১৫ টাকা থেকে ১৬০০ কোটি টাকার মালিক হওয়ার কাহিন

 

জীবন যখন পরিক্ষা নিতে শুরু করে তখন মানুষের আসল রুপ বাইরে বেরিয়ে আসে। জীবনের কঠিন পরিক্ষায় কেও দূরভাগ্যের  দোহায় দিয়ে হার মেনে নেয়, তো কেও আবার সেই পরিস্থিতিতে কিছু করে দেখিয়ে গোটা পৃথিবীর কাছে অনুপ্রেরনার উৎস হয়ে দাড়ায়। এরকম-ই একজন মানুষ হলেন “ইএসএস ডি এলুম্যানিয়াম প্রাইভেট কোঃলিঃ-এর ফাউন্ডার সুদীপ দত্ত” যিনি এক সময় এই কোম্পানিতেই দিনমুজুর হিসেবে কাজ করেছেন। এক সময় মাত্র ১৫ টাকা দিন পারিশ্রমিক হিসেবে কাজ করা সুদীপ দত্ত, আজ ১৬শ কোটি টাকার কোম্পানির মালিক।  কিভাবে কঠোর পরিশ্রম ও অদম্য ইচ্ছা শক্তির মাধ্যমে তিনি এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন সেটি নিয়েই আজ আমি আলোচনা করব।

১৯৭২ সালে ভারতের পশ্চিম বাংলার একটি ছোট শহর দুর্গাপুরে সুদীপ দত্ত জন্ম গ্রহন করেন। তার বাবা ছিলেন একজন সাধারন আর্মির সৈনিক। ১৯৭১ সালে ইন্ডো-পাকিস্থান যুদ্ধে গুলি লেগে তিনি প্যারালাইজড হয়ে যান। ফলে উপার্জনের দিক থেকে সুদীপ দত্তের বড় ভাই-ই পরিবারের ভরসা হয়ে উঠেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই তার ভাইয়েরও শারিরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভালো না থাকার কারনে চিকিৎসার অভাবে তার ভাই মারা যান। বড় ছেলের মৃত্যু শোকে কাতর হয়ে তার বাবাও অল্প কিছু দিনের মধ্যে মারা যান। যার ফলে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই সুদিপ দত্তের উপর তার চার ভাই-বোন সহ পুরো পরিবারের ভার এসে পরে। তখন অনেক সময় না খেয়ে তাদের পরিবারকে দিনের পর দিন লড়াই বেচে থাকতে হয়েছিল। এতে করে সুদীপ দত্তের কাছে মাত্র একটি পথই খোলা ছিল, আর সেটা হল পরাশুনা ছেরে দিয়ে নিজের একালাতেই কোথাও দিন মুজুরির কাজ করা। কিন্তু তিনি সেটি না করে অন্য পথ বেছে নেন। তিনি তার বন্ধুদের সাথে পরামর্শ করে এবং অমিতাভ বচ্চন এর ছবি দেখে অনুপ্রানিত হয়ে ট্রেনের টিকিট কেটে ড্রিম সিটি মুম্বায়ের উদেশ্যে রওনা দেন। ছোট বেলা থেকেই তার বড় কিছু করার ইচ্ছা তার এই দুঃসময়েও তাকে অন্যরকম সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।

১৯৮৮ সালে মুম্বায় পৌছে ১৫ টাকা দিন পারিশ্রমিকে একজন দিম মুজুর হিসেবে শুরু হয় তার কর্ম জীবন। সেখানে তার কাজ ছিল প্যাকেজিং, লোডিং এবং ডিলিভারি। তখন সেই কোম্পানিতে তারই মতন আরও ১২ জন কর্মী ছিল। ভীষণ কষ্টের মধ্যে দিয়ে তার দিন কাটতে শুরু হয়। ১২-১৩ জনে ঠাসা-ঠাসি করে একটি ঘরের মধ্যে তাকে রাতে ঘুমতে হত। এভাবে প্রায় ২-৩ বছর পর, ১৯৯১ সালে তার ফ্যাক্টরির মালিককে এক বিরাট খতির সম্মুক্ষিন হতে হয়। ফলে তিনি ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর এখান থেকেই শুরু হয় সুদিপ দত্তের সফলতার যাত্রা। তিনি এই সুযোগকে কাজে লাগাতে তার জমানো কিছু টাকা আর বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে মোট ১৬ হাজার টাকা জোগার করেন। এবং সেই টাকায় সেই ফ্যাক্টরিটা কিনে নেয়ার প্রস্তাব নিয়ে তিনি তার মালিকের কাছে যান। কিন্তু একটা ফ্যাক্টরি কেনার জন্য এইটুকু টাকা যথেষ্ট ছিল না। তবু ঐ ফ্যাক্টরিতে অনেক লস হওয়ার কারনে ফ্যাক্টরির মালিক সেই টাকাতেই রাজি হয়ে যান। কিন্তু একটা সর্তে’ যে  আগামী ২ বছর ঐ ফ্যাক্টরিতে যা লাভ হবে তার পুরো টাকা সুদিপ দত্তকে তার আগের মালিককেই দিতে হবে। সুদিপ দত্ত তখন ঐ সর্তে রাজি হয়ে যান। যে ফ্যাক্টরিতে তিনি কাল পর্যন্ত একজন কর্মচারি ছিলেন আজ তিনি সেই ফ্যাক্টরির মালিকে পরিনত হন। কিন্তু খাতা কলমে ফ্যাক্টরির মালিকে পরিনত হলেও পরিবারের পাশাপাশি তার ঘাড়ের উপত অতিরক্ত ঋনের বোঝাও এসে পরে ।

এলুম্যানিয়াম প্যাকিজিং ইন্ড্রাস্টিরি সে সময় একটা খারপ সময়ের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করছিল। পুরো মার্কেটের শেয়ার তখন মাত্র দুটো কোম্পানির হাতে ছিল। ১ জিন্ডাল লিঃ আর ইন্ডিয়া ফয়েল। আর দুটো কোম্পানিই ছিল অনেক বড় এবং শক্তিশালী। একটা ছোট কোম্পানি নিয়ে তাদের সাথে টেক্কা দেয়া সে সময় প্রায় অসম্ভব ছিল। সে সময় নতুন নতুন ফ্যাক্টরি হওয়াতে মার্কেটে আরও ভাল ফয়েলের চাহিদা বারতে থাকে। সুদিপ দত্ত সেই সুযোগটাকে কাজে লাগালেন। তিনি ভাল মানের ফয়েল বানিয়ে আস্তে আস্তে মার্কেট ধরতে শুরু করেন। তিনি সাঁরা বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করতে শুরু করেন এবং নিজে গিয়ে বিভিন্ন কোম্পানি গুলোকে বলতে থাকেন কেন তাদের প্রডাক্ট অন্যান্য ফ্যাক্টরির চাইতে আলাদা ও ভাল। এভাবে প্রথমে ছোট খাট কোম্পানির উপর ভিত্তি করে তিনি ফ্যাক্টরি চালাতে থাকেন। আর আস্তে আস্তে মার্কেটে তার পন্যের জায়গা করতে শুরু করেন। এর পর যখন সান ফার্মা ও নেসলের মত বড় বড় কোম্পানির কাছ থেকে অর্ডার পেতে শুরু করেন তার পর থেকে সুদিপ দত্তকে জীবনে আর কখোন পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সফলতা তার জীবনে ধরা দিতে শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু তার কিছুদিনের পরেই আবার অনিল আগারঅয়ালার ভেদান্তা কোম্পানি প্যাকেজিং ইন্ড্রাসট্রিতে পা রাখে। ভেদান্তা সে সময় বড় কোম্পানি গুলোর মধ্যে একটি ছিল। তখন তাদের সাথে মার্কেটে টিকে থাকা সুদীপ দত্তের জন্য আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়ায়। কিন্তু সেবারও সুদীপ দত্ত হার না মেনে আরও কঠোর পরিশ্রম করতে শুরু করেন ও নিজের কোম্পানির প্রডাক্টের কোয়ালিটি আরও বহুগুনে বারিয়ে তুলেন। অবশেষে ভেদান্ত কোম্পানিকে সুদীপ দত্তের কাছে মাথা নত করতে হয়। ২০০৮ সালে ১শ ৩০ কোটি  টাকার বিনিময়ে সুদীপ দত্ত ভেদান্ত কোম্পানিটি কিনে নেন। এই ডিলের পর ভেদান্ত কোম্পানি প্যাকেজিং ইন্ড্রাস্ট্রি থেকে পার্মানেন্টলি বিদায় নেয়। যেটি সুদীপ দত্তের নেয়া জীবনের গুরুত্ব পূর্ন সিদ্ধান্ত ছিল। এর পর তিনি তার কোম্পানি দ্রুত এগুনোর চেষ্টা করেন এবং ফার্মা প্যাকেজিং ইন্ড্রাস্ট্রিতে নিজের পরিচয় তৈরি করেন।

১৯৯৮ থেক ২০০০ সালের মধ্যে তিনি কোলকাতা শহরের মধ্যে টোটাল ১২ টি প্রোডাকশন ইউনিট স্থাপন করেন। আজ সুদীপ দত্তের ই এস এস ডি এলোম্যানিয়াম প্রাঃলিঃ প্যাকেজিং ইন্ড্রাস্ট্রিতে ইন্ডিয়ার নাম্বার ওয়ান কোম্পানি। এবং আগামী কিছুদিনের মধ্যেই প্যাকেজিং ইন্ড্রাস্ট্রিতে ওয়ার্ল্ডের সব থেকে বড় দুটি কোম্পানি উনিলির্ভার এবং পি এন্ড জি – এর সাথে তারাও নিজেদের নাম একি জায়গায় নিয়ে যাবেন বলে আশা রাখেন সুদীপ দত্ত। এর সাথে BSB এবং NSE তেও সুদীপ দত্তের কোম্পানি নিজের জায়গা করে নিয়েছে। তার এই অভাবনীয় সাফল্যের জন্য তাকে প্যাকেজিং ইন্ড্রাস্ট্রির নারায়ন মুর্তিও বলা হয়ে থাকে। বর্তমানে তার কোম্পানির মার্কেট ভ্যালু প্রায় ১৬শ কোটি টাকার চাইতেও বেশি। এত কিছু পাবার পরেও তিনি নিজেকে এখনও অতিসাধারন মনে করেন । আর এর একটি বর উদাহরন  তার সেই ফ্যাক্টরির কর্মচারিরা তাকে এখনো দাদা বলে ডাকে। তিনি গরিব মানুষদের সাহায্যের জন্য সুদীপ দত্ত ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছে।

<

দূর্গাপুরের সুদীপ দত্তের জীবনের কাহিনী আমাদেরকে এটা শিখায় যে, কি করে জীবনের কঠিন সময়ে ভেঙ্গে না পরে আরও শক্ত হয়ে উঠে দাড়াতে হয়। কারন যারা সবরকম পরিস্থিতিতে চেষ্টা চালিয়ে যায়, তাদের জীবনে কোন দিনো বিফলতা আসে না।

অবশেসে আপনার কাছে আমার ছোট একটা অনুরোধ যদি আপনার এই লিখাটা ভালো লেগে থাকে ও অনুপ্রানিত হন, তাহলে শেয়ার করে আপনার পরিচতজনদের অনুপ্রানিত করতে সাহায্য করুন।

Related Posts