাও বাড়ে। আর এই বাড়ার হার অন্য সকল বিনিয়োগের তুলনায় অনেক বেশি। এই ব্যাপারটিই বেশিরভাগ লোককে শেয়ারে বিনিয়োগে আগ্রহী করে থাকে। কোম্পানি যদি ভালোভাবে চলে এবং ভালো লাভ করতে পারে দেশের অর্থনীতিতে যদি আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি ঘটে বা পুঁজিবাজারের পারফরমেন্স যদি ভালো হয় তাহলে ঐ কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়বেই। দর বাড়ার কারণে বিক্রয় করে যে লাভ হবে তাকে মূলধনজনিত লাভ বলা হয়। শেয়ারে বিনিয়োগ করলে মূলধনজনিত লাভ হবেই এই নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। শেয়ারবাজার একটি ঝুঁকিপূর্ণ বাজার। এক এক সময় ঝুঁকির পরিমাণ বিপদজনক পর্য়ায়ে চলে যেতে দেখা যায়। না বুঝে, না জেনে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগের আসল টাকাও খোয়া যেতে পারে। শেয়ারবাজারে লাভ পাওয়ার অনিশ্চয়তাও আছে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীর চিহ্নিত দুই শত্রু হলো GF অতি লোভ (Greed) এবং অতি ভয় (Fear)। এই দুটিকে এড়িয়ে চলতে পারলে শেয়ারবাজারের ঝুঁকিকে নিয়ন্ত্রনে রেখে অন্য বিনিয়োগের তুলনায় কয়েকগুন বেশি লাভ করা যায়।

প্রশ্ন ০৪: পুজিঁবাজারের বা শেয়ার বাজারের শেয়ার কি? শেয়ার বাজারের শেয়ার কি কি ধরনের হয়?

উত্তরঃ একটা কোম্পানির মোট মূলধনকে শেয়ার ক্যাপিটাল বলে। মোট মূলধন এর টাকাকে ১০ টাকা বা ১০০ টাকা হিসেবে ভাগ করেন যে সংখ্যা পাওয়া যায় তাকে মোট শেয়ার সংখ্যা বলে। একটি শেয়ার একটা কোম্পানির মূলধনের ক্ষুদ্রতম অংশ। যারা শেয়ার কিনবেন তারা ঐ কোম্পানির আংশিক মালিক হবেন। একটি কোম্পানির ১০০টি শেয়ার থাকলে কেউ যদি ১০টি শেয়ার ক্রয় করেন তবে সে ওই কোম্পানির ১০ শতাংশের মালিক হবেন। শেয়ার নানা ধরনের হতে পারে। যেমন- অর্ডিনারি শেয়ার এবং প্রেফারেন্স শেয়ার। অর্ডিনারি শেয়ারকে আমরা সংক্ষেপে শেয়ার বলি। আমাদের দেশে বর্তমানে অর্ডিনারি শেয়ারের প্রচলন বেশি। অবশ্য প্রেফারেন্স শেয়ারের প্রচলনও রয়েছে। অতি সম্প্রতি অনেক কোম্পানি স্বল্পমেয়াদি প্রেফারেন্স শেয়ার ছেড়েছে। কিন্তু এগুলো স্টক এক্সচেঞ্জ-এ তালিকাভুক্ত করা হয়নি।

প্রশ্ন ০৫: প্রেফারেন্স শেয়ার কাকে বলে? কাদের জন্য এবং কি কি কারণে প্রেফারেন্স শেয়ার ছাড়া হয়?

উত্তরঃ যে শেয়ার ইস্যুর শর্তে সাধারণ শেয়ারের তুলনায় কিছু বর্ধিত সুবিধা দেওয়া থাকে তাকে প্রেফারেন্স শেয়ার বলে। বিগত বৎসরগুলোতে প্রেফারেন্স শেয়ারের তেমন প্রচলন ছিল না। অতি সম্প্রতি বেক্সিমকো ফার্মা, নাভানা সি.এন.জি, এস. আলম, বিডি কম, ইত্যাদিসহ আরও কিছু কিছু কোম্পানি প্রেফারেন্স শেয়ার বাজারে ছেড়েছে। এর বিরাট একটা অংশ প্রাইভেট প্লেসমেন্ট-এ দেওয়া হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের নিকট বেশ একটা সাড়াও পাওয়া গেছে। বাড়তি সুবিধার দিক থেকে প্রেফারেন্স শেয়ারকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়ে থাকে। নিম্নে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলোঃ

১) প্রেফারেন্স শেয়ারের ডিভিডেন্ড এর হার ইস্যু করার সময় নির্দিষ্ট করা থাকে। এই হার ফিক্সড ডিপোজিট এর হার থেকে বেশি হয়ে থাকে।

২) কোনো কোনো প্রেফারেন্স শেয়ারের ডিভিডেন্ড কিউমিলেটিভ অথবা নন কিউমিলেটিভ হতে পারে। কোন বৎসর কোম্পানির লাভ না হলে নন কিউমিলেটিভ প্রেফারেন্স শেয়ারহোল্ডারগণ কোনো ডিভিডেন্ড পাবে না। কিউমিলেটিভ প্রেফারেন্স শেয়ারের বেলায় কোন বৎসর লাভ না হওয়ার কারণে ডিভিডেন্ড দিতে না পারলে পরের বৎসরের লাভের থেকে এক সঙ্গে দুবছরের ডিভিডেন্ড দিতে হবে।

৩) প্রেফারেন্স শেয়ারের মেয়াদকাল স্বল্পমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি বা মেয়াদবিহীন হতে পারে।

৪) মেয়াদ শেষে প্রেফারেন্স শেয়ারের হোল্ডারগণ ফেইস ভ্যালুর সমান টাকা ফেরত পেতে পারেন।

৫) ‍মেয়াদ শেষে প্রেফারেন্স শেয়ার শত ভাগ বা আংশিক সাধারণ শেয়ারে রূপান্তর হতে পারে। সাধারণত কত বৎসর বা কত মাস পরে রূপান্তর হবে এবং কি হারে রূপান্তর হবে তার উল্লেখ থাকে। সমমূল্যের একটি প্রেফারেন্স শেয়ারের জন্য একটি সাধারণ শেয়ার দেওয়ার শর্ত হতে পারে। অথবা যেদিন রূপান্তর হবে সেইদিনের সাধারণ শেয়ারের বাজারমূল্যে/ বিগত কয়েক মাসের গড় বাজারমূল্যে রূপান্তরের শর্তও হতে পারে।

৬) রূপান্তর এক সঙ্গেও হতে পারে বা বিভিন্ন মেয়াদ শেষে হতে পারে।

৭) প্রেফারেন্স শেয়ার লিস্টেড অথবা নন লিস্টেড হতে পারে।

যে সকল বিনিয়োগকারী নির্দিষ্ট হারে লাভ পেতে ইচ্ছুক তাদের জন্য প্রেফারেন্স শেয়ারের বিনিয়োগ নিরাপদ। প্রেফারেন্স শেয়ারকে আকর্ষণীয় করার জন্য রূপান্তরের সুবিধা দেওয়া হয়। যখন বাজার মন্দা থাকে বা আইপিও সহায়ক নয় সে সময় প্রেফারেন্স শেয়ার ছাড়া হয়। অথবা কোন কোম্পানির উপর আস্থা তৈরী করার জন্য প্রথমে প্রেফারেন্স শেয়ার বাজারে ছেড়ে আস্থা সৃষ্টি করা হয়। প্রেফারেন্স শেয়ার প্লেসমেন্ট এর মাধ্যমে বা আইপিও’র মাধ্যমেও বাজারে আসতে পারে। রাইট হিসেবেও আসতে পারে।

Related Posts