আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন ও তার তাৎপর্য।

প্রত্যেক জাতির ই কিছু সফলতা থাকে যার জন্য তারা গর্ব অনুভব করতে পারে।আমাদের মাতৃভাষা আমাদের অর্জিত সফলতা এবং আমাদের জাতীয় ঘটনা।কিন্তু আমাদের সবচেয়ে গর্বের বিষয় হলো আমাদের এই জাতীয় উদযাপন আমাদের দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে রূপ লাভ করেছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের দেশের ভাষা আন্দোলনে আমাদের দেশের বীর যোদ্ধা দের বীরত্বের প্রতীক এবং এটি মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য আমাদের দেশের মানুষদের আত্মত্যাগের ও বহি প্রকাশ। এই দিনটি আন্তর্জাতিক ভাবে পালনের মাধ্যমে সারা বিশ্ববাসী আমাদের দেশের বীর যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় এবং তাদের মহান ত্যাগের কথা স্মরণ করেন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের পূর্বে বাংলাদেশে ই শুধু মাতৃভাষা দিবস উদযাপিত হতো। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের পর সারা বিশ্বব্যপী এই দিনটি নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে পালিত হয় এবং এই দিনটি সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়।এটি হলো সেই দিন যেদিন আমাদের দেশের মানুষ তাদের মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য রাজপথে নেমেছিলেন এবং নিজের জীবনের পরোয়া না করে মাতৃভাষার জন্য লড়াই করেছিলেন। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালীরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলন করেছিলেন।১৯৪৮ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর ভিত্বি করে পাকিস্তান এবং ভারত নামের দুটো রাষ্ট্রের জন্ম হয়।পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের আগে থেকে ই নতুন রাষ্ট্রের ভাষা কি হবে তা নিয়ে অনেক বিতর্ক শুরু হয়।পাকিস্তানের ক্ষমতাশালীদের আগে থেকে ই পরিকল্পনা ছিলো নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ভাষা উর্দু করা হবে।১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের শাসক এক জনসভায় ঘোষণা কর্ন যে উর্দু ই হবে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা।তার সেই ঘোষণা তীব্র প্রতিবাদ জানায় বাংলার মানুষ। কারণ পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ লোকের মুখের ভাষা বাংলা।সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া উচিত উর্দু নয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগুষ্টি বাঙালিদের উপর তাদের একচেটিয়া সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়।তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।সেটা বাঙালিরা কিছুতে ই মেনে নেয় নি। বাঙালিরা উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি চেয়েছিলো কিন্তু পাকিস্তানিরা বাঙালির সে প্রস্তাবও মেনে নেয় নি।
১৯৭১ সালে সারা দেশে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে বাঙালিরা আন্দোলন, সমাবেশ করেন।তাদের সেই আন্দলোনের মাত্রা ধিরে ধিরে বাড়তে থাকে এবং প্রবল আকার ধারণ করে। তখনও পাকিস্তান সরকার বাঙালির দাবিকে অগ্রাহ্য করে ১৪৪ ধারা জারি করে। পাকিস্তান সরকারের সেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাঙালিরা শান্তিপূর্ণ ভাবে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যায়।পাকিস্তান সরকারের পক্ষে বাঙালিদের আন্দোলন প্রতিরোধ করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছিলো।যাইহোক যখন ছাত্র, রাজনৈতিক দল এবং সর্বস্তরের সাধারণ জনতা ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজপথে মিছিল বের করে তখন পুলিশ মিছিলকারীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়।এর ফলে সালাম,রফিক,জব্বার,বরকত, শফিক সহ নাম না জানা আরো অনেক মানুষ প্রাণ হারান। এভাবে পাকিস্তানিরা বাঙালীকে দমাতে পারেন নি।এর ফলে আন্দোলন আরো বেগবান হয়।বাঙালীরা গর্জে উঠে।সারা দেশে বিক্ষোভ, সমাবেশ আরো বেড়ে যায় এবং অবশেষে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। অবশেষে বাংলা রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পায়। তখন থেকে ই এই দিনটি সারা দেশে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে ভাষা শহিদদের প্রতি অনেক শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে।১৯৯৯ সালের ১৭ ই নভেম্বর ইউনেস্কো এবং ইউএন আমাদের মাতৃভাষা আন্দোলন এবং সেই আন্দলোনে আমাদের ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি দান করেন।ইউনেস্কো এটা ঘোষণা করেন যে এই দিনটি প্রতি বছর আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হবে।।২০০০ সাল থেকে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হচ্ছে। ইউনেস্কোর ঘোষণা এবং প্রতি বছর সারা বিশ্বব্যপী এই দিনটি পালনের মাধ্যমে আমাদের দেশের ভাষা শহিদদের মর্যাদা আরো অনেক বেড়ে গেছে এবং আমাদের দেশের জাতীয় গর্বও বাড়িয়ে তুলেছে। ইউনেস্কোর স্বীকৃতির মাধ্যমে আমাদের মাতৃভাষা দিবস আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। আমাদের মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাতৃভাষা দিবস পালিত হওয়া সত্যি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। ইউনেস্কোর ঘোষণায় শুধু মাত্র আমাদের মাতৃভাষাকে ই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয় নি বরং এটা নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছিলো যে নিজের ভাষায় কথা বলা প্রত্যেকের ই জন্মগত অধিকার এবং কেও এই অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারে না।এই ঘোষণায় এটাও বলা হয়েছিলো যে এই দিবসটি উদযাপনের মাধ্যমে বিশ্বের সকল ভাষাকে সংরক্ষণ করা হবে যা একটি দেশের সাংস্কৃতিক ও জাতিগত পরিচয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতি বছর বাংলাদেশে মাতৃভাষা দিবস পালিত হচ্ছে।এই দিন আমরা আমাদের ভাষা শহিদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করি,তাদের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করি,আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যারা তাদের প্রাণ দিয়েছেন তাদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করি এবং তাদের সকলের আত্মার শান্তি কামনা করি।
আমরা আমাদের ভাষা শহিদদের স্মরণে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করেছি ১৯৫২ সালে( যা শহিদ মিনার নামে পরিচিত) যেখানে প্রতি বছর আমরা ফুল অর্পণ করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
যাইহোক একুশে ফেব্রুয়ারি এবং এটি উদযাপন খুব ই গর্বের একটি বিষয় আমাদের জন্য। এটি হলো সেই দিনের ঘটনা যা আমাদের দেশের স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলো। আমাদের স্বাধীনতা লাভের পথকে সুগম করেছিলো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মাতৃভাষা আন্দোলন আমাদের নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করার, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেয় এবং একই সাথে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাথা উঁচু করে বাচার সাহস জুগিয়েছে।এটি আমাদের দেশের জন্য সর্বোচ্চ স্বার্থ ত্যাগ করার করার শিক্ষাও দেয়। সুতরাং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ভুমিকা অপরিসীম। আমরা ই বিশ্বের একমাত্র জাতি যারা মাতৃভাষার জন্য নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের গৌরবময় ইতিহাস এবং সংস্কৃতির ধারক এবং মহান অর্জন।আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের জাতীয় পরিচয় বহন করে এবং বিশ্বের দরবারে আমাদের পরিচিতি গড়ে তুলে। আমরা সত্যি খুব গর্বিত যে আমদের এমন অর্জন আছে যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আছে।।

Related Posts

8 Comments

মন্তব্য করুন